Author : Prabhash Ranjan

Published on Dec 02, 2022 Updated 19 Days ago

রাশিয়ার দাবির বৈধতা খর্ব করার জন্য ইউক্রেন আইনকে কাজে লাগিয়েছে। ভারতও একই পথে হেঁটে তার নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে পারে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের আইনি লড়াই
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের আইনি লড়াই

পরমাণু-শক্তিধর রাশিয়া একটি অ-পারমাণবিক রাষ্ট্র ইউক্রেনকে অবৈধ ভাবে আক্রমণ করার পর প্রায় ১০ মাস অতিক্রান্ত। তারপর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ক্রমাগত তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং অক্টোবর মাসের শুরুতে রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত ক্রিমিয়ান উপদ্বীপকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তকারী সেতুটি পুড়িয়ে দেওয়ার পরে এই যুদ্ধ আরও খারাপ দিকে বাঁক নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরপর রাশিয়া কিয়েভের বেসামরিক পরিকাঠামোয় ড্রোন হামলা-সহ ইউক্রেনে সামরিক হামলা বাড়িয়েছে। এর জবাবও দিচ্ছে ইউক্রেন।

যদিও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াই শুধু মাত্র সামরিক যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ নয়। ইউক্রেন বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক আদালতেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে, যা তেমন ভাবে মানুষের নজরে আসেনি। প্রকৃত পক্ষে আদালত কক্ষে ইউক্রেনের যুদ্ধগুলি ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার বেআইনি ভাবে দখল করার সময়কাল থেকেই শুরু হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে এই আইনি লড়াই ইউক্রেনের ‘লফেয়ার’ নামক কৌশলের অন্তর্গত। ‘লফেয়ার’ শব্দবন্ধটি আন্তর্জাতিক আইনের শব্দভাণ্ডারে চার্লস জে ডানলপ দ্বারা প্রবর্তিত, যিনি এক জন আমেরিকান সৈনিক থেকে আইনের অধ্যাপক হয়ে উঠেছিলেন। ডানলপ লফেয়ার শব্দবন্ধটিকে ‘একটি কার্যকর উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রচলিত সামরিক উপায়ের বিকল্প হিসাবে আইনের ব্যবহার বা অপব্যবহারের কৌশল’ বলে সংজ্ঞায়িত করেন। এটিকে আরও পরিমার্জিত করে অন্যান্য ভাষ্যকার কৌশলগত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন সঙ্ঘাত ক্ষেত্রের সূচনার মাধ্যমে নিজের সামরিক প্রতিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আইনি উপায় ব্যবহার করার একটি কৌশল হিসাবে বর্ণনা করেছেন। লফেয়ারকে একটি মূল্য-নিরপেক্ষ শব্দবন্ধ হিসাবে বর্ণনা করা হয় যেখানে আইনকে কৌশলগত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ব্যবহার এবং অপব্যবহার উভয়ই করা হতে পারে। চিন  রাশিয়া রাজনৈতিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করে আইনের অনৈতিক ব্যবহার করছে।

ডানলপ লফেয়ার শব্দবন্ধটিকে ‘একটি কার্যকর উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রচলিত সামরিক উপায়ের বিকল্প হিসাবে আইনের ব্যবহার বা অপব্যবহারের কৌশল’ বলে সংজ্ঞায়িত করেন।

ইউক্রেনের নৈতিক লফেয়ার প্রক্রিয়া (আইনি প্রক্রিয়া)

চিন এবং রাশিয়ার বিপরীতে ইউক্রেনের আইনি প্রক্রিয়া ন্যায়সঙ্গত পথেই হেঁটেছে, যার ফলে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক আন্তর্জাতিক আদালত ব্যবহার করে বহুবিধ সমালোচনামূলক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য রাশিয়ার অবৈধ যুদ্ধকে জনসমক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। প্রথমত, ইউক্রেন নিজেকে ভুক্তভোগী রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরছে এবং রাশিয়ার যুদ্ধকে আগ্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা বিভিন্ন পরিসর জুড়ে আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করছে। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আইনি প্রক্রিয়ার সূচনা করতে চায়, যাতে রাশিয়া তার মোকাবিলায় নিজের সম্পদকে বিস্তারিতভাবে কাজে লাগাতে বাধ্য হয়, যা তার খরচ বাড়াবে। তৃতীয়ত, ইউক্রেন আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তার কাজের জন্য রাশিয়াকে দায়বদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে উপলব্ধ সমস্ত আইনি পন্থার ব্যবহার করতে তৎপর এবং এমনটা করার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ইউক্রেন ক্রেমলিনের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। অন্তত পাঁচটি আন্তর্জাতিক আইনি ফোরামে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছে।

প্রথমত, ক্রিমিয়াকে রাশিয়া অবৈধ ভাবে দখল করার পর ইউক্রেন ২০১৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে (আই সি জে) রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের অব্যবহিত পরে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন আবারও আই সি জে-র দ্বারস্থ হয় এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। ইউক্রেন আই সি জে থেকে এই রায় আদায় করতে সক্ষম হয়েছে যে, জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘনের ঘটনায় আদালত সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত রাশিয়াকে অবিলম্বে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তার সমস্ত সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ রাখতে হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জ সনদের ৯৪ (১) ধারা অনুসারে রায় মেনে চলতে বাধ্য থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া এই আদেশ পালন করেনি এবং তার সামরিক আক্রমণ জারি রেখেছে।

দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন স্ট্রসবার্গ-এ ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের (ই সি টি এইচ আর) দ্বারস্থ হয়েছে এবং ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক পিটিশন দাখিল করেছে। তার সর্বশেষটি হল এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরে ইউক্রেন বনাম রাশিয়া (দশ) মামলাটি দায়ের করা। ইউক্রেন রাশিয়ার সৈন্যদের বিরুদ্ধে নিজেদের দেশে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। মার্চ মাসে ই সি টি এইচ আর রাশিয়াকে অসামরিক ব্যক্তি এবং বস্তুর বিরুদ্ধে সামরিক হামলা থেকে বিরত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে। রাশিয়া ই সি টি এইচ আর-এর রায়কে কোনও পাত্তাই দেয়নি এবং নাগরিকদের লক্ষ্য করে আক্রমণের ঘটনা চালিয়ে গিয়েছে, কিয়েভে সর্বশেষ ড্রোন হামলা যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।

তৃতীয়ত, হামবুর্গ-এর ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অফ ল অফ দ্য সি-তেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের তরফে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলার মূল ভিত্তি হল রাশিয়া দ্বারা তিনটি ইউক্রেনীয় নৌযান আটক করে রাখা। ইউক্রেন অভিযোগ জানিয়েছে, রাশিয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে।

ইউক্রেন আই সি জে থেকে এই রায় আদায় করতে সক্ষম হয়েছে যে, জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘনের ঘটনায় আদালত সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত রাশিয়াকে অবিলম্বে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তার সমস্ত সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ রাখতে হবে।

চতুর্থত, হেগ-এর আর একটি আদালত, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টও (আই সি সি) ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। ইউক্রেন আই সি সি তৈরির জন্য করা রোম স্ট্যাটিউট-এ স্বাক্ষরকারী না হলেও ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে কোনও সাময়িক সীমাবদ্ধতা ছাড়াই ইউক্রেনের ভূখণ্ডে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য আর্টিকল ১২(৩)-এর অধীনে একটি ঘোষণার মাধ্যমে আদালতের নিয়ম স্বীকার করে নিয়েছে। এর ফলস্বরূপ রাশিয়ার সঙ্গে চলমান সংঘাতও এই আদালতের এক্তিয়ারে পড়ে।

পঞ্চমত, ইউক্রেন ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার ইউক্রেনীয় সংস্থাগুলি দখল করে নেওয়া চ্যালেঞ্জ করার জন্য ১৯৯৮ সালের ইউক্রেন-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির (বি আই টি) অধীনে বিনিয়োগকারী-রাষ্ট্র বিরোধ নিষ্পত্তি বা ইনভেস্টর-স্টেট ডিসপিউট সেটেলমেন্ট (আই সি ডি এস) ব্যবহার করতে তার সংস্থাগুলিকে সমর্থন জুগিয়েছে। যে কোনও বি আই টি-তে আই এস ডি এস-এর প্রবিধানগুলি কোনও বিদেশি বিনিয়োগকারী অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে সক্ষম হলেও নিজের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তা করতে পারে না। ক্রিমিয়ার ইউক্রেনীয় সংস্থাগুলি এখন রাশিয়ার অধীনস্থ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত। এ ভাবে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে বি আই টি-কে কাজে লাগিয়েছে এবং রাশিয়ার স্পষ্ট অবৈধতা প্রকাশ্যে তুলে ধরতে আই এস ডি এস ট্রাইব্যুনালের সামনে কৌশলের সঙ্গে দখলদারি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনকে ব্যবহার করেছে।

ইউক্রেন এই কৌশলে বেশ সফল হয়েছে। বিপুল সংখ্যক দেশ আই সি জে, ই সি টি এইচ আর এবং আই সি সি-র মতো একাধিক বিচারবিভাগীয় ফোরামে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনের জবাবদিহি চেয়েছে।

ভারতের জন্য শিক্ষা

ভারত তার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইউক্রেনের পদক্ষেপ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভারতের উচিত আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহার করে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ৩৭০ ধারা খারিজের পরে অবৈধ ভাবে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বন্ধ করার মতো বিভিন্ন কাজের জন্য দায়ী করা। একই ভাবে ভারতের পূর্ব স্বাক্ষরিত সীমান্ত শান্তি চুক্তির অধীনস্থ একাধিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি লঙ্ঘন করার জন্য চিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া উচিত। এর পিছনে বৃহত্তর কৌশলগত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এমনতর হওয়া উচিত: প্রথমত, চিন ও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে এবং তাদের কর্মকাণ্ডও যে অবৈধ, তা তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত, ভারতের জাতীয় ও নিরাপত্তার স্বার্থে আঘাত করে এমন কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে চিন ও পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা। তৃতীয়ত, চিন ও পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের জবাব দিতে বাধ্য করা এবং আন্তর্জাতিক আদালত-সহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে তাদের অবৈধ কাজের জন্য জবাবদিহি করার অনুমতি দেওয়া।

একই ভাবে ভারতের পূর্ব স্বাক্ষরিত সীমান্ত শান্তি চুক্তির অধীনস্থ একাধিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি লঙ্ঘন করার জন্য চিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া উচিত।

তবে আইনের সফল ব্যবহারের জন্য দু’টি বিষয় অপরিহার্য। প্রথমত, আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে বিশাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, যার অভাব ভারত বোধ করে, কারণ সাধারণ কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বিদেশি নীতির আখ্যান নির্ধারণ করেন। দ্বিতীয়ত, চিনের মতো প্রতিপক্ষকে সমস্ত ফোরামে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য একটি স্পষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির দরকার। এর জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আচরণে একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ভারতের কি তার জন্য প্রস্তুত?

মতামত লেখকের নিজস্ব।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.