জলবায়ু সংক্রান্ত জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চার দফা কর্মসূচি
রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আই পি সি সি) সাম্প্রতিক রিপোর্টে জলবায়ু কর্মসূচি রূপায়ণ না করার পরিণতি সম্পর্কে কড়া সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। কপ ২৬-এ ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে নেট জিরো নিঃসরণ অর্জন করার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছিল, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণের মাত্রা অন্তত ৪৫% কমিয়ে আনার কথা বলেছিল। বিশ্বজনীন জলবায়ু সংক্রান্ত নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু কর্মসূচিকে রূপরেখা দিতে সমর্থ হওয়ার সুবাদে ভারতের দায়িত্ব বর্তায় আরও শক্তিশালী ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনের সঙ্গে কপ ২৭-এর নেতৃত্ব দেওয়া, যাতে সে বিশ্বকে গুরুত্বপূর্ণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য অর্জনের পথে আনতে পারে।
তবে, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জলবায়ু কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ যথেষ্ট বন্ধুর। ২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে বিশ্ব জলবায়ু প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে ভারতের ভূমিকা পালনকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও ভারত সরকার জ্বালানি, স্থিতিশীলতা এবং দূষণহীন প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু কর্মসূচি ক্ষেত্রগুলিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে অসমর্থ হয়েছে। ইলেকট্রিক ভেহিকলস-এর (ই ভি এস) মতো মুষ্টিমেয় কয়েকটি জলবায়ু কর্মসূচির ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দে বৃদ্ধি ঘটে থাকলেও তার কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই।
ভারতকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জি ডি পি) চিরাচরিত পরিসংখ্যানের সাহায্যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পরিমাপ করার পন্থার দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন ঘটিয়ে, তাতে স্থিতিশীল, সর্বব্যাপী, গ্রিন মেট্রিকসের অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে হবে যার ফলে উন্নয়নের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত দিকগুলির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং ‘বৃদ্ধির গুণমান’ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।
এই স্বল্প পরিমাণ বাজেট বরাদ্দের সাহায্যে ভারত কেমন করে কার্যকর ভাবে তার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে পারবে? কী ভাবে ভারত তার অভ্যন্তরীণ নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং জনখাতে ব্যয়ের পরিমাণকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে খাপ খাওয়াবে? আগামিদিনে ভারতকে তার জলবায়ু সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি অর্জন করতে হলে কী কী গঠনগত ও ধারণাগত কাঠামো রূপায়ণ করতে হবে?
প্রথমত, জলবায়ু সঙ্কটকে কার্যকর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ভারতকে তার বৃদ্ধিকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করতে হবে। ভারতে নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি এখনও উন্নয়ন অর্থাৎ পরিকাঠামো নির্মাণ, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা এবং কর্মসংস্থান তৈরি করা বনাম এই উন্নয়নের পরিবেশগত প্রভাবের পরম্পরাগত দ্বন্দ্বে জর্জরিত। এই দ্বন্দ্ব এ বারের বাজেটেও ফুটে উঠেছে। এ ক্ষেত্রেও জলবায়ু কর্মসূচি সংক্রান্ত ঘোষণাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সংযুক্ত করা অথবা উল্টোটা করা হয়নি। ভারতকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জি ডি পি) চিরাচরিত পরিসংখ্যানের সাহায্যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পরিমাপ করার পন্থার দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন ঘটিয়ে, তাতে স্থিতিশীল, সর্বব্যাপী, গ্রিন মেট্রিকসের অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে হবে যার ফলে উন্নয়নের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত দিকগুলির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং ‘বৃদ্ধির গুণমান’ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।
দ্বিতীয়ত, ‘ভবিষ্যৎমুখী’ বৃদ্ধির জন্য পরিকাঠামো নির্মাণ এবং এই পরিকাঠামোর ফলে উদ্ভূত ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিবেশজনিত ও আর্থ-সামাজিক সমস্যার মাঝে সেতু নির্মাণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই বছরের বাজেটেও সরকার আধুনিক পরিকাঠামো নির্মাণে ব্যাপক বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রেখেছে। তবুও উৎখাত-সহ প্রতিকূল জলবায়ু, পরিবেশগত এবং আর্থ-সামাজিক প্রভাবের সঙ্গে এই বিনিয়োগের পারস্পরিক সংহতিতে ফাঁক থেকেই যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, প্রশমনভিত্তিক জলবায়ু কৌশল থেকে সরে এসে এমন এক জলবায়ু কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে যেখানে অভিযোজন এবং স্থিতিস্থাপকতাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনুমান করা হচ্ছে যে, ভারত ২১০০ সালের মধ্যে বার্ষিক জি ডি পি-র ৩%-১০% হারাতে চলেছে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অরক্ষিত মানুষদেরই এই ক্ষতির ভার সবচেয়ে বেশি বহন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন জলবায়ু কর্মসূচিতে এক কৌশল রূপে স্থিতিস্থাপকতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।
বাজেটে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৮০ গিগাওয়াট সৌর শক্তি উৎপাদন অথবা ইভি বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাপক সহায়তা প্রদান বা সোলার ম্যানুফ্যাকচারিং কিংবা সৌরশক্তি সংক্রান্ত পরিকাঠামো নির্মাণে প্রোডাকশন লিঙ্ক ইনটেনসিভ স্কিম-এ ১৯,৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণার মতো একাধিক প্রশমনভিত্তিক উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বাজেটে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৮০ গিগাওয়াট সৌর শক্তি উৎপাদন অথবা ইভি বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাপক সহায়তা প্রদান বা সোলার ম্যানুফ্যাকচারিং কিংবা সৌরশক্তি সংক্রান্ত পরিকাঠামো নির্মাণে প্রোডাকশন লিঙ্ক ইনটেনসিভ স্কিম-এ ১৯,৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণার মতো একাধিক প্রশমনভিত্তিক উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও অন্য দিকে একই সঙ্গে জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিনিয়োগ হ্রাস ও জাতীয় অভিযোজন কর্মসূচিকে যথেষ্ট পরিমাণে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। সোলার এনার্জি কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া এবং সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের মতো জলবায়ু কর্মসূচিতে সক্রিয় সংস্থাগুলির জন্য বরাদ্দ অর্থ সাহায্যও হ্রাস পেয়েছে। অভিযোজন এবং স্থিতিস্থাপকতার প্রচেষ্টাকে সহায়তা জোগাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলির সশক্তিকরণ অপরিহার্য।
চতুর্থত, এমন ধরনের ব্যবস্থা করতে হবে, যা জলবায়ু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ টানতে সাহায্য করে। বর্তমানে জলবায়ু অর্থায়ন ব্যবস্থাটির অন্যতম প্রধান ত্রুটি হল এটির অনিশ্চয়তা, কারণ বিদ্যমান বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অর্থায়নের অধিকাংশই আসে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের থেকে। তাই সরকার দ্বারা জনখাতে খরচের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং জলবায়ুভিত্তিক প্রকল্পে সরকারি ক্ষেত্রের সংস্থাগুলির অংশগ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এক দিকে ভারত যখন কপ ২৭-এর জন্য তার কৌশল প্রস্তুত করছে, অন্য দিকে এখন এই সব কৌশল অবলম্বনের প্রক্রিয়া ভারতের বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু প্রতিশ্রুতি এবং কেন্দ্রীয় বাজেটে ঘোষিত অভ্যন্তরীণ নীতির মাঝে বহু প্রতীক্ষিত সমন্বয় সাধন করবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.