পাকিস্তান এক আত্মঘাতী আবর্তে জর্জরিত। দেশটির অবস্থা এমন এক মরণাপন্ন রোগীর মতোই, যার স্বাস্থ্যের সূচকগুলিতে সামান্যতম উন্নতি দেখা গেলে আশা ক্ষণস্থায়ী ভাবে বৃদ্ধি পায়। তারপরই এই বাস্তবতা ধেয়ে আসে যে, রোগীটির সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রমশ বিকল হয়ে পড়ছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটিকে একটি বহু-প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। যা যা ভুল হওয়া সম্ভব, সবই ঘটেছে। রাষ্ট্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাঁরা অসহায় বোধ করছেন। এবং তাঁদের এ বিষয়ে ন্যূনতম ধারণাই নেই যে, কী ভাবে অবস্থার মোকাবিলা করে সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। সরকার ও সামরিক সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা মনে করেন যে, তাঁরা জনসাধারণের ধারণাকে নিজেদের কাজে লাগাতে পারলেই সবকিছু ঠিকঠাক পথে এগোবে। সঙ্কটের মাত্রা অস্বীকার করা, খবরের ভুল উপস্থাপন (এবং নেতিবাচক খবর চেপে যাওয়া), সব কিছু স্বাভাবিক থাকার ভান করা, এমনকি পাকিস্তান অবিলম্বে কতটা ধনী হতে চলেছে, সেই সংক্রান্ত আকাশকুসুম পরিসংখ্যান প্রদান করা — অর্থাৎ ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের খনিজ, ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আসন্ন বৈদেশিক বিনিয়োগ, ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রফতানি… এ সব কিছুই শুনলে আশাব্যঞ্জক মনে হয়। এক কথায়, এই পরিকল্পনা উন্নয়ন ও বৃদ্ধি সংক্রান্ত শেখ চিলি মডেল।
জুন মাসের শেষ মুহূর্তে যখন ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড-এর (আইএমএফ) তরফে সাময়িক ব্যবস্থাপনার খবর আসে, তখন পাকিস্তান উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে যে, শাহবাজ শরিফ সমস্যার সামাল দিয়েছেন এবং পাকিস্তানের ঋণখেলাপি হওয়া রোধ করেছেন। রুপি তার মূল্যের কিছুটা পুনরুদ্ধার করেছে এবং স্টক মার্কেটগুলিতেও অযৌক্তিক উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গিয়েছে। অদম্য পিডিএম জোটের নেতৃত্বাধীন মিশ্র শাসনব্যবস্থা আত্মতুষ্টিতে ভুগে জানিয়েছিল যে, তারা অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের পথে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। অন্য দিকে সামরিক বাহিনী তার চিরাচরিত নৃশংস এবং আইনবহির্ভূত পদ্ধতি অবলম্বন করে দেশের বৃহত্তম ও জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক দল পিটিআই-কে রাজনৈতিক ভাবে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে বন্দি হওয়ার দরুন মনে করা হয়েছিল যে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সামান্য হলেও স্থিতিশীলতা এসেছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে একাধিক বিচ্যুতি লক্ষ করা গেলেও, এমনটা ধারণা করা হয়েছিল যে, তালিবানদের উপর চাপ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। কূটনৈতিক ভাবে সরকার এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, পাকিস্তান সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (ইউএই) এবং অন্যান্য গালফ রাষ্ট্র থেকে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে, যা অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
অদম্য পিডিএম জোটের নেতৃত্বাধীন মিশ্র শাসনব্যবস্থা আত্মতুষ্টিতে ভুগে জানিয়েছিল যে, তারা অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের পথে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এই আশাবাদ অত্যন্ত ভঙ্গুর ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। ব্যাপক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি, বেকারত্ব, এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে মন্দা আসার ফলে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির সামনে সাধারণ মানুষ অসহায়। সেই ভয়ঙ্কর কঠোর অর্থনৈতিক অবস্থার উপর এই আশাবাদ একটি প্রলেপ লাগানোর ভাবনা মাত্র। রুপির মূল্যে পতন, যা ডলার মার্কের তুলনায় ৩০০-র সীমা ছাড়িয়েছে (খোলা বাজারে এক ডলারের তুলনায় এটির বর্তমান মূল্য পিকেআর ৩৩০) এবং জ্বালানির মূল্যে ব্যাপক বৃদ্ধি (পেট্রলের দাম এক মাসের মধ্যে পিকেআর ৫০ বৃদ্ধি পাওয়া) আখেরে সাধারণ মানুষের উপর, এমনকি মধ্যবিত্তদের উপরেও ভয়ঙ্কর চাপ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু যা সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে, তা হল অস্বাভাবিক রকমের বিদ্যুতের বিল। দেশব্যাপী প্রতিবাদী মানুষের বিক্ষোভ – যাঁদের বিদ্যুতের বিল প্রায়শই তাঁদের মাসিক উপার্জনের মাত্রা ছাপিয়ে যাচ্ছে - প্রশাসন ব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। আতঙ্কিত সরকার কিছু ছাড় প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও তারা এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই করে উঠতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার কাকার - যাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অনুগত সৈনিক বলে মনে করা হয় – শুধু মাত্র পশ্চাদপসরণ করে এবং অযৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে এই সঙ্কটকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
আসল বাস্তবতা হল এই যে, চাইলেও সরকার বা পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে এই সঙ্কটের কোনও সমাধান নেই। এই সঙ্কট রুপির দুর্বলতর হওয়া, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং ফলস্বরূপ বিদ্যুতের শুল্ক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে উঠেছে। সত্যিটা হল, বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের খরচ – পিকেআর ৫০ থেকে পিকেআর ৭০ পর্যন্ত – জোগানো বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য সম্পূর্ণ আয়ত্তের বাইরে এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্ররা এই খরচ জোগানোর কথা ভাবতেও পারেন না। সরকার এতটাই ভেঙে পড়েছে যে, তার কাছে বিদ্যুতের ভর্তুকি দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা নেই। এমনকি আইএমএফ কর্মসূচির অধীনেও - যা ছাড়া কয়েক দিন না হলেও, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পাকিস্তানে অর্থনীতি সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে পড়তে পারে – সরকার এই ভর্তুকি জোগানোর অবস্থায় নেই। পরবর্তী সরকারগুলি এতটাই আপসপন্থী, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অযোগ্য যে, তারা কিছু কাঠামোগত সমস্যার সমাধান করতে সম্পূর্ণ অক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই অক্ষমতার মাশুল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে জোগাতে হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সরবরাহ ও বণ্টন সংক্রান্ত ক্ষতি হ্রাস করা, বিলের সর্বোচ্চ অর্থ পুনরুদ্ধার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির কার্যকারিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটেনি।
চ্যুতিবিন্দু ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে
যে ভাবেই হোক না কেন, চ্যুতিবিন্দু প্রকটতর হয়ে উঠেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, গণক্ষোভ আরও বিধ্বংসী আকার ধারণ করতে পারে এবং পাকিস্তানি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাকে সমূলে নাড়িয়ে দিতে পারে। সাধারণ মানুষের হতাশা তুঙ্গে এবং মধ্যবিত্তদের জন্যও বেঁচে থাকার লড়াই কঠিনতর হয়ে উঠেছে। বিদ্যুতের বিলের সঙ্কট বৃহত্তর অর্থনৈতিক সঙ্কটের - যা নিজেই এতটাই অপ্রতিরোধ্য এবং এই ধ্বস প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সামঞ্জস্য সাধনের মাত্রা এতটাই সুবিশাল - একটি অংশ মাত্র হয়ে ওঠা এ কথাই দর্শায় যে, এটির সমাধান করা প্রধানত প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কোনও তত্ত্বাবধায়ক ক্ষমতার সরকারের ঊর্ধ্বে। বিদ্যুতের বিল সংক্রান্ত সঙ্কট মোকাবিলার কোনও উপায়ই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নেই। জনরোষকে স্তিমিত করার মতো কোনও রাজনৈতিক পুঁজি নেই, এমনকি সমস্যা সমাধানের কোনও প্রযুক্তিগত সমাধানও সরকারের কাছে নেই। এমনকি একজন অ-জনপ্রিয় আধা-স্বৈরশাসক সেনাপ্রধান জেনারেল অসীম মুনির-এর সমর্থনও পাকিস্তানের বিপজ্জনক পতনকে রোধ করতে পারবে বলে মনে হয় না।
সরকার এতটাই ভেঙে পড়েছে যে, তার কাছে বিদ্যুতের ভর্তুকি দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা নেই। এমনকি আইএমএফ কর্মসূচির অধীনেও - যা ছাড়া কয়েক দিন না হলেও, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে পড়তে পারে – সরকার এই ভর্তুকি জোগানোর অবস্থায় নেই।
এর অর্থ হল এই যে, সামরিক প্রশাসনকে তাদের তত্ত্বাবধায়ক অবস্থান দীর্ঘায়িত করার যে কোনও বাসনা ত্যাগ করতে হবে – যে ভাবনা ইসলামাবাদের ক্ষমতার অলিন্দে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। অন্য কথায় বললে, বর্তমান ব্যবস্থার পক্ষে দেশের সাধারণ নির্বাচনকে নভেম্বর থেকে দু’মাসের বেশি পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক ভাবে, এটি অপ্রতিরোধ্য এবং অস্থিতিশীল। পাকিস্তান পিপলস পার্টি-র (পিপিপি) মতো একাধিক বিরোধী দল নির্বাচন সংক্রান্ত যে কোনও বিলম্বের বিরোধিতা করে। আংশিক ভাবে এর নেপথ্যে রয়েছে এই ভয় যে, এর ফলে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটবে এবং একই সঙ্গে এই ভয়ও কাজ করছে যে, একবার সেনাবাহিনী ইমরান খানের ব্যবস্থা করতে পারলে, সেনাবাহিনীর পরবর্তী লক্ষ্য হয়ে উঠবে বিরোধী দলগুলিই। নির্বাচনের একটি অনির্দিষ্ট বিলম্ব তাই যে কোনও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দানা বাঁধতে সাহায্য করতে পারে এবং সেনাবাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে যা শুধুমাত্র শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্যই নয়, বরং রাষ্ট্রের জন্যও বিপর্যয়কর বলে প্রমাণিত হতে পারে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রকৌশলে লিপ্ত হওয়ার প্রলোভন - যার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলি কুখ্যাত - প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের বাস্তবতার উন্মোচনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
এ কথা বললে সম্ভবত অত্যুক্তি করা হবে না যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র ১৯৭১ সালের তুলনায় আরও গুরুতর সঙ্কটের সম্মুখীন। স্বর্গ থেকে কিছু পরিমাণ মান্না (অযুত বিলিয়ন ডলার) পাকিস্তানের উপর বর্ষিত না হলে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হতে চলেছে। এবং মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি হঠাৎ করে আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি বা চিন থেকে আসা ত্রাণ অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে কিছু দিনের জন্য স্থগিত করতে পারলেও সম্পূর্ণ রূপে রোধ করতে পারে না। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দুর্দশার মাত্রার পাশাপাশি, নিরাপত্তা পরিস্থিতিও খারাপতর হয়েছে। তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) হামলার তীব্রতা, দুঃসাহস এবং ভৌগোলিক পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। বালুচ যোদ্ধারাও দুঃসাহসী আক্রমণ চালাচ্ছে, যার লক্ষ্য সিপিইসি প্রকল্পে কর্মরত চিনারা।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি বা চিন থেকে আসা ত্রাণ অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে কিছু দিনের জন্য স্থগিত করতে পারলেও সম্পূর্ণ রূপে রোধ করতে পারে না।
রাজনৈতিক ভাবে ইমরান খান অতীতে পর্যবসিত হওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দৃঢ় ভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসা এবং আরও এক বার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ফলে রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার দরুন পরিস্থিতি জটিলতর হয়েছে। এমন কিছু শক্তি রয়েছে, যারা অতীতের মতো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। জনসাধারণ বিষণ্ণতায় ভুগলেও তাঁদের নীরবতাকে সেনাবাহিনীর আধিপত্যের স্বীকৃতি বা সম্মতি হিসাবে মনে করা ভুল হবে। সামরিক নেতৃত্বের প্রতি জনমানসে ব্যাপক বিতৃষ্ণা রয়েছে। পাকিস্তান যে বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে, তার দায় সেনাবাহিনীও এড়িয়ে যেতে পারে না। বিভিন্ন রাজনৈতিক স্তরের উপর এই দায় চাপিয়ে দেওয়া পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইমরান খানের জনপ্রিয়তা খর্ব করা এবং তাঁকে নিরস্ত করার উদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনীর স্লেজ হ্যামার অ্যাপ্রোচ বা বারংবার আঘাত হানার পদ্ধতি সত্ত্বেও ইমরান রাজনৈতিক ভাবে প্রাসঙ্গিক রয়েছেন। জেনারেল অসীম মুনির এবং তাঁর অনুগামীরা ইমরানকে নিয়ে কেবল তটস্থই নন, বরং একই সঙ্গে তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা নিয়েও হতবাক। প্রকৃতপক্ষে, ইমরানের জনপ্রিয়তা ঊর্ধ্বমুখী বলে মনে করা হচ্ছে এবং এর নেপথ্যে প্রধান কারণ হল ইমরানের অনড় মনোভাব এবং তাঁর প্রতিপক্ষদের অপশাসন। অর্থনীতি যত দুর্বল হবে, ইমরানের জনপ্রিয়তা তত বৃদ্ধি পাবে। তাঁকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেওয়া বা যে কোনও উপায়ে তাঁকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা আসলে এমন এক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশকে উস্কে দিতে পারে, যাকে গণহত্যার পথে না হেঁটে নিয়ন্ত্রণে আনা সামরিক বাহিনীর জন্যও কঠিন হয়ে উঠবে। এবং গণহত্যার পথে হাঁটলে তার ফলাফল ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।
পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহের নিরিখে কারও পক্ষে এ কথা সুনিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে, কখন সংযমের বাঁধ ভাঙবে অথবা জনগণের ক্ষোভ ফুটন্ত লাভার মতো ছড়িয়ে পড়বে। রাজনীতিকে সঠিক পথে আনার জন্য জেনারেল অসীম মুনিরের বুল-ইন-আ-চায়না-শপ পদ্ধতি এবং অর্থনীতির ধরনকে ঠিক করার জন্য তাঁর মালাক্কা মনোভাব আখেরে ফলপ্রসূ হচ্ছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মুনিরকে অবিলম্বে পদক্ষেপ করতে হবে, অন্যথায় খুব দ্রুতই সব সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু লাখ টাকার প্রশ্ন হল, এমনটা তিনি করবেন কী ভাবে? মুনীর বা অন্য কারওই - ইমরান নয়, নওয়াজ শরিফ নয়, এবং অবশ্যই আসিফ জারদারি বা তাঁর ছেলে বিলাওয়াল নয় - এই বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসার কোনও সুসঙ্গত পরিকল্পনা নেই। মুনির অথবা সেনাবাহিনী ও নাগরিক সমাজে তাঁর অনুগামীদের কাছে এ হেন কোনও রাজনৈতিক পুঁজি না থাকার অর্থ হল এই যে, তাঁরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নৃশংস শক্তির ব্যবহার করতে বাধ্য হবেন। কিন্তু তাঁরা কি এমনটা করতে পারবেন, বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে যেখানে সেনাবাহিনী এতটা অপ্রিয় এবং শুধু রাজনৈতিক পরিসরেই নয়, অন্য একাধিক পরিসরে যুদ্ধরত। এর অর্থ হল এই, যদি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় এই চাপানউতোর চলতে থাকে, অদূরে ভবিষ্যতে ‘ডিপ স্টেট’টি সব কিছু রোধ করার জন্য পুনরায় একজন জনপ্রিয় নেতার উপর নির্ভর করতে বাধ্য হবে। সেই নেতা নওয়াজ শরিফ বা মওলানা ফজলুর রহমান বা আসিফ জারদারি… কেউই নন। সেই নেতা হবেন ইমরান খান।
পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহের নিরিখে কারও পক্ষে এ কথা সুনিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে, কখন সংযমের বাঁধ ভাঙবে অথবা জনগণের ক্ষোভ ফুটন্ত লাভার মতো ছড়িয়ে পড়বে।
এই চিন্তা অবশ্যই অসীম মুনির এবং তাঁর অনুগামীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বোপরি, এ কথা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, এটি জেনারেল অসীম মুনির এবং ইমরান খানের মধ্যে টিকে থাকার লড়াই। বাকি সবাই আনুষঙ্গিক, এমনকি অপ্রাসঙ্গিকও। মুনিরের দ্বিধা হল এই যে, ইমরানের সঙ্গে আপস করলে তাঁর ক্ষমতার অবসান ঘটবে। কিন্তু যদি তিনি ইমরানের সঙ্গে আপস করতে না চান, তা হলে কোনও অলৌকিক ঘটনাই একমাত্র তাঁর ক্ষমতাকে বজায় রাখতে পারে। শারীরিক ভাবে ইমরান খানের অপসারণ (পাকিস্তানে যে আশঙ্কার কথা কখনই নস্যাৎ করা যায় না) দেশটিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা এবং রাষ্ট্রকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে। এ সবই অনেকটা ১৯৭১ সালেরই মতো। সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সঙ্গে আপস করতে অস্বীকার করেছিলেন। এমনকি সামরিক পরাজয়ের পরেও ইয়াহিয়া এবং তাঁর সহযোগীরা ভেবেছিলেন যে, তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দিতে ও ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তাঁদের বলপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং দেশকে ভেঙে পড়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ভুট্টোর হাতে ক্ষমতার ভার তুলে দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য যতই উন্মত্ত প্রচেষ্টা চালানো হোক না কেন, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরেও পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছে ভুট্টোর সমর্থন নেওয়ার সুযোগ থাকলেও – একটি ভঙ্গুর দেশকে ফের দাঁড় করানোর জন্য ভুট্টোর কাছে বুদ্ধি ও কৌশল দুই-ই ছিল – বর্তমানে পাকিস্তানের কাছে যা অবশিষ্ট আছে, তা হল নির্বোধ, প্রতিহিংসাপরায়ণ, দুষ্ট ইমরান খান, যাঁর আখেরে কোনও পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার মতো কোনও বুদ্ধি বা কৌশল নেই।
এর বিপরীত বিকল্পটিও অজানা নয়। ইমরান খানের ক্রমাগত কষ্ট এবং ক্লেশ সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত তিনিই এগিয়ে রয়েছেন এবং অসীম মুনির হারতে চলেছেন। তবে বাস্তব হল, পাকিস্তান পরাজিত।
সুশান্ত সারিন অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.