ক্রিপ্টোকারেন্সি বিপ্লব তার নিজস্ব উন্মাদনারই শিকার হয়েছে। এ বছর মে মাসে ‘স্টেবলকয়েন’ হিসাবে অনুমিত টেরা ইউএসডি-এর পতন বাজারমূল্যে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুছে দেয় এবং ক্রিপ্টো পরিসরে এর জেরে আরও ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়। সাম্প্রতিকতম সঙ্কটটি হল এফটিএক্স-এর পতন – যা একটি প্রধান বৈশ্বিক ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ – যে ঘটনা সমগ্র বাস্তুতন্ত্র জুড়ে একের পর এক দেউলিয়া ঘোষণার সূচনা করেছে। “এফটিএক্স বিপর্যয়ের সঙ্কেতগুলি ক্রিপ্টোর ‘উদ্দাম পশ্চিমী’ দিনগুলির সমাপ্তির সূচনা করেছে”, এমনটাই একটি শিরোনামে উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিকতম সঙ্কটটি হল এফটিএক্স–এর পতন – যা একটি প্রধান বৈশ্বিক ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ – যে ঘটনা সমগ্র বাস্তুতন্ত্র জুড়ে একের পর এক দেউলিয়া ঘোষণার সূচনা করেছে।
যে নিয়ন্ত্রকরা ক্রিপ্টোকারেন্সিকে নিষিদ্ধ অথবা সীমাবদ্ধ করেছিলেন, এফটিএক্স-এর পতন তাঁদের সিদ্ধান্তকেই মান্যতা দিয়েছে। সেই সঙ্গে এই ঘটনা ভারতের সদ্যোজাত ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারের কফিনে শেষ পেরেকটিও পুঁতে দিল। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সির পতনগুলি শুধু মাত্র একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধকতাই নয়। ২০১৮ সালে বিটকয়েন পতনের ফলে ‘ক্রিপ্টো বুদ্বুদ ফেটে গেল’ বলে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু সদ্য ২০২১ সালের নভেম্বরে বিটকয়েনের মূল্য সর্বকালীন শীর্ষে পৌঁছেছিল। ক্রিপ্টো কয়েন প্রায়শই ‘বৈধতা’ হারিয়ে ফেলে। কারণ সেগুলি তাদের নির্মাতাদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয় অথবা যথেষ্ট পরিমাণ অর্জনে ব্যর্থ হয়৷ এ কথা প্রাথমিক বছরগুলির ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য, যখন ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে এ হেন বহু মুদ্রার উত্থান সহজাত ভাবেই ব্যর্থ হয়েছিল।
ক্রিপ্টো পরিসর বর্তমানে যদিও দীর্ঘ শৈত্যের সম্মুখীন।
সঙ্কটে ক্রিপ্টো
এই সঙ্কটের নেপথ্যে প্রথম কারণ হল দুর্নীতির পরিমাণ বৃদ্ধি: ২০২১ সালে অবৈধ বলে ঘোষিত ৬৮টি ক্রিপ্টো কয়েনের মধ্যে ৩৫টিই ছিল দুর্নীতির শিকার বা ‘জোক’ কয়েন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন জানিয়েছে যে, সোশ্যাল মিডিয়া ক্রিপ্টো বিনিয়োগ কেলেঙ্কারির কারণে ২০২১ সালে ৬৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসান হয়েছে। ভারতে স্ক্যামার বা দুর্নীতিকারীরা একটি জাল ক্রিপ্টো মুদ্রায় আনুমানিক ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যে মোট ১৪০০ জনকে প্রতারণা করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ ভি গ্লোবালের নির্বাহীদের ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জালিয়াতির জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। দুর্নীতিকারীরা প্রায়শই কোনও ভুক্তভোগীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তহবিল আর এক জনকে অর্থ প্রদানের কাজে ব্যবহার করে, ফেরত-লাভের বিভ্রম তৈরি করে এবং তাদের সঞ্চয়কে আরও বেশি করে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করে। এই অপরাধীদের মধ্যে অনেকেই ক্রিপ্টোকে ঘিরে প্রচার এবং দ্রুত অর্থের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা ওয়েব ৩.০ এবং তার অন্তর্নিহিত প্রযুক্তিগুলি সম্পর্কে তুলনামূলক ভাবে ভাসা-ভাসা ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্লকচেনের ধারণা (যা ক্রিপ্টোকারেন্সির পূর্ববর্তী) মার্জিত এবং যৌক্তিক ভাবে এটির ভিত্তিতে নির্মিত জিনিসগুলি সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করার জন্য যথেষ্ট আকর্ষণীয়, যেমন ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং এনএফটি।
কয়েক জন ভারতীয় আর্থিক বিশেষজ্ঞ ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সতর্কতার প্রশংসা করছেন।
দ্বিতীয় কারণটি হল আস্থার সঙ্কট। পতন হওয়ার আগে এফটিএক্স অল্প সময়ের জন্য ভবিষ্যতের ক্রিপ্টো বাজারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এক্সচেঞ্জ ছিল। এর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সফটব্যাঙ্ক, সেকোইয়া ক্যাপিটাল এবং টেমাসেক। পতনের প্রভাব প্রাথমিক ভাবে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের মতো বাজারে পড়েছে, যার মধ্যে সিঙ্গাপুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে আসা ক্রিপ্টো সংস্থাগুলির একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে৷ উচ্চ পর্যায়ের ক্রিপ্টো সঙ্কটের এই ঘটনাপ্রবাহের ফলে দেশগুলিও তাদের ক্রিপ্টো বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে। ‘বিশ্বস্ত’ এক্সচেঞ্জগুলি ব্যর্থ হলে স্বতন্ত্র বিনিয়োগকারীদের যাওয়ার জায়গা কোথায়? সুবিশাল তহবিলগুলি ব্যর্থ বিনিয়োগ হিসাবে এই ক্ষতিগুলিকে সহজ ভাবে মোকাবিলা করলেও, যে ব্যক্তিরা তাঁদের জীবন সঞ্চয় ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা কোথায় যাবেন? রাতারাতি কোটিপতি হওয়া মানুষদের গল্প এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈপ্লবিক প্রকৃতি সম্পর্কে ফুলিয়ে-তোলা প্রত্যাশা – যেমন ক্রিপ্টো মতপ্রচারকরা বলে থাকে – সমস্যাটির মূল সার: ক্রিপ্টোকারেন্সির পতন সম্ভবত সেটির নিজস্ব বৃহত্তম প্রচারকদের দ্বারা ছড়ানো গুজবের ফলেই উদ্ভূত। এ ব্যাপারে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, কয়েক জন ভারতীয় আর্থিক বিশেষজ্ঞ ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সতর্কতার প্রশংসা করছেন। আরও বিস্তৃত ভাবে বললে ক্রিপ্টো বাস্তুতন্ত্রের ক্রমাগত ব্যর্থতার নেপথ্যে রয়েছে টেকল্যাশ, বিশেষ করে বৃহদায়তন প্রযুক্তি সংস্থা এবং সাধারণ ভাবে প্রযুক্তি সমাধান সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সংশয় এবং নেতিবাচক মনোভাব। ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলি নিয়ে মিডিয়া কভারেজের স্বরে পরিবর্তন টেকল্যাশ প্রবণতাকে অনুসরণ করেছে এবং কিছু উপায়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণীর সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিটকয়েনের উপর একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ক্রিপ্টো-সম্পর্কিত অপরাধ এবং ক্রিপ্টো-প্রশাসন সংবাদ বিটকয়েনের দামের উপর একটি পরিসংখ্যানগত ভাবে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তবে স্বল্পমেয়াদে এই বাস্তুতন্ত্রের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পতন এবং কেলেঙ্কারির কারণে সৃষ্ট আস্থার সঙ্কট ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলিকে পুনরায় তাদের মতপ্রচারকদের (পড়ুন প্রযুক্তি–কর্তা) পরিসরে ঠেলে দেবে এবং নিয়ন্ত্রণ ও কেন্দ্রীকরণকে বৈধতা দেবে।
ক্রিপ্টোর শৈত্য ঘুচে গিয়ে নতুন বসন্তের সূচনা হবে কিনা, তা নিয়ে এখনও সংশয় রয়েছে। তবে স্বল্পমেয়াদে এই বাস্তুতন্ত্রের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পতন এবং কেলেঙ্কারির কারণে সৃষ্ট আস্থার সঙ্কট ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলিকে পুনরায় তাদের মতপ্রচারকদের (পড়ুন প্রযুক্তি-কর্তা) পরিসরে ঠেলে দেবে এবং নিয়ন্ত্রণ ও কেন্দ্রীকরণকে বৈধতা দেবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.