Published on Nov 20, 2021 Updated 0 Hours ago

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে মজবুত করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত নিজেদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির উচিত সক্রিয় ভাবে বনাঞ্চল ও বৃক্ষ সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করা।

জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের জন্য বনাঞ্চল এবং বৃক্ষ সংরক্ষণের কর্মসূচিতে নতুন প্রাণশক্তির সঞ্চার

অরণ্য থেকে নিঃসৃত কার্বন এবং কার্বনের ভারসাম্য

অরণ্য কার্বনের নিঃসরণ এবং শোষণ… উভয় ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জঙ্গল কেটে ফেলা এবং দাবানলের পাশাপাশি প্রাকৃতিক জারণ-বিজারণ পদ্ধতির ফলে অরণ্যাঞ্চল থেকে পরিবেশে কার্বনের নিঃসরণ ঘটতে থাকে। গ্লোবাল এমিশন বা বিশ্বব্যাপী নিঃসৃত কার্বনের প্রায় ২৫%-এর উৎস হল ল্যান্ড সেক্টর বা কৃষি-শিল্পাঞ্চল এবং অরণ্যাঞ্চলের সম্মিলিত ক্ষেত্রের ব্যবহার। এটি শক্তি ক্ষেত্রের ঠিক পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণকারী উৎস এবং এই নিঃসরণের অর্ধেক পরিমাণ (বার্ষিক ৫-১০ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড) ঘটে থাকে বনাঞ্চল কেটে ফেলা এবং বনক্ষয়ের জন্য।

পরিবেশের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের ক্ষেত্রে এক আধার হওয়ার পাশাপাশি বনাঞ্চল জলবায়ুকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, সংকটময় পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকা জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা প্রদান এবং মানুষকে জীবিকার সংস্থানে সাহায্য করার মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বনাঞ্চল এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবিত ২০৩০ সালের সময়সীমার মধ্যে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি পরিমাণ নিঃসরণ রোধ করার কাজটি বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি এবং ভূমিক্ষয় রোধ করার পাশাপাশি বনসৃজন এবং ভূমি সংরক্ষণের মাধ্যমে করা দরকার। কপ২৬ শীর্ষ সম্মেলনে ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের নিঃসরণ তীব্রতা বা এক ইউনিট জি ডি পি প্রতি নিঃসরণের পরিমাণ ২০০৫ সালের তুলনায় অন্ততপক্ষে ৪৫% কমিয়ে আনার কাজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। বিশ্বব্যাপী আনুমানিক প্রায় ২০০ কোটি হেক্টর ক্ষয়প্রাপ্ত জমি সংরক্ষণযোগ্য অবস্থায় আছে যা সম্মিলিত ভাবে আয়তনে দক্ষিণ আমেরিকার ভূখণ্ডের সমান। ফলে বনাঞ্চলের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়িয়ে এবং এই সকল ভূমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে সেগুলির স্থিতিশীল সংরক্ষণের উপরে জোর দেওয়া জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি।

অরণ্যাঞ্চল বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারতে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন

জলবায়ু পরিবর্তনে অরণ্যাঞ্চল অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে সাড়া দেয়। কারণ অরণ্য এবং জলবায়ু প্রতিকূল পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যের ব্যাপকতা এবং ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনশীল পদ্ধতিগুলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। জমির ব্যবহার, ব্যবহারে পরিবর্তন এবং বনপালন ও কৃষিকাজের মধ্যেই ২০১৪ সালে মোট নিঃসরণের ৩ লক্ষ ১ হাজার ১৯৩ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উৎস লুকিয়ে আছে, যা ভারতের মোট জি এইচ জি এমিশনস বা গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের ১৮%। আনুমানিক কার্বন স্টক বা বনাঞ্চলের জৈব ও অজৈব উপাদানগুলিতে সঞ্চিত কার্বনের পরিমাণ ২০১১ সালের ৬৯৪১০ লক্ষ টন থেকে বেড়ে ২০১৩ সালে ৭০৪৪০ লক্ষ টনে পরিণত হয়েছে, যা গত দু’বছরে দেশের মোট কার্বন স্টকের ১.৪৬% বৃদ্ধির সমান।

বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, সংকটময় পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকা জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা প্রদান এবং মানুষকে জীবিকার সংস্থানে সাহায্য করার মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বনাঞ্চল এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।

২০১৯ সালের ইন্ডিয়া স্টেট অব ফরেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের ৭১২২৪৯ বর্গকিমি অঞ্চল জঙ্গল দ্বারা আচ্ছাদিত যা দেশের ভৌগোলিক আয়তনের ২১.৬৭%। ২০১৯ সালে বনাঞ্চলে স্থিত কার্বনের মোট পরিমাণ বা কার্বন স্টক ছিল আনুমানিক ৭১২৪০ লক্ষ টন। দেখা গেছে, এই কার্বন স্টকের বার্ষিক বৃদ্ধির পরিমাণ ৪২৬ লক্ষ টন যা ৯৭৬.৪ লক্ষ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমতুল্য। দেশের স্থলভাগের জীববৈচিত্র্যের প্রায় ৮০% বনাঞ্চলেই পাওয়া যায় এবং ৩০ কোটিরও বেশি সংখ্যক মানুষ জীবিকার জন্য বনাঞ্চলের উপরেই গভীর ভাবে নির্ভরশীল। এর পাশাপাশি বনাঞ্চল দেশের প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদার ৪০%, পশুখাদ্যের ৩০% এবং কাঠ ব্যতীত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বনজ সম্পদের জোগান দেয়। বৃক্ষরোপণ, বনসৃজন এবং পুনর্বনসৃজনের মতো কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে এই প্রাকৃতিক কার্বন সিঙ্ক বা আধারের সংরক্ষণ ও তার ক্ষমতা বৃদ্ধির উপরে জোর দেওয়ার ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক সমাধান যেমন ভূমি সংরক্ষণ এবং কাঠের জন্য বৃক্ষচ্ছেদন রোধ করার মতো কার্যকর উপায়গুলি অবলম্বন করার মাধ্যমে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমানোর পাশাপাশি বনাঞ্চল কার্বন সিঙ্ক বা আধারের ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা সম্ভব।

অরণ্যাঞ্চলের উৎপাদনশীলতা এবং সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি

২০১৯ সালের ইন্ডিয়া স্টেট অব ফরেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী ক্যানোপি ডেনসিটি বা ছায়াবৃক্ষ দ্বারা সম্পূর্ণ রূপে আচ্ছাদনের ঘনত্ব ৪০%-এরও কম (যেমন মুক্ত বনাঞ্চল এবং গুল্ম ও ঝোপ দ্বারা আবৃত অঞ্চল)। এমন বনাঞ্চলের পরিমাণ ভারতের মোট বনাচ্ছাদনের ১০.৬৭ শতাংশ। এখন থেকে ২০৩০-এর মধ্যে ভারতের মোট কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৪০০০ কোটি টনের কাছাকাছি হতে চলেছে। কপ২৬ শীর্ষ সম্মেলনে নিঃসৃত কার্বনের এই পরিমাণের ১০০ কোটি টন পর্যন্ত হ্রাসের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি আগামী দশকে বন আচ্ছাদনের বৃদ্ধি এবং তা জোরদার করার দ্বৈত ভূমিকাযুক্ত কর্মপরিকল্পনাকে উৎসাহ জোগাবে। এই প্রেক্ষাপটে বনাঞ্চলের উৎপাদনশীলতার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং তার সুনিশ্চিত বাস্তবায়ন আসলে বনতালিকা মূল্যায়ন, বনাঞ্চলের স্থিতিশীল রক্ষণাবেক্ষণ এবং জৈব অর্থনীতির পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে। এর পাশাপাশি কার্বন চক্রের আওতায় বৃক্ষচ্ছেদনের হার ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং বনায়ন সুনিশ্চিত করা যাবে তখনই, যদি বর্তমান ও ভবিষ্যতের কাঠের জোগানের পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। এবং এটি এন ডি সি ও অন্যান্য জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণ করতেও সাহায্য করবে।

কপ২৬ শীর্ষ সম্মেলনের প্রেক্ষিত এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

যদিও কপ২৬ শীর্ষ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ এবং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আলোচনা গুরুতর অঙ্গীকারবদ্ধতার সূচনা করেছে, তবুও কোভিড পরিস্থিতি পরবর্তী সময়ে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিতে কার্বন ফিন্যান্সের ঘাটতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। দুটি উল্লেখযোগ্য সহায়ক হস্তক্ষেপ এই সকল নীতিগত আলোচনাকে বাস্তব পদক্ষেপে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে। প্রথমত, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আলোচনার নতুন লক্ষ্যমাত্রার প্রেক্ষিতে আর ই ডি ডি প্লাস বা রিডিউসিং এমিশনস ফ্রম ডিফরেস্টেশন অ্যান্ড ফরেস্ট ডিগ্রেডেশন কর্মসূচির গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। অর্থাৎ প্যারিস চুক্তি অনুসারে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে এবং সময় মতো লক্ষ্যমাত্রাগুলির বাস্তবায়নের জন্য এবং এন ডি সি বা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের নীতিগুলির কঠোর প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট, বাস্তব ভিত্তি সম্পন্ন নিয়মাবলি চালু করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং পুঁজি বিনিয়োগের পরিকল্পনার উপরে ভিত্তি করে আগামী দিনে নেট জিরো বা কার্বন নিরপেক্ষতার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করার মধ্য দিয়ে দেশগুলি এক স্থিতিশীল পৃথিবী গড়ার অভিমুখে পদক্ষেপ নিতে পারে। জলবায়ু সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি এবং তার বাস্তবায়নে নেওয়া কড়া পদক্ষেপ দেশগুলিকে তাদের আর্থ-সামাজিক উচ্চাশা এবং উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখে একাধিক বৈচিত্র্যমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করবে।

অরণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের কথা মাথায় রেখে বনাঞ্চল কেটে ফেলা বা জঙ্গলের বাইরেও বৃক্ষরোপণ করা, বিশেষত ব্যক্তিগত জমিতে — সাধারণ মানুষকে তাঁদের নিজস্ব জমিতে ব্যাপক হারে বনসৃজন এবং বৃক্ষরোপণের কাজে উৎসাহিত করতে পারে।

সুতরাং, এ রকম পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে নিঃসরণের মাত্রা কমানোর জন্য দুটি পথ খোলা থাকছে। এক, দূষণহীন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দুই, কার্বন সিকুইস্ট্রেশন বা কৃত্রিম অথবা প্রাকৃতিক উপায়ে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে কঠিন বা তরল অবস্থায় কার্বনের সঞ্চয়। যে হেতু অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের পক্ষেই বনচ্ছেদন হ্রাস করে এবং সবুজের আচ্ছাদন বাড়িয়ে কার্বন পৃথকীকরণের সম্ভাবনা অত্যন্ত কম বা প্রায় নেই বললেই চলে, তাই কার্বনের নিঃসরণ কমিয়ে আনতে কার্বন অফসেটিং এবং কার্বন ক্রেডিটিং দেশগুলির সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। এর ফলে বিশেষত ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কার্বন ক্রেডিট এবং কার্বন অফসেটের চাহিদায় জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র কার্বন মার্কেট নতুন ভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে। এবং দেশগুলিও উন্নত ও শক্তিশালী জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ নীতি পূরণের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে পারে। এই প্রেক্ষিতে কার্বন মার্কেটের এমন এক বাস্তুতন্ত্র যেখানে সরকারি ও বেসরকারি উভয় অংশীদারই বর্তমান, চিরাচরিত প্রক্রিয়ায় শুধু এক বাঁক বদলেরই সূচনা করবে না, তা অরণ্য সংরক্ষণকারী এবং নিজেদের জমিতে সবুজায়নকারী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পারস্পরিক সুবিধে ভাগ করে নিতেও সাহায্য করবে। অরণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের কথা মাথায় রেখে বনাঞ্চল কেটে ফেলা বা জঙ্গলের বাইরেও বৃক্ষরোপণ করা, বিশেষত ব্যক্তিগত জমিতে — সাধারণ মানুষকে তাঁদের নিজস্ব জমিতে ব্যাপক হারে বনসৃজন এবং বৃক্ষরোপণের কাজে উৎসাহিত করতে পারে। এর ফলে দেশগুলির দ্বারা আমদানিকৃত কাঠের পরিমাণ হ্রাস, অভ্যন্তরীণ চাহিদার জোগান দেওয়া এবং কৃষক ও বনাঞ্চল সংরক্ষণে ব্যক্তিগত স্তরে উদ্যোগী মানুষজন এবং কৃষকদের বিকল্প জীবিকার বন্দোবস্ত করা যেতে পারে।

এই রকম এক উদীয়মান পরিস্থিতিতে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি আগাম সক্রিয়তা অবলম্বন করে বনাঞ্চল বৃদ্ধি এবং আরও বেশি করে সবুজায়নের মাধ্যমে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিজেদের উৎসাহিত করতে পারে। এবং একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের কর্মকাণ্ডে সমর্থন জোগাতে পারে।


লেখক ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসএর এক জন সদস্য।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.