হর্ন অফ আফ্রিকাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয় যখন মিশর, সোমালিয়া এবং ইরিত্রিয়ার নেতারা ২০২৪ সালের ১০ অক্টোবর ইরিত্রিয়ার রাজধানী আসমারায় একত্রিত হন। তাঁদের আলোচনা একটি জোট গঠনের উপর কেন্দ্রীভূত ছিল, যাতে একটি সম্মিলিত নিরাপত্তা কাঠামো বা ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই বৈঠকটি অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগ উত্থাপন করেছে।
২০২৪ সালের অগস্ট মাস থেকে মিশর সোমালিয়ার সঙ্গে একটি সামরিক সহযোগিতা ও গোয়েন্দা বিনিময় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং ইরিত্রিয়ার সঙ্গেও অনুরূপ নিরাপত্তা চুক্তি প্রত্যাশা করা যায়। বর্তমানে ইরিত্রিয়ার প্রেসিডেন্ট ইসাইয়াস আফওয়ারকি, মিশরের আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এবং সোমালিয়ার হাসান শেখ মোহামুদ এই ত্রিপাক্ষিক জোট নিয়ে আলোচনা করার জন্য প্রথম বারের মতো একত্রিত হওয়ার কারণে বৈঠকের ফলাফলগুলি এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিসরকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বদলে দিতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, হর্ন অফ আফ্রিকা এখন বেশ কিছু দিন ধরেই খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে, বিশেষ করে ইথিওপিয়ায় দু’বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের কারণে ছ’লক্ষ মানুষের প্রাণহানির খবর সকলের নজরে উঠে এসেছে। এ দিকে প্রতিবেশী সুদানে দুই জেনারেলের ক্ষমতার লড়াইয়ের ফলে দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ১০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা এই অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।
যখন এই অঞ্চলটি এই নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত, তখন আরও একটি উল্লেখযোগ্য উত্তেজনাকেও অস্বীকার করা যায় না এবং সেই সমস্যা এই অঞ্চলটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে যথেষ্ট। তা হল সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে ইথিওপিয়ার বিতর্কিত চুক্তির প্রতিক্রিয়া হিসাবে তৈরি উল্লেখযোগ্য ইথিওপিয়া-বিরোধী জোট। সোমালিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সোমালিল্যান্ড ১৯৯১ সালে সোমালিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
এই চুক্তিটি স্থলবেষ্টিত ইথিওপিয়াকে সোমালিল্যান্ডের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে বারবেরা বন্দর ব্যবহার করে লোহিত সাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার প্রদান করবে।
যাই হোক, চিনের আর একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল তাইওয়ানের ডি ফ্যাক্টো স্বীকৃতি সত্ত্বেও ২০২৪ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত অন্য কোনও দেশ সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেয়নি, কিন্তু হর্ন অফ আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশ ও আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশ ইথিওপিয়া সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে একটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তিটি স্থলবেষ্টিত ইথিওপিয়াকে সোমালিল্যান্ডের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে বারবেরা বন্দর ব্যবহার করে লোহিত সাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার প্রদান করবে।
চুক্তির পর থেকে সব কিছুই বদলে গিয়েছে। সোমালিয়া চুক্তিটির ব্যাপক নিন্দা করেছে। কারণ সোমালিয়া এই চুক্তিটিকে তার আঞ্চলিক অখণ্ডতার লঙ্ঘন বলেই মনে করে। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে মিশর এবং ইরিত্রিয়াও চুক্তিটির বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। চুক্তির প্রতিক্রিয়াগুলি দশ মাস পরেও অঞ্চল জুড়ে প্রতিফলিত হতে থাকে।
ইথিওপিয়াকে ঘিরে ফেলার জন্য ব্লু নীলের উপর গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম সংক্রান্ত মিশরের কৌশল - যার সঙ্গে মিশরের দীর্ঘস্থায়ী চাপানউতোরের সম্পর্ক রয়েছে – বেশ কার্যকর বলে মনে হচ্ছে। কায়রো বাঁধটিকে তার জল সরবরাহের জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকি বলে মনে করে। সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তিটি ইথিওপিয়াকে তার উপকূলে একটি নৌ সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে সক্ষম করতে পারে, যা ইরিত্রিয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ অর্থাৎ ইথিওপিয়ার শত্রুর কাছাকাছি একটি ইথিওপিয়ান নৌবহর পরিচালনার সম্ভাবনা সম্পর্কে উদ্বেগ বৃদ্ধি করতে পারে।
অতএব, ইথিওপিয়া-বিরোধী ত্রিপক্ষীয় গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই মিশরের জন্য একটি কূটনৈতিক বিজয়। যাইহোক, মিশরের নিরাপত্তা সহায়তা ব্যতীত, সোমালিয়া এবং ইরিত্রিয়া উভয়ই এই ব্যবস্থা থেকে সামান্য লাভ করতে পারে। সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ার মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা ইতিমধ্যে বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে, এই কৌশলগত পরিবর্তন সোমালিয়ার মধ্যে অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
গত দু’বছরে সোমালি ন্যাশনাল আর্মির অগ্রগতি ব্যাহত করার পর সোমালিয়ায় আল শাবাব আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ১২০০০ থেকে ১৩০০০ আল শাবাব যোদ্ধা এখন সোমালিয়ায় উপস্থিত হুতি জঙ্গিদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। মার্কিন অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেশে অস্ত্রের প্রবাহকে সীমিত করার পাশাপাশি আল শাবাব উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন অর্জনের জন্য ইরানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংযোগের উপর নির্ভর করছে। অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পেলে সোমালিয়ার পক্ষে বাইরের সমর্থন ছাড়া রাজধানী মোগাদিশুর বাইরে সোমালিল্যান্ড এবং অন্য অঞ্চলগুলিকে শাসন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
মার্কিন অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেশে অস্ত্রের প্রবাহকে সীমিত করার পাশাপাশি আল শাবাব উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন অর্জনের জন্য ইরানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংযোগের উপর নির্ভর করছে।
এ দিকে, ইরিত্রিয়া বরাবরের মতোই বিচ্ছিন্ন রয়ে গিয়েছে এবং নানাবিধ নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছে। উল্লিখিত চুক্তিটি হওয়ার দরুন ইথিওপিয়া সেই আলজিয়ার্স চুক্তি থেকে সরে আসতে পারে, যা দুই প্রতিবেশীকে সংঘাত থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। পরিবর্তে, ইরিত্রিয়ার প্রকৃত স্বার্থ হল তাদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী টাইগ্রেকে মোকাবিলা করতে ইথিওপিয়ান সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা। ইথিওপিয়ার উত্তরে অবস্থিত টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) ২০২০ সালের নভেম্বর মাস থেকে স্বায়ত্তশাসনের জন্য ইথিওপিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে একটি নৃশংস যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এবং এই যুদ্ধে ছ’লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ২০২২ সালে যুদ্ধ থেমে গেলেও প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের ঝুঁকির সামনে অরক্ষিত।
আর একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা না গেলেও এই আঞ্চলিক সারিবদ্ধতা সম্ভাব্য ঠান্ডা লড়াইয়ের সমশৈলীর প্রক্সি দ্বন্দ্ব সম্পর্কে উদ্বেগ উত্থাপন করে। অঞ্চলটি কূটনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বৃদ্ধির সাক্ষী থাকতে পারে, যা বাণিজ্যপথ এবং সামরিক জোটকে প্রভাবিত করতে পারে। যেহেতু এই অশান্তির পরিণতি আখেরে লোহিত সাগর ও তার বাইরের স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলবে, তাই বিশ্বশক্তির উচিত এই ঘটনাপ্রবাহের উপর নজর রাখা এবং নিজেদের উদ্বেগ সম্পর্কে কণ্ঠ তোলা।
জোট সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলি এখন আলোচনাসাপেক্ষ এবং আগামী দিনে চূড়ান্ত করা হবে। তবে ঘোষণাটি ইতিমধ্যে হর্ন অফ আফ্রিকায় অশান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের জন্য একটি কাঠামো স্থাপন করেছে। এই জোট ইথিওপিয়াকে আটকানোর পাশাপাশি তাকে সোমালিল্যান্ড চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করতে এবং একটি আলোচনার মাধ্যমে শান্তি খোঁজার জন্য প্ররোচিত করতে পারে। অথবা এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের দিকে চালিত করতে পারে যা আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরও গভীর করে তুলবে। এখনও পর্যন্ত ইথিওপিয়া সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে তার বিতর্কিত সমঝোতাপত্র বাস্তবায়ন স্থগিত করে ‘অপেক্ষা করা এবং নিবিড় ভাবে নজর রাখা’র পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। যাই হোক, সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মুসে বিহি-র সম্ভাব্য ইথিওপিয়া সফরের খবর কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে। বাস্তবে যদি এই সফর হয়, তা হলে এর লক্ষ্য হবে সমঝোতাপত্রের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা। এটি মিশর ও তার অংশীদার দেশগুলিকে আরও শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করতে প্ররোচিত করতে পারে।
বিশ্বের অনেক অংশই সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। হর্ন অফ আফ্রিকা অঞ্চলটি দ্রুতই বারুদবাক্সে পরিণত হচ্ছে, উত্তেজনা এবং অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই সব কিছুই সম্ভাব্য ভাবে একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের দিকে চালিত করবে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটিই এই অঞ্চলের সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাতে পরিণত হতে পারে। তবুও এই অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে খুব কম মনোযোগ পেয়ে এসেছে। প্রবাদেই বলে, তীব্র অবজ্ঞার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক আর কিছুই নয়। হর্ন অফ আফ্রিকাকে উপেক্ষা করা তাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য বিপজ্জনক বলেই প্রমাণিত হতে পারে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ডিপ্লোম্যাটিক কুরিয়ার-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.