বছরের পর বছর ধরে যাঁরা ভারতে পৌরসভাগুলির করুণ আর্থিক অবস্থা নিয়ে চর্চা করছেন, তাঁরা ধারাবাহিক ভাবে পৌরসংস্থাগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য উন্নত করার গুরুতর প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। শহরে স্থানীয় প্রশাসনগুলির (ইউ এল বি) পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই উপদেশগুলির কোনও সদর্থক ফলাফল পাওয়া যায়নি। যদিও জাতীয় জি ডি পি-র অনুপাত হিসেবে ইউ এল বি-তে আন্তঃসরকারি অর্থ স্থানান্তরের পরিমাণ বরাবরই কম ছিল (১৯৬০-র দশকে প্রায় ১ শতাংশ), এটি দশকের পর দশক ধরে ক্রমাগত নিম্নগামী থেকেছে এবং বর্তমানে এর পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ০.৪৫ শতাংশে। এর ফলে আমরা এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, যেখানে এক দিকে জাতীয় অর্থনীতিতে শহরগুলির অবদান ক্রমশ দৃঢ় ভাবে বৃদ্ধি পেলেও অন্য দিকে ইউ এল বি-গুলিতে কেন্দ্র এবং রাজ্যের অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং রাশিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ উক্ত দেশগুলিতে যথাক্রমে জাতীয় জি ডি পি-র ১৫, ৮, ৬.৯ এবং ৬.৫ শতাংশ অর্থ নাগরিক প্রশাসনগুলিতে দেওয়া হয়।
গত দশকে কেন্দ্রীয় আইনবিধির দু’টি নতুন অংশ ইউ এল বি-র জন্য প্রাণঘাতী বলে প্রমাণিত হয়। প্রথমটি ছিল রাইট টু ফেয়ার কমপেনসেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি ইন ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসেটেলমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৩ (আর এফ সি টি এল এ আর আর)। যেমনটা আর এফ সি টি এল এ আর আর নীতিটিতে বলা হয়েছে, ‘জমির মালিকদের ব্যাঘাত না ঘটানো… এবং যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির ন্যায্য ও যথার্থ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা… এবং এই ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এবং পুনর্স্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা এবং এই সব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যাতে উন্নয়নের অংশীদার হয়ে উঠতে পারেন, তা সুনিশ্চিত করা।’ আইনটি জমির মালিকদের প্রতি অত্যধিক সদয় বলে প্রমাণিত হলেও ইউ এল বি-র প্রতি নির্মমতার উদাহরণ তুলে ধরেছে। শহরগুলিতে অধিগৃহীত যে কোনও জমির জন্য পৌরসভাগুলিকে জমির মালিকদের বার্ষিক রেডি রেকনার রেট-এর দ্বিগুণ প্রদান করতে হয়। এই একটি মাত্র পদক্ষেপেই বেশির ভাগ জমি অধিগ্রহণই ইউ এল বি-র ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এর অর্থ হল, নগর উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত না হওয়া; উদ্যান, রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল এবং একগুচ্ছ অন্যান্য পৌর পরিষেবা সরকারি ক্ষেত্রে নির্মিত না হওয়া এবং প্রায় সমস্ত সামাজিক পরিকাঠামোই শহরে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষদের ধরাছোঁয়ার বাইরে গিয়ে বেসরকারি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকা। এই একটি মাত্র আইন শহরগুলির সামাজিক পরিকাঠামোর বেসরকারিকরণ এবং নগর উন্নয়নের দরিদ্র-বিরোধী অবস্থানকে উস্কে দিয়ে শহরগুলির ‘জীবনের গুণমান’-এর ধারণার উপর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
শহরগুলিতে অধিগৃহীত যে কোনও জমির জন্য পৌরসভাগুলিকে জমির মালিকদের বার্ষিক রেডি রেকনার রেট-এর দ্বিগুণ প্রদান করতে হয়।
ইউ এল বি-গুলির অর্থায়নের নিরিখে আর এফ সি টি এল এ আর আর-এর নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি ২০১৭ সালের ১ জুলাই চালু হওয়া পণ্য ও পরিষেবা কর (জি এস টি) পৌরসভার আর্থিক ক্ষেত্রে সর্বশেষ আঘাত হেনেছে। এটি পৌরসভার রাজস্ব উৎস যেমন অকট্রয়, প্রবেশ-কর এবং বিজ্ঞাপন করকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর ফলে ইউ এল বি-গুলি আগের তুলনায় আরও বেশি নগদ-সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৫ সালে যখন জি এস টি প্রণয়ন করা হচ্ছিল, তখন কেন্দ্রীয় নগর উন্নয়ন মন্ত্রক এই উদ্বেগগুলির কথাই তুলে ধরেছিল। তখন এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যে, রাজ্য এবং স্থানীয় সংস্থাগুলির মধ্যে জি এস টি রাজস্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য নিয়মগুলি এমন ভাবেই তৈরি করা উচিত যাতে একত্রিত কর ব্যবস্থার অধীনে ইউ এল বি-গুলি যে আর্থিক ক্ষতির শিকার হবে, সেগুলির জন্য যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়। জি এস টি-কে স্থানীয় প্রশাসনগুলির সশক্তিকরণের এক সুযোগে রূপান্তরিত করা যেতে পারত। তার পরিবর্তে, কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির মধ্যে সমস্ত জি এস টি আয় ভাগ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউ এল বি-গুলিকে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলস্বরূপ, স্থানীয় প্রশাসনগুলির সশক্তিকরণের জন্য সংবিধানের ৭৪তম সংশোধনী ধারার মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত পথে হাঁটা হয়েছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের কাছে ইউ এল বি-গুলির প্রতিনিধিত্ব করে, ভারত সরকারের আবাসন ও নগর বিষয়ক মন্ত্রক, পৌরসভাগুলিতে অর্থ প্রেরণের পরিমাণ কমপক্ষে ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি পৌর সম্পদের জন্য অনুদান যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করার অনুরোধ করেছে। ১৩তম অর্থ কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিজয় কেলকর ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উল্লম্ব ভারসাম্যহীনতাকেই তুলে ধরেছেন এবং তৃতীয় স্তরের (পৌর কর্পোরেশনগুলির) জন্য মোট জি এস টি-র এক ষষ্ঠাংশ বরাদ্দ করার পরামর্শ দিয়েছেন। এর পাশাপাশি একাধিক বিশ্লেষক সংবিধানের অধীনে স্থানীয় প্রশাসনগুলির জন্য রাজস্ব উৎসের একটি পৃথক তালিকা অন্তর্ভুক্তিকরণের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। ৭৪তম সাংবিধানিক সংশোধনী ধারার ১২তম শিডিউলে শহরে্র স্থানীয় প্রশাসনগুলির কাজের একটি পৃথক তালিকা প্রস্তাব করা হলেও সেই কাজগুলির বাস্তবায়নের জন্য একটি পৃথক পৌর-সম্পদ তালিকা প্রদান করা হয়নি।
আশ্চর্যজনক ভাবে, এই সংশোধনী ধারায় শহরের স্থানীয় প্রশাসনগুলির সশক্তিকরণের কথা বলা হলেও ভারতীয় সংবিধানের এমন একটি প্রবিধান সম্পর্কে কোনও উল্লেখ করা হয়নি যা তার ঔপনিবেশিক অতীতের ভার বহন করছে। ভারতীয় সংবিধানের ২৮৫তম অনুচ্ছেদে ভারত সরকারের অধীনস্থ সম্পদগুলিকে ইউ এল বি করের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে,
‘(১) ভারত সরকারের অধীনস্থ সকল সম্পত্তি, সংসদে অনুমোদিত আইনে অন্য কিছু বলা না-হলে, একটি রাজ্য বা রাজ্যের কোনও কর্তৃপক্ষ দ্বারা আরোপিত সমস্ত করের আওতা থেকে মুক্ত রাখা হবে।
(২) সংসদে কোনও আইন অনুমোদিত না হলে, (১) ধারার কোনও অংশই কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও সম্পত্তির উপরে রাজ্যের কোনও কর্তৃপক্ষ দ্বারা কর আরোপ করার বিষয়টিকে প্রতিহত করবে না, যদি সেই সম্পত্তি সংবিধান চালু হওয়ার ঠিক আগে করযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, এবং সেই কর সেই রাজ্যে বহাল থাকে।
সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, ভারত সরকার এবং তার সকল বিভাগ পরিষেবা কর দিতে বাধ্য থাকলেও সম্পত্তি কর দেবে না। ব্যক্তিগত মালিকদের উপর আরোপিত সম্পত্তি করের ৭৫, ৫০ এবং ৩৩.৩৩ শতাংশ পরিষেবা কর প্রদান করা হবে।
এই সাংবিধানিক প্রবিধানের নিরিখে ইউ এল বি-গুলিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সমস্ত সম্পত্তি থেকে সম্পত্তি-কর আদায় করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এমনকি ভারত সরকারের তরফে সম্পত্তিগুলির প্রেক্ষিতে পরিষেবা করও দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে। রাজকোট, আমদাবাদ, জামনগর এবং ভাদোদরার পৌর কর্পোরেশনগুলি এই অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। অবশেষে ২০০৯ সালে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের তরফে একটি আদেশ জারি করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, ভারত সরকার এবং তার সকল বিভাগ পরিষেবা কর দিতে বাধ্য থাকলেও সম্পত্তি কর দেবে না। ব্যক্তিগত মালিকদের উপর আরোপিত সম্পত্তি করের ৭৫, ৫০ এবং ৩৩.৩৩ শতাংশ পরিষেবা কর প্রদান করা হবে। ভারত সরকারের বিভাগগুলি দ্বারা ব্যবহৃত পরিষেবার মাত্রার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন হার প্রযোজ্য হবে৷ এই করগুলি কোনও অবস্থাতেই রাজ্য সরকারের সম্পত্তি দ্বারা প্রদত্ত করের চেয়ে বেশি হবে না। উপরন্তু ভারত সরকারের সম্পত্তিগুলির উপরে ধার্য রাজস্ব প্রদান না করলে তা পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া স্বরূপ ইউ এল বি-গুলি পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার মতো কোনও জবরদস্তিমূলক পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারবে না। পরিষেবা কর সংক্রান্ত সমস্ত সমস্যা একটি বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।
ইউ এল বি-গুলির নিয়ন্ত্রণ এবং দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা রাজ্য সরকারের সম্পত্তিগুলিও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। সম্পত্তি কর থেকে ছাড় পাওয়ার একই প্রবিধান রাজ্য সরকারের সম্পত্তিগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পত্তিগুলির মতোই রাজ্য সরকারের সম্পত্তিগুলিও উচ্চ ভর্তুকিযুক্ত পরিষেবা করের আওতায় পড়ে। নতুন প্রবিধানটি স্পষ্টতই জি এস টি চালু হওয়ার পরবর্তী সময়ে ইউ এল বি-গুলির প্রাপ্য করের ভাগে ভাগ বসিয়েছে।
শহরগুলিতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের সম্পত্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এবং এটি স্বাভাবিকও, কারণ শহরগুলি হল সেই কেন্দ্র যেখানে জাতীয় অর্থনীতি কেন্দ্রীভূত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মুম্বইতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের অধীনস্থ ৪০০০টিরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে। এই সম্পত্তিগুলির প্রত্যেকটিরই গড়ে প্রায় ৫০০টি করে বিভাগ রয়েছে। যদি এগুলিকে সাধারণ ভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো মূল্যায়ন করা হয়, তা হলে এগুলি থেকে বর্তমানে শহরের মোট চাহিদা অর্থাৎ ৬০০০ কোটি টাকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উঠে আসবে। দেশের ইউ এল বি-গুলির উপর আরোপিত ভারতীয় সংবিধানের ২৮৫তম অনুচ্ছেদের প্রবিধানের নেতিবাচক প্রভাবের নিরিখে ধারাটিকে বাতিল করা প্রয়োজন। সরকারের জন্য উচ্চ ভর্তুকির হার শহরগুলি নির্বাহ করতে পারে না এবং নির্বাহ করতে পারে, এমন আশা করাও উচিত নয়। ঠিক যেমন পৌরসভাগুলিকে সমস্ত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের কর দিতে হয়, তেমনই কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের সম্পত্তিগুলিকে স্থানীয় কর দিতে হবে। যতক্ষণ না সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা বাতিল হচ্ছে, সমগুরুত্ব প্রদানের মূল সুর বজায় রেখে, ততদিন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলিকে পরিষেবা কর হিসেবে ইউ এল বি-কে সম্পত্তি করের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করার বিষয়টি চালু থাকা উচিত। সমগ্র দেশকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে যে, তহবিল ছাড়াই নির্দেশের বাস্তবায়ন এবং প্রত্যাশামাফিক গুণমানসম্পন্ন জীবনের দায়ভার শুধু শহরগুলির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। যে সমস্ত রাজ্যে এই শহরগুলি অবস্থিত, সেখানকার নাগরিকরা পরিষেবার গুণমানে ক্রমাবনতির সম্মুখীন হতে পারেন।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.