Image Source: Getty
অক্টোবর মাসে মরিশাসের প্রাইম মিনিস্টার প্রবিন্দ জগনাথ দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান চাগোস দ্বীপপুঞ্জের বিরোধে তাঁর বিজয় উদ্যাপন করেছেন। কিন্তু তখনও তিনি ভাবেননি যে, এমনটা করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁকেও কার্যালয় ত্যাগ করতে হবে। বছরের পর বছর ধরে আইনি লড়াইয়ের পর মরিশাস অবশেষে চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করেছে এবং সংযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি স্থায়ী বিবাদের সমাধান করেছে।
তবুও তাঁর এক সুষ্ঠু পুনঃনির্বাচনের আশায় জল ঢেলে বিরোধী নেতা নবীন রামগুলাম মরিশাসের পার্লামেন্ট দখলের দৌড়ে জয়ী হয়েছেন। বিজয়ের মাপকাঠি বিচার করার সময় ৬২টি আসনের মধ্যে ৬০টি আসনে জয় লাভ করেছেন এবং মোট ভোটের ৬২.৬% পেতে সমর্থ হয়েছেন। এ সব কিছুই দর্শায় যে, প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর ক্ষমতাসীন জোট, ‘ল’আলিয়াঁজ লেপে’র বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ ছিল।
পশ্চিম ভারত মহাসাগরের ছোট দ্বীপ দেশ মরিশাসে ১০ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২২ সালে জিডিপি ১০০০০ মার্কিন ডলারের বেশি এবং ৬-৭% স্থির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও অনেক মরিশিয়ানই জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে যুঝছেন। ক্রমবর্ধমান মাদক-অর্থনীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় সংক্রান্ত সঙ্কট খারাপতর হয়েছে, যার ফলে যুব প্রজন্মের অনেকের জীবনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধি, পেনশন বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের উপর কর কমানোর প্রতিশ্রুতি জনগণের অসন্তোষ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
সর্বোপরি, প্রচারাভিযানটি রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব ও একটি তীব্র ওয়্যারট্যাপিং কেলেঙ্কারি দ্বারা চিহ্নিত। নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে উচ্চ স্তরীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবী, সাংবাদিক ও বিভিন্ন সুশীল সমাজ সংস্থার সদস্যদের মধ্যে একগুচ্ছ ব্যক্তিগত ফোনালাপ ‘মিসি মুস্তাস’ নামে একটি স্থানীয় ইউটিউব চ্যানেলে ফাঁস হয়ে যায়।
এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার জোর দিয়ে বলেছিল যে, পুরো রেকর্ডিংটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে নির্বাচনের আগে সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে পরিস্থিতি নাটকীয় ভাবে বদলে যায়। পরের দিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গিয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ওয়্যারট্যাপকে ঘিরে বিতর্কটি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মনোভাবকে উস্কে দিয়েছিল এবং জগনাথের তরফে সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করাই সর্বশেষ পদক্ষেপ হয়ে ওঠে।
মরিশাস হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র হওয়ার দরুন এক রাজনৈতিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী মলদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবক্ষয়ের আলোকে মরিশাসের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূর্বোল্লিখিত দু’টি দেশই সম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে। অনুরা দিসানায়েকের অধীনে শ্রীলঙ্কার নতুন কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকলেও বিশেষ করে ‘ইন্ডিয়া আউট, চায়না ইন’ প্রচারের কারণে মলদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নাটকীয় ভাবে খারাপ হয়েছে। মলদ্বীপের চিনপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু বেশ কয়েকটি অভিযোগ এবং পালটা-অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছেন, যা কূটনৈতিক পরিসরকে আরও জটিল করে তুলেছে।
অক্টোবর মাসে মুইজ্জুর ভারত সফরের পর থেকে ভারত ও মলদ্বীপের মধ্যে সম্পর্কে উন্নতি ঘটেছে। তবে মরিশাসের সঙ্গে যে কোনও রাজনৈতিক অচলাবস্থা – যেমনটা বর্তমানে মলদ্বীপের সঙ্গে চলছে – গুরুতর উদ্বেগের কারণ হতে পারে। সর্বোপরি, প্রতিবেশী সেশেলসে অ্যাসাম্পশন আইল্যান্ড উন্নয়নে ভারতের পূর্ববর্তী প্রচেষ্টা – যে উদ্যোগটি স্থানীয়দের তরফে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়ায় শেষপর্যন্ত বাতিল করে দিতে হয় - ভারতের বিদেশনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হয়ে রয়েছে।
রামগুলামের ভারতের প্রতি প্রবল অনুরাগ রয়েছে। কোভিড-১৯ অতিমারি চলাকালীন যখন তিনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, তাঁকে চিকিৎসার জন্য দিল্লিতে আনা হয়েছিল এবং সুস্থ হওয়ার পর তিনি ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
এই বছরের শুরুর দিকে ভারত মরিশাসের আগলেগা দ্বীপে একটি নতুন এয়ারস্ট্রিপ ও জেটি উদ্বোধন করেছে। বিদ্যমান ৮০০ মিটারের এয়ারস্ট্রিপটিকে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের এয়ারফিল্ডে পরিণত করার সঙ্গে সঙ্গে ভারত এই বৃহৎ ক্যারিয়ারগুলিকে সরাসরি দ্বীপে রাখা ও মোতায়েন করার সক্ষমতা অর্জন করেছে, যা এই অঞ্চলে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে পারে।
এর পাশাপাশি মোদী প্রশাসনের ‘সকলের জন্য নিরাপত্তা এবং বৃদ্ধি’ নীতির অংশ হিসাবে সংস্কারকৃত এয়ারস্ট্রিপ ছাড়াও বিদ্যমান জেটির কাছে একটি বন্দর নির্মাণ, গোয়েন্দা তথ্য ভাগ করে নেওয়ার জন্য অবকাঠামো স্থাপন, যোগাযোগের শৃঙ্খল স্থাপন এবং ভারত মহাসাগরের জলরাশিতে চলাচলকারী জাহাজগুলির উপর নজর রাখার জন্য একটি ট্রান্সপন্ডার সিস্টেম স্থাপন করার জন্য ভারতের পরিকল্পনা রয়েছে। এই নতুন অবকাঠামোগুলি একটি সামুদ্রিক শক্তি হিসাবে ভারতের সুনামকে সশক্ত করবে এবং সেই অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তার করবে।
জুলাই মাসে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর মরিশাস সফর করেন, যেখানে তিনি বিরোধী ব্যক্তিত্ব নবীন রামগুলাম এবং পল বেরেঙ্গার-সহ মরিশাসের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রামগুলামের ভারতের প্রতি প্রবল অনুরাগ রয়েছে। কোভিড-১৯ অতিমারি চলাকালীন যখন তিনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, তাঁকে চিকিৎসার জন্য দিল্লিতে আনা হয়েছিল এবং সুস্থ হওয়ার পর তিনি ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
সর্বোপরি ৭৭ বছর বয়সি রামগুলাম রাজনীতিতে নতুন মুখ নন, তিনি মরিশাসের প্রতিষ্ঠাতা সিউসাগর রামগুলামের ছেলে। রামগুলাম দু’বার প্রাইম মিনিস্টার পদেও বহাল ছিলেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মরিশাস চিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক সশক্ত করেছে এবং উল্লেখযোগ্য ভাবে ২০১৯ সালে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মরিশাস ডিজিটাল অর্থনীতি, ওষুধ এবং চিরাচরিত ওষুধ খাতে চিনা বিনিয়োগ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হতে পারে। ২০২২ সালে ব্যাঙ্ক অফ মরিশাস একটি রেনমিনবি ক্লিয়ারেন্স সেন্টার স্থাপন করে, যা চিনের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক কূটনীতিকে আরও উন্নত করে।
তবে চিনের সমান্তরালে মরিশাস ভারতের সঙ্গেও তার শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চিন-মরিশাস মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর হওয়ার ঠিক এক মাস পরে মরিশাস ভারতের সঙ্গে একটি সর্বাত্মক অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং অংশীদারি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
সর্বোপরি, সংযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র যখন চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব মরিশাসের কাছে হস্তান্তর করে, তখন মরিশাসের কৌশলগত অংশীদার হিসাবে ভারতের ভূমিকা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই সম্পর্কের লক্ষ্য হল অঞ্চলটিতে সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদার করা এবং চিনের তরফে যে কোনও আগ্রাসী পদক্ষেপের মোকাবিলা করা।
তাই সরকার পরিবর্তন হলেও ভারত ও মরিশাসের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত থাকবে বলেই আশা করা যায়। তবে এই সম্পর্কের উপর সকলের নজর থাকবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় লোয়ি ইনস্টিটিউট-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.