১৯৭৭ সালে শ্রীলঙ্কা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ যেটি তার অর্থনীতি উন্মুক্ত করে৷ ভারত অনেক পরে, ১৯৯১ সালে, তার অর্থনীতি বন্ধনমুক্ত করতে শুরু করেছিল৷ উদারীকরণের পর থেকে শ্রীলঙ্কা প্রায়শই আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের (আইএমএফ) কাছে সহায়তার জন্য গিয়েছে, এবং বর্তমানে তার ১৭তম আইএমএফ কর্মসূচি চলছে৷ ভারত কিন্তু তার অর্থনীতির উদারীকরণের পর আর আইএমএফ–এর কাছে যায়নি। স্বাধীনতার পর থেকে তার সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকট থেকে নিজেকে পুনরুদ্ধার করার সময় শ্রীলঙ্কাকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে নির্দেশনার জন্য ভারতের দিকে তাকাতে হবে, এবং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।
তামিলনাড়ু ও ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান
ভারত প্রতি বছর অর্থনৈতিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি। চিনের বিপরীতে এর একটি অনুকূল জনসংখ্যাগত লভ্যাংশও রয়েছে। একটি বার্ধক্যপূর্ণ বিশ্বে ভারতের একটি সুবিধা রয়েছে, এবং বিষয়টিকে পুঁজি করতে তাকে ভালভাবে প্রস্তুত দেখাচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, এবং জিডিপি–র পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি ২০৩৫ সালের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হতে চলেছে।
তামিলনাড়ু শুধু ভৌগোলিকভাবে শ্রীলঙ্কার নিকটতম ভারতীয় রাজ্য নয়, এটি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি ভাষাও ভাগ করে নেয়। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে অনেক কিছু অর্জন করতে পারে। ডেলয়েটের মতে, তামিলনাড়ুর অর্থনীতি ২০৩৪ সালের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হবে, যদি রাজ্যটি তার বর্তমান ১০ শতাংশ গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার ধরে রাখতে পারে। বর্তমানে তামিলনাড়ুর অর্থনীতি প্রায় পাকিস্তানের অর্থনীতির মতোই বড়, এবং যদি এটি ২০৩৪ সালের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পর তার দ্বি–সংখ্যার বৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে, তবে এটির এমন একটি অর্থনীতি থাকবে যা ২০৪০–এর দশকের প্রথম দিকে রাশিয়ার চেয়েও বড় হবে বলে অনুমান করা হয়। শ্রীলঙ্কা যদি তার কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে তার অনেক কিছু পাওয়ার আছে। তামিলনাড়ু হল অন্যতম শিল্পোন্নত রাজ্য, যেখানে ভারতের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কারখানা রয়েছে।
ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সংযুক্তির ফলে শ্রীলঙ্কার দিকে প্রযুক্তি হস্তান্তর, দক্ষতা স্থানান্তর ও বিনিয়োগ প্রবাহ হতে পারে। শ্রীলঙ্কার জিডিপি–র অর্ধেক তার পশ্চিম প্রদেশে, যেখানে শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার মাত্র এক–চতুর্থাংশের বাস। এটি অর্থনৈতিক উৎপাদন ও সম্পদের অসম বণ্টনকে তুলে ধরে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে একটি স্থলসেতু নিয়ে আলোচনা দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার দরিদ্র উত্তর অংশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার ফলে শ্রীলঙ্কার ওই অংশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে।
শ্রীলঙ্কা কীভাবে উপকৃত হবে
কলম্বোর বন্দরে ইতিমধ্যেই ভারতের বিনিয়োগ রয়েছে এবং শ্রীলঙ্কার ত্রিনকোমালি নিয়েও আগ্রহ রয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কারণ ভারতীয় সংস্থাগুলি লজিস্টিক হাব হিসাবে শ্রীলঙ্কাকে সম্ভাবনাময় হিসাবে দেখে। বৃহত্তর একীকরণ শ্রীলঙ্কাকে একটি লজিস্টিক হাবে রূপান্তরিত করতে পারে, কারণ বৈশ্বিক সংস্থাগুলি শ্রীলঙ্কাকে ভারতের প্রবেশদ্বার হিসাবে দেখবে৷ শ্রীলঙ্কা ও ভারতীয় শহরগুলির মধ্যে বর্ধিত বিমান সংযোগও একটি আঞ্চলিক বিমান ভ্রমণ হাব হিসাবে শ্রীলঙ্কার ভূমিকাকে উন্নীত করতে পারে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার জাতীয় বিমান সংস্থার লোকসান ছিল শ্রীলঙ্কার জিডিপি–র প্রায় ১ শতাংশ। এটি একটি বিস্ময়করভাবে উচ্চ পরিমাণ লোকসান, যা ছিল ২০২২–এর জন্য শ্রীলঙ্কার সমগ্র সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটের চেয়ে বেশি৷ যদি এয়ারলাইনটিকে ভারতের টাটা গ্রুপের মতো কৌশলগত খেলোয়াড়ের কাছে বিক্রি করা যায়, তাহলে কলম্বো একটি এয়ারলাইন হাব হতে পারে,এবং তা শ্রীলঙ্কার জন্য প্রচুর সুবিধা নিয়ে আসতে পারে৷
ভারতীয় বিদ্যুৎ বিশ্বের অন্যতম খরচ–সাশ্রয়ী। দুই দেশের জাতীয় বিদ্যুতের গ্রিড সংযুক্তি শ্রীলঙ্কাকে উপকৃত করতে পারে, কারণ এটি সস্তা মূল্যে তার শক্তির প্রয়োজনীয়তাগুলিকে সুরক্ষিত করতে সহায়তা করবে। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কা সফরের সময় এটি ইতিবাচকভাবে আলোচনা করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী শক্তির দাম ওঠানামার কারণে শ্রীলঙ্কা বিধ্বংসী প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। দেশটি ভারতকে শক্তি রপ্তানির বাজার হিসাবেও দেখতে পারে যদি সে তার শক্তির সম্ভাবনাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করতে পারে। বিশ্বব্যাঙ্ক বলেছে যে, শ্রীলঙ্কার সম্ভাব্য অফশোর বায়ু শক্তি তার চাহিদাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে, এবং যদি এটি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে এবং তার অফশোর বায়ু শক্তির সক্ষমতা বিকাশ করতে পারে, তবে এটি গ্রিডের মাধ্যমে ভারতে শক্তি রপ্তানি করতে পারে। এর ফলে শ্রীলঙ্কা অনেক প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। তামিলনাড়ু যেহেতু দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই রাজ্যটি শ্রীলঙ্কার অতিরিক্ত শক্তির বাজার হতে পারে যদি শ্রীলঙ্কা নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে পারে। নেপাল ও বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তাদের গ্রিড ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। ভারতীয় রাজ্য উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের সঙ্গে নেপালের গ্রিড সংযোগ উভয় দেশকে উপকৃত করেছে। এই উদাহরণ অনুসরণ করা শ্রীলঙ্কাকে শক্তির ঘাটতি থেকে রক্ষা করবে।
ভারত শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। শ্রীলঙ্কার সম্ভাবনা রয়েছে ভারতে রপ্তানি বাড়ানোর এবং ভারতের সঙ্গে বৃহৎ বাণিজ্য ঘাটতিতে ভারসাম্য আনার। ভারতের সঙ্গে বর্ধিত বাণিজ্য উদারীকরণের ফলে শ্রীলঙ্কার কিছু শিল্প নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে, কিন্তু এর ফলে শ্রীলঙ্কার সংস্থাগুলি লাভজনক ভারতীয় বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়াতে সক্ষম হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৭০০ মিলিয়নে উন্নীত হওয়া প্রত্যাশিত, ফলে অনেক শ্রীলঙ্কার সংস্থা বড় আয়তনের সুবিধাগুলি অর্জন করতে পারে। বর্তমানে তা সম্ভব নয়, কারণ শ্রীলঙ্কা একটি ছোট বাজার। একবার শ্রীলঙ্কার সংস্থাগুলি ভারতীয় বাজার ব্যবহার করে আয়তনের সুফল অর্জন করতে পারলে বাকি বিশ্বে রপ্তানি করার সময় তারা আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে।
ভারত ও শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চুক্তি (ইটিসিএ) উভয় দেশের পরিষেবা ক্ষেত্রের বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে। এটি অন্য ক্ষেত্রগুলির মধ্যে বাণিজ্য সুবিধা ও প্রযুক্তি সহযোগিতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে। যদিও শ্রীলঙ্কার কিছু অংশ এমন একটি বৃহত্তর প্রতিবেশীর কাছে তার বাজার উন্মুক্ত করা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছে যার বেসরকারি ক্ষেত্রের আয়তনগত সুবিধা উপলব্ধ রয়েছে, ইটিসিএ চুক্তি শ্রীলঙ্কাকে উপকৃত করবে৷ উল্লেখ্য, ভারত–শ্রীলঙ্কা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) থেকে শ্রীলঙ্কার রপ্তানির ৬০ শতাংশের বিপরীতে ভারতীয় রপ্তানির মাত্র ৫ শতাংশ চুক্তির সুবিধা গ্রহণ করছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে ইটিসিএ–র সঙ্গে এফটিএ বাড়ানোর ফলে শ্রীলঙ্কার জন্য আরও বেশি সুবিধা হবে।
ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক শ্রীলঙ্কায় বৃহত্তর ভারতীয় বিনিয়োগকে আকর্ষণ করতে পারে, কারণ ভারত হল শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) উৎসগুলির মধ্যে একটি৷ প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিংহের নতুন সরকারের আঞ্চলিক ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে (আরসিইপি) যোগদানের পরিকল্পনা এবং পরের বছর তাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি এফটিএ স্বাক্ষর করার পরিকল্পনার সঙ্গে শ্রীলঙ্কা বাণিজ্যের উদারীকরণ করতে চাইছে। এই সময় ভারতীয় সংস্থাগুলি শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি–কেন্দ্রিক এফডিআই–এর দিকে নজর দিতে পারে৷ এর ফলে শ্রীলঙ্কার মানুষের জন্য কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং প্রযুক্তি ও দক্ষতা স্থানান্তরও হবে।
শ্রীলঙ্কা বিশ্বের অন্যতম সুরক্ষা অর্থনীতির (প্রোটেক্টেড ইকনমি) দেশ। এই কারণে অনেক শিল্প দেশে খুব স্বাচ্ছন্দ ভোগ করে, যেমনটি বেশ কয়েকটি আভ্যন্তরমুখী দেশে দেখা যায়। কিন্তু এর অর্থ হল তারা কম উদ্ভাবনী এবং বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করতে অক্ষম, যার ফলে কম রপ্তানি হয়। ভারতের জন্য অর্থনীতি উন্মুক্ত করার ফলে যে সংস্থাগুলো প্রতিযোগিতায় অক্ষম তারা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সম্পদ নতুন শিল্প গড়ে তুলতে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা বিশ্ব বাজারে শ্রীলঙ্কাকে তুলনামূলক সুবিধা দেবে।
শ্রীলঙ্কার জন্য সামনের পথ
ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শ্রীলঙ্কার জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথ। গত বছর অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রমাণ করেছিল যে বিশ্বজুড়ে শ্রীলঙ্কার অনেক বন্ধু থাকতে পারে, কিন্তু ভারতের ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তাই শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য থেকে বাঁচিয়েছিল। ভারত সব সময়ই একটি নিকটবর্তী প্রতিবেশী থেকে যাবে, এবং রাজনৈতিকভাবে শ্রীলঙ্কার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভারতের সঙ্গেই থাকবে। সুতরাং, ভারতের সঙ্গে এর অর্থনীতিকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করাই অর্থবহ হবে।
তালাল রাফি একজন অর্থনীতিবিদ এবং ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.