Image Source: Getty
শ্রীলঙ্কায় ২০২৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচন দেশটির ইতিহাসে একটি পুনঃসংজ্ঞায়িত মুহূর্ত নিঃসন্দেহে। জনতা বিমুক্তি পেরামুনার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার জোট - যা জাতিকা জনা বালাওয়েগয়া (জেভিপি-এনপিপি) নামেও পরিচিত – পার্লামেন্টে ছয় ভাগের মধ্যে পাঁচ ভাগ আসনে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এবং সুপ্রতিষ্ঠিত জাতীয়, জাতিগত ও ধর্মীয় দলগুলিকে প্রায় দুরমুশ করে ছেড়েছে (দ্রষ্টব্য সারণি ১)। চিরাচরিত ভাবে মাত্র ৩ শতাংশ ভোটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা দলটি এ বার ৬২ শতাংশের বেশি ভোটারের সমর্থন কুড়িয়েছে। ৬৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে দেশের এ বারের জনমত অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশিই ঐক্যবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। অনেক সিংহলি, তামিল, মুসলিম ও খ্রিস্টান ভোটার এখন প্রশাসনের কার্যকলাপে জোটের সামান্য অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও জেভিপি-এনপিপি-র উপরেই নিজেদের আশা রাখছেন। এই সব কিছুই বোঝায় যে, দেশ এ বার পরিবর্তন চায় এবং জেভিপি-এনপিপি সম্পর্কে প্রাথমিক দ্বিধা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ এখন নতুন ব্যবস্থাকে সুযোগ দিতে ইচ্ছুক। দেশীয় রাজনীতিতে এই পরিবর্তন ভারতের উপরেও প্রভাব ফেলবে।
সারণি ১. পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল
দল
|
মোট সাংসদের তালিকা (সদস্য ও জাতীয় তালিকা-সহ)
|
শতাংশ
|
জাতিকা জনা বালাওয়েগয়া (জেভিপি-এনপিপি)
|
১৫৯
|
৬১.৫৬%
|
সমাগি জনা বালাওয়েগাতা (এসজিবি)
|
৪০
|
১৭.৬৬%
|
ইলানকাই তামিল আরাসু কাড়চি (আইটিএকে)
|
৮
|
২.৩%
|
নিউ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)
|
৫
|
৪.৪৯%
|
শ্রীলঙ্কা পড়ুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি)
|
৩
|
৩.১৪%
|
শ্রীলঙ্কা মুসলিম কংগ্রেস (এসএলএমসি)
|
৩
|
০.৭৮%
|
সর্বজন বলয় (এসবি)
|
১
|
১.৬%
|
ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি)
|
১
|
০.৫৯%
|
ডেমোক্র্যাটিক তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (ডিটিএনএ)
|
১
|
০.৫৯%
|
অল সিলন তামিল কংগ্রেস (এসিটিসি)
|
১
|
০.৩৬%
|
অল সিলন মাক্কাল কংগ্রেস (এসিএমসি)
|
১
|
০.৩০%
|
স্বতন্ত্র – জাফনা
|
১
|
০.২৫%
|
শ্রীলঙ্কা লেবার পার্টি (এসএলএলপি)
|
১
|
০.১৬%
|
মোট
|
২২৫
|
-
|
সূত্র: শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশন
জেভিপি-এনপিপির ক্ষমতায় উত্থান
জেভিপি-এনপিপি জোটের ক্ষমতায় উত্থান শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে জড়িত। অর্থনৈতিক অসুবিধা ও অপশাসনের কারণে শ্রীলঙ্কার জনগণ প্রথাগত অভিজাতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং আরাগল্যা আন্দোলনের মাধ্যমে পদ্ধতিগত সংস্কারের দাবি জানায়। এই প্রেক্ষাপটে অনুরা দিসানায়েকের (জেভিপি-এনপিপি-র) অভিজাতবাদ, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদের এমন প্রার্থী হিসাবে তুলে ধরেছে, যিনি সংস্কারের সূচনা করতে পারেন, ব্যবস্থার মধ্য থেকে দুর্নীতির অবসান ঘটাতে পারেন এবং সর্বাগ্রে স্বচ্ছতা ও সুশাসন ফিরিয়ে আনতে পারেন।
অর্থনৈতিক অসুবিধা ও অপশাসনের কারণে শ্রীলঙ্কার জনগণ প্রথাগত অভিজাতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং আরাগল্যা আন্দোলনের মাধ্যমে পদ্ধতিগত সংস্কারের দাবি জানায়।
জেভিপি-এনপিপি-র সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে ক্ষমতার হস্তান্তর, প্রেসিডেন্সি ব্যবস্থার বিলুপ্তি, একটি নতুন সংবিধান গ্রহণ এবং দীর্ঘ বিলম্বিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান-সহ বেশ কিছু জনদরদী প্রতিশ্রুতি। জোটটি জাতীয় অর্থনীতির একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য পুনর্বণ্টনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি বেতন সংশোধন, জ্বালানি ও অন্যান্য খরচ হ্রাস, সীমিত বিনিয়োগ, শুল্কে ছাড় এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহণ ও খাদ্য নিরাপত্তায় জনসাধারণের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছে। এই কারণগুলিই ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনুরা দিসানায়েকের বিজয়ে অবদান রেখেছিল, যা তাঁর দলের জন্য পার্লামেন্টে অপ্রতিরোধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করেছিল।
প্রসঙ্গ তামিল
এই নির্বাচনের ফলাফল তামিলদের ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের উপরেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথম বারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ তামিল সম্প্রদায় তাদের আঞ্চলিক ও জাতিগত দলগুলির চাইতেও একটি মূলধারার দলকে প্রাধান্য দিয়েছে। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে - যেখানে শ্রীলঙ্কার তামিলরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় - জেভিপি-এনপিপি ২৮টি আসনের মধ্যে ১২টির বেশি আসনে জয়লাভ করেছে। জেভিপি-এনপিপি আঞ্চলিক দল ইলানকাই তামিল আরাসু কাড়চি (আইটিএকে) থেকে অনেকটাই এগিয়ে। কারণ আইটিএকে মাত্র সাতটি আসন জিতেছে (দ্রষ্টব্য সারণি ২)। এটি তামিল রাজনীতিতে বিভাজনেরই ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ, পাঁচটি তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা থেকে ২০০০ জনেরও বেশি প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের সঙ্গে প্রধান তামিল পার্টি আইটিএকে-র বিচ্ছেদও এই বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই অভ্যন্তরীণ লড়াই ও ঐক্যের অভাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হল অভিজাতরা তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার আঁচ পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলস্বরূপ, অতীতে পার্টির যুক্তরাষ্ট্রীয় বিরোধী অবস্থান ও তামিল প্রসঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়ে স্পষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলের বেশ কিছু ভোটার জেভিপি-এনপিপি-কেই ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সারণি ২. তামিল প্রদেশের আসন
দল
|
জাফনা
|
ভান্নি
|
বাত্তিকালোয়া
|
ত্রিঙ্কোমালি
|
দিগামাদুল্লা
|
জেভিপি-এনপিপি
|
৩
|
২
|
১
|
২
|
৪
|
আইটিএকে
|
১
|
১
|
৩
|
১
|
১
|
এসিটিসি
|
১
|
-
|
-
|
-
|
-
|
স্বতন্ত্র
|
১
|
-
|
-
|
-
|
-
|
এসজেবি
|
-
|
১
|
-
|
১
|
-
|
ডিটিএনটি
|
-
|
১
|
-
|
-
|
-
|
এসএলএলপি
|
-
|
১
|
-
|
-
|
-
|
এসএলএমসি
|
-
|
-
|
১
|
-
|
১
|
এসিএমসি
|
-
|
-
|
-
|
-
|
১
|
প্রাপ্ত আসন
|
৬
|
৬
|
৫
|
৪
|
৭
|
সূত্র: শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশন
ভারতের জন্য তামিল অভিজাতদের ক্ষয়প্রাপ্ত বৈধতা নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। চিরাচরিত ভাবে শ্রীলঙ্কার তামিল অভিজাতরা তামিল জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা করেছেন। ভারত-সমর্থিত ১৩তম সংশোধনীতে অসন্তুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও - যা কেন্দ্রের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছে - তাঁরা দিল্লিকে এর বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছেন। তাঁরা নিজেদের সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করতে এবং সিংহলি জাতীয়তাবাদী দলগুলির ব্যাপক চাপ এড়াতে প্রায়ই দিল্লির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। এই প্রদেশগুলিতে জেভিপি-এনপিপি-র প্রবেশের ফলে বিষয়টি ঝুঁকির মুখে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। অন্য যে কোনও মূলধারার দলের মতোই জেভিপি-এনপিপি ১৩তম সংশোধনী সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করতে দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ তারা এটিকে শ্রীলঙ্কার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে মনে করে। তা সত্ত্বেও, অনুরার একটি নতুন সংবিধানের আশ্বাস, অনেক বিলম্বিত প্রাদেশিক নির্বাচন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচারের জন্য চাপ দেওয়া (যদিও তিনি শাস্তি দিতে অনাগ্রহীই ছিলেন) দর্শায় যে, তিনি ক্ষমতার হস্তান্তর, তামিলদের জন্য আরও রাজনৈতিক স্থান এবং ১৩তম সংশোধনীর বাইরে কোনও সমাধান খুঁজছেন। তাঁর প্রতি দ্বীপদেশব্যাপী জনমত শুধুমাত্র ভারতের বিরুদ্ধে তাঁর দর কষাকষি বৃদ্ধি করবে।
অর্থনীতি ও সংযোগ প্রকল্প
ভারত ও শ্রীলঙ্কার জন্য প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ হবে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন ভারসাম্য খুঁজে বের করা। শ্রীলঙ্কায় আর্থিক সঙ্কটের পর থেকে ভারত ঋণ স্থগিত, মুদ্রার অদলবদল, অনুদান, স্বল্পমেয়া্দি ঋণ সুবিধা, মানবিক ত্রাণ ও ঋণের মাধ্যমে দেশটিকে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে সাহায্য করেছে। রনিল বিক্রমসিংহ প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ভারত ও শ্রীলঙ্কা সংযোগ ও অর্থনৈতিক সমন্বিতকরণকে উন্নত করার জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গিমূলক নথিও প্রকাশ করেছিল। দিল্লি ও কলম্বো বিমানবন্দর-সহ সামুদ্রিক বন্দরগুলির সংস্কার, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ও তেল শোধনাগারগুলিতে বিনিয়োগ এবং একটি পাওয়ার গ্রিড ও দ্বি-মুখী পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন স্থাপনের বিষয়েও তারা আলোচনা করেছে। উভয় দেশ একটি স্থল সেতুর সম্ভাব্যতা এবং ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট বা অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চুক্তি (ইটিসিএ) নিয়ে আলোচনা করেছে। এমনকি দুই দেশ ত্রিঙ্কোমালি অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একটি চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেছে। ভারতীয় সংস্থাগুলি শ্রীলঙ্কার লোকসানে ডুবতে থাকা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলির প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিল।
শ্রীলঙ্কায় আর্থিক সঙ্কটের পর থেকে ভারত ঋণ স্থগিত, মুদ্রার অদলবদল, অনুদান, স্বল্পমেয়াদি ঋণ সুবিধা, মানবিক ত্রাণ ও ঋণের মাধ্যমে দেশটিকে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে সাহায্য করেছে।
সঙ্কট-পরবর্তী শ্রীলঙ্কায় ভারতের সঙ্গে আরও ভাল ভাবে সংযোগ স্থাপনের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখা গিয়েছিল। জেভিপি-এনপিপি-সহ রাজনীতির কিছু অংশ আরও নিরীক্ষণ এবং ভারসাম্যের আহ্বান জানিয়েছে। স্বচ্ছতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতিতে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে এই সরকার সম্ভবত ভারতের সঙ্গে হতে চলা প্রকল্পগুলির বেশ কয়েকটি স্থগিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার এখন আদানি বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। আদানির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (ইউএস) ঘুষ সংক্রান্ত অভিযোগের প্রভাব অন্যান্য প্রকল্পের উপরেও পড়তে পারে। সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের বেসরকারিকরণের বিষয়েও পিছিয়ে গিয়েছে, যেখানে ভারতীয় সংস্থাগুলি এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছিল। এ ছাড়া এমন ইঙ্গিতও মিলেছে যে, সরকার একটি ভারতীয় ও একটি রুশ সংস্থাকে হাম্বানটোটা বিমানবন্দরের সহ-পরিচালনা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করতে আগ্রহী। এই পশ্চাদপসরণ ও প্রকল্পগুলির নতুন করে রাজনীতিকরণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও ভারতের ভূ-অর্থনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত আকাঙ্ক্ষাকে বাধা দেবে।
এই উচ্চ বাজির প্রেক্ষিতে এস জয়শঙ্করই ছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর শ্রীলঙ্কা সফরকারী প্রথম বিদেশমন্ত্রী। এর প্রত্যুত্তরে জানুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের কথা রয়েছে।
প্রসঙ্গ চিন
বেজিংও শ্রীলঙ্কার নতুন সরকারকে প্ররোচিত করতে আরও আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। বর্তমানে ঋণ দেওয়ার দরুন চিন শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে প্রায় ৬.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পায়। চিনও বুঝতে পারে যে, তারা নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে এগিয়ে নিতে পারে। তা সত্ত্বেও চিনের মধ্যে এ নিয়ে কিছুটা হলেও উদ্বেগ রয়েছে যে, জেভিপি-এনপিপি সরকার ঠিক তার পূর্বসূরির মতোই ভারতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। জেভিপি-এনপিপি-র ইশতেহারে ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগকে প্রশমিত করা এবং শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি ও প্রতিবেশীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও অনুরা অতীতে হাম্বানটোটা ও কলম্বো বন্দর-সহ দ্বীপদেশে চিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অস্বচ্ছ প্রকল্পগুলির সমালোচনা করেছেন। তিনি বিনিয়োগে আরও স্বচ্ছতা আনা এবং দুর্নীতি ও ঋণ সংক্রান্ত অপব্যবহারের তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই প্রতিশ্রুতিগুলি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের দরুন আরও শক্তিশালী হয়েছে। ফলে বিশেষ করে অভিজাতরা কী ভাবে বিষয়টি দেখে, মোকাবিলা করে এবং দুর্নীতি কী ভাবে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত ছিল… তার নিরিখে যে কোনও প্রকারের তদন্ত বেজিংয়ের জন্য অসুবিধার কারণ হবে। এ ভাবে বিনিয়োগ ও ঋণের বিষয়ে স্বচ্ছতার জন্য চাপ ভবিষ্যতের চিনা প্রকল্পগুলিকে প্রভাবিত করবে এবং অতীতের প্রকল্পগুলিকে আরও বেশি করে নিরীক্ষণের আওতায় আনবে।
চিন একাধিক বার শ্রীলঙ্কায় চিনা গবেষণা জাহাজ নোঙর করার উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল।
ফলস্বরূপ, চিন নতুন সরকারকে প্ররোচিত করেই চলেছে। অনুরার বিজয়ের পর শি জিনপিং তাঁকে একটি অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন এবং শ্রীলঙ্কা ও চিনের সম্পর্কের ‘স্থির ও দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতি’র উপর জোর দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে চিন সরকার বন্যাত্রাণের জন্য শ্রীলঙ্কায় এক লক্ষ মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই অঙ্ক এক মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের আর একটি অঙ্গীকারের সঙ্গে সমাপতিত হয়েছে। চিনা রাষ্ট্রদূত শুধু প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাই করেননি, তিনি ছিলেন সেই গুটিকয়েক মানুষদের মধ্যে অন্যতম যিনি পার্লামেন্টের নতুন স্পিকারকে অভ্যর্থনা জানান। এই উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকগুলিতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে সহযোগিতা এক ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না-র (সিপিসি) আন্তর্জাতিক বিভাগের তরফে একটি উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সফর ছাড়াও চিন শ্রীলঙ্কার উত্তরের প্রদেশে প্রবেশ করার বিষয়টি অব্যাহত রেখেছে।
চিনের জন্য এই সঙ্কেত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চিন সঠিক গতি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ববর্তী শাসনামলে চিন একাধিক বার শ্রীলঙ্কায় চিনা গবেষণা জাহাজ নোঙর করার উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। জানুয়ারি মাসে সেই সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে। একই ভাবে চিন উত্তর শ্রীলঙ্কায় নিজের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট যুঝছে। যাই হোক, স্থানীয় অংশীদাররা এখন এনপিপি-জেভিপি-র উপস্থিতির আলোকে খানিক ম্রিয়মান হয়ে পড়ায় এই অঞ্চলে বেজিংয়ের প্রবেশ আরও সহজ হয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়াও চিনও চায় যে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এ বার চূড়ান্ত হোক।
তা সত্ত্বেও, সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও জনপ্রিয়তা এবং নতুন রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ জটিলতা ভারত ও চিনের জন্য নতুন প্রশ্ন উস্কে দিয়েছে… তা সে ভূ-রাজনীতি, সংযোগ বা জাতিগত রাজনীতি, যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন। শ্রীলঙ্কার সরকার জনগণের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করবে এবং এই পরিবর্তনের সঙ্গে ভারত ও চিন কতটা মানিয়ে নিতে পারবে, তার উপরেই দ্বীপদেশটির সঙ্গে দুই মহাশক্তির সম্পর্কের ভাগ্য নির্ভর করবে।
আদিত্য গৌদারা শিবমূর্তি অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.