এই প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এ।
ইরান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক সম্প্রতি অভূতপূর্ব ধাক্কা খেয়েছে। ১৬ জানুয়ারি ইরান পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের পাঞ্জগুরে তাদের লুকিয়ে থাকা জইশ আল আদল গোষ্ঠীর উপর ‘ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা’ শুরু করে এবং এর আগে ইরানের অভ্যন্তরেও হামলা চালিয়েছিল। তার পরবর্তী দিনগুলি দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির সাক্ষী থেকেছে এবং পাকিস্তানের তরফে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানোর পরে অবশেষে ডি-এস্কেলেশন বা যুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস করার আহ্বান জানানো হয়। ২২ জানুয়ারি উভয় পক্ষই বিদেশ মন্ত্রকের মধ্যে টেলিফোনে কথোপকথনের পর সেই সপ্তাহের শেষে নিজেদের রাষ্ট্রদূতদের তাঁদের নিজ নিজ পদে ফিরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে। পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী তার ইরানি প্রতিপক্ষ হোসেন আমির-আব্দুল্লাহিয়ানকে জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে পাকিস্তান সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান। উভয় দেশই পারস্পরিক আস্থা প্রদর্শন ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সাময়িক সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করতে এবং যে কোনও রকম উত্তেজনা প্রশমিত করতে যোগাযোগের পূর্ব-বিদ্যমান মাধ্যম ব্যবহার করতে সম্মত হন। দুই পক্ষের স্বাভাবিক অবস্থানে প্রত্যাবর্তন উভয় পক্ষের তরফে সতর্কতাকেই দর্শায়, যাতে সঙ্কট আর বাড়তে না পারে এবং সংঘাত নতুন করে আর দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্বে না পরিণত হয়।
উভয় দেশই পারস্পরিক আস্থা প্রদর্শন ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সাময়িক সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করতে এবং যে কোনও রকমের উত্তেজনা প্রশমিত করতে যোগাযোগের পূর্ব-বিদ্যমান মাধ্যম ব্যবহার করতে সম্মত হন।
হামলাগুলিকে তার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে লক্ষ্য করে একটি ‘বেআইনি’ এবং ‘অপ্ররোচিত’ কাজ বলে মনে করে পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া জানাতে নিজেদের সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেছে। প্রতিবেশ অঞ্চলে একটি নতুন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করলে ইসলামাবাদ প্রথমে তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে ও ইরানি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে দেয় এবং উভয় পক্ষের মধ্যে আসন্ন উচ্চ-পর্যায়ের সমস্ত বৈঠক স্থগিত করে দেয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট এবং বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির ঘাঁটিতে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়, যেটিকে পাকিস্তান আবার ‘একটি গোয়েন্দামূলক অভিযান’ বলে অভিহিত করেছে। এই ‘টিট-ফর-ট্যাট স্ট্রাইক’ বা ‘হামলা ও পালটা হামলার কৌশল’ উদ্বেগ বৃদ্ধি করেছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে উপনীত হতে পারে, যেখান থেকে আর সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ সম্ভব নয়। তাই দুই দেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের উপর জোর দেওয়ার পরেই ‘ডি-এস্কেলেশন’ বা ‘যুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস’ করার আহ্বান জানানো হয়।
ইরান ও পাকিস্তানের সীমান্তে এমন গোষ্ঠীরা এসে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে, যাদের অন্য দেশের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব রয়েছে। দুই দেশের সীমান্তে কয়েক বছর ধরে একাধিক সংঘর্ষ ও আন্তঃসীমান্ত হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে পাকিস্তানের জন্য সাম্প্রতিক হামলা প্রতিকূলতম সময়ে ঘটেছে। গত কয়েক বছরে ইসলামাবাদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে চলেছে এবং এই অবনমনের কোনও অন্ত নেই। ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত প্রতীকের উপর হামলা, দেশের দ্রুত অবনতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ এবং তা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর অক্ষমতা, জাতীয় নির্বাচনে বিলম্ব… সব কিছুই পাকিস্তানকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। হামলার আগেও ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনের সফল সমাপ্তি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তার পেশীশক্তিকে সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে এবং শেষ পর্যন্ত সংযত থাকাই শ্রেয় মনে করেছে।
এ ভাবে হামলাগুলি যে বার্তা দিতে চেয়েছে তা হল: অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও নিজের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ হলে পাকিস্তান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পিছপা হবে না।
দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার মাঝেই সমান্তরাল ভাবে টিটিপি দ্বারা উত্থাপিত চ্যালেঞ্জগুলির মাঝে পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। একটি শক্তিশালী এবং সিদ্ধান্তমূলক পাল্টা আক্রমণ হানার ব্যর্থতা দেশের মর্যাদাকে আরও ক্ষুণ্ণ করবে। এটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীগুলিকে তাদের আক্রমণ বৃদ্ধি করতে উত্সাহ জোগাবে। এ ভাবে হামলাগুলি যে বার্তা দিতে চেয়েছে তা হল: অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও নিজের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হলে পাকিস্তান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পিছপা হবে না। দেশের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য শীর্ষ বেসামরিক ও সামরিক নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন এবং ‘পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদার, সুকৌশলী এবং যথার্থ প্রতিক্রিয়া’র প্রশংসা করেছিলেন। তবে এ কথা অস্বীকার করলে চলবে না, পেশী শক্তি প্রদর্শনের ঊর্ধ্বে উঠে আঘাত হানার মতো বিকল্প ইসলামাবাদের কাছে প্রায় নেই বললেই চলে।
আফগানিস্তানে তালিবানের প্রত্যাবর্তনের পর থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বহুল আলোচিত কৌশলগত গভীরতা অর্জনের আশা চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আফগান তালিবানের একটি আদর্শগত শাখা টিটিপি পাকিস্তানে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে এবং দেশটির নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং বেসামরিক নাগরিকদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং বেলুচিস্তান উভয় প্রদেশেই প্রায় প্রতিদিনই হামলার ঘটনা ঘটে। আফগান তালিবান গোষ্ঠীকে সংযত করতে এবং যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করার জন্য ইসলামাবাদের প্রচেষ্টায় কেউ কর্ণপাত করেনি।
তালিবান দাবি করেছে যে, টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও গোষ্ঠীটির উপর তালিবানের আদৌ কোনও প্রভাব নেই। তবে টিটিপি-র প্রতি আফগান তালিবানের সমর্থনের কথা বিবেচনা করে শেষোক্ত বিবৃতিটি সত্য না হলেও গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে তালিবানের অনীহা দর্শায় যে, কী ভাবে পাকিস্তানের আঞ্চলিক প্রভাবের জন্য সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে সমর্থন ও মদত জোগানোর নীতি ক্রমশ ব্যুমেরাং হয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকেই উস্কে দিচ্ছে। তালিবানকে সমর্থন জোগানোর সময় ইসলামিক এমিরাতের সঙ্গে পাকিস্তানের যে সম্পর্ক ছিল, সেই সমীকরণ এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। দেশের পূর্ব প্রান্তের প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক এবং ভারতের সঙ্গে এক অচলাবস্থা – যে অচলাবস্থা ২০১৯ সাল থেকে ‘স্তব্ধ’ হয়ে আছে - ইতিমধ্যেই দেশটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। জইশ আল আদল গোষ্ঠীর উপর ইরানের হামলাও ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সিস্তান বেলুচিস্তান প্রদেশে একটি পুলিশ স্টেশনে গোষ্ঠীটির হামলার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, যেখানে ১১ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হন। ইরানে হামলার পর ভারতও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স বা শূন্য-সহনশীলতার নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং ভারত ‘আত্মরক্ষা’র জন্য কোনও দেশের তরফে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি সম্পর্ক অবগত। এর পাশাপাশি ভারত সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলিকে পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কে ইরানের প্রকৃত উদ্বেগকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার প্রক্সি নেটওয়ার্ক এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে বস্তুগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান বন্ধ করার আহ্বান সত্ত্বেও পাকিস্তান ক্রমাগত ভাবে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যে ব্রতী বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে নিষ্পত্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলি পাকিস্তানের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু ইরানের হামলার পর পাকিস্তান এই সমগ্র অঞ্চলটিতে আরও বেশি করে একা হয়ে পড়েছে, যে একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতা আসলে স্ব-আরোপিত এবং দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তানের জন্যই গুরুতর চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।
তালিবানকে সমর্থন জোগানোর সময় ইসলামিক এমিরাতের সঙ্গে পাকিস্তানের যে সম্পর্ক ছিল, সেই সমীকরণ এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে।
আক্রমণের মুখে পড়লে পাকিস্তান তার শক্তি প্রদর্শন এবং আক্রমণের মুখে তার প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিলেও নিজের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তা অবস্থার দরুন কোনও রকম সংঘাত চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই। পশ্চিম এশিয়ায় সঙ্কট নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অব্যাহত থাকায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সংঘাতের নতুন সীমান্তের উত্থানের সম্ভাবনা নিয়ে শঙ্কিত। পাকিস্তান ও ইরান উভয়ই অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ এবং একটি প্রতিকূল বাহ্যিক পরিবেশের মাঝে জর্জরিত থাকার দরুন কোনও পক্ষেরই আর পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আগ্রহ নেই। কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতাবস্থায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্নিহিত সমস্যা – অর্থাৎ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বিস্তার - ইসলামাবাদকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে এবং দেশটির জন্য তার জটিলতাকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.