Published on Dec 02, 2023 Updated 0 Hours ago

বৈদেশিক সম্পর্ক সংক্রান্ত আইন বা ফরেন রিলেশনস ল-এর মাধ্যমে চিন আর্থিক নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তার আইনি অস্ত্রভাণ্ডারে একটি নতুন আইন সংযোজন করেছে এবং বৈদেশিক সম্পৃক্ততার উপর পার্টির দখলকে আরও সুসংহত করেছে

বৈদেশিক সম্পর্ক সংক্রান্ত নতুন আইন চিনের অস্ত্রভাণ্ডারকে আইনসঙ্গত ভাবে সমৃদ্ধ করেছে

চিন সম্প্রতি বৈদেশিক সম্পর্ক সংক্রান্ত একটি নতুন আইন পাস করেছে, যা স্পষ্টতই তার সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা এবং উন্নয়নমূলক স্বার্থ রক্ষা করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে। আইনটি চিনের জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন বর্ণিত বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণকমিশন সম্প্রতি এবিষয়ে সতর্ক করেছে যে, চিনের সম্মুখে উপস্থিত জাতীয় নিরাপত্তা সমস্যাগুলির জটিলতা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শীর্ষ সংস্থাটি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, দেশকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গুরুতর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং চূড়ান্ত খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হতে হবে। এটি চিনের চিন্তাধারার একটি আমূল পরিবর্তনকে নির্দেশ করে, যা বর্তমানে নিরাপত্তাকেই উন্নয়নের আগে জায়গা করে দিয়েছে।

 

চিনের রাজনৈতিক বিতর্ক জাতীয় নিরাপত্তা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লং আর্ম এক্তিয়ার মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তাকে কেন্দ্র করেই চলে। বৈদেশিক নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে পালটা ব্যবস্থা নিতে এই অভ্যন্তরীণ আইনটি পার্টি-রাষ্ট্রকে শক্তি জোগাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না-র (সিপিসি) জার্নাল কিউশিতে প্রকাশিত ওয়াং রচিত এই আইন সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, এই পদক্ষেপ বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে পার্টি সেন্ট্রাল কমিটির কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বকে শক্তিশালী করবে এবং সংশ্লিষ্ট আইনি ব্যবস্থা ত্রুটিগুলি সংশোধন করবে। প্রথমত, এটি দেশটির বৈদেশিক সম্পৃক্ততার উপর কমিউনিস্ট পার্টির দখলকে সুসংহত করার অভিপ্রায়কেই দর্শায় ঘোষিত বয়সের সীমা অতিক্রম করা সত্ত্বেও ২০তম পার্টি কংগ্রেসের পরে কেন্দ্রীয় বিদেশ বিষয়ক কমিশনের প্রধান হিসাবে ওয়াং ই-র উন্নীত হওয়া থেকেও এ কথা স্পষ্ট হয়। সিপিসি-র অলিখিত কোড পার্টি-অভিজাতদের জন্য অবসরের বয়স হিসাবে ৬৮ বছরকে নির্ধারণ করলেও ওয়াং-এর ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে, যিনি গত বছর ৬৯ বছর বয়সে পদার্পণ করেছিলেন।

 

শীর্ষ সংস্থাটি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, দেশকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গুরুতর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং চূড়ান্ত খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হতে হবে।

 

চিনের এই আইন পাশ করার বিষয়টি চিনের কমিউনিস্ট পার্টির আইনি যুদ্ধের পদ্ধতির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে আইনকে আরও কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফু এবং অন্যান্য চিনা আধিকারিকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং হুওয়াই-এর মতো প্রযুক্তি সংস্থার উপরেও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় চিন ২০২১ সালে একটি নিষেধাজ্ঞা-বিরোধী আইন পাশ করেছে, যা বেজিংকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত বিদেশি সংস্থা এবং ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা দিয়েছে

 

কিউশিতে ওয়াং-এর প্রবন্ধটিতে আরও বলা হয়েছে যে, দেশের উন্নয়নে ঝুঁকি এবং অপ্রত্যাশিত কারণগুলির জন্যই আইনটি তৈরি হয়েছে। আইনটির কিছু বাহ্যিক প্রভাব রয়েছে কারণ এটিতে বিশেষ ভাবে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) উল্লেখ করা হয়েছে এবং নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, বিদেশে চিনা নাগরিক এবং সংস্থার স্বার্থকে রক্ষা করতে হবেযে প্রকল্পে শি নিজের ছাপ রাখতে চান, সেই বিআরআই চিনকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক উপস্থিতি প্রসারিত করতে সাহায্য করেছে। তবে চিন আন্তর্জাতিক স্তরে প্রসার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় গোলযোগে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে এবং দেশটির স্বার্থ অন্যান্য শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, চিনা অর্থ পার্লামেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে, হেন দাবির পরে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে চিনা নাগরিক এবং বাণিজ্যিক সংস্থার উপর আক্রমণ চালানো হয়। এটি সমসাময়িক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদেশে চিনা নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়ে চিনে একটি বিতর্কের জন্ম দেয় কারণ এটি তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত বলে চায়না ইনস্টিটিউটের আর্মস কন্ট্রোল স্টাডিজ সেন্টারের গুও শাওবিং দেশের নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য চিনের সক্ষমতা উন্নত করার জন্য যুক্তি দিয়েছিলেন চিনা বিদেশমন্ত্রক ঘোষণা করেছে যে, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ তার বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।

 

কোনও বিনিয়োগ ভবিষ্যতে লাভজনক হবে কি না, তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করে। তবে যেকোনও সময়েই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটতে পারে। বৈদেশিক সম্পর্ক আইন এই প্রশ্নই তুলে এনেছে যে, গণপ্রজাতন্ত্রী চিন বিদেশে তার নাগরিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য কত দূর যেতে পারবে? চিনা নাগরিকদের উপর প্রাণঘাতী হামলার পর চিন পাকিস্তানে নিজস্ব নিরাপত্তা সংস্থাগুলিকে অনুমতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের দিকেই ঝুঁকছে। মার্কেটর-এর বিআরআই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, চিনে প্রায় ৫০০০টি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা নিবন্ধিত রয়েছে। এর আগেও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এবং তার কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণের জন্য একটি বেসরকারি অ-রাষ্ট্রীয় শক্তির কাছে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের বিপর্যয়কর পরিণতি দেখা গিয়েছে। ইতিহাসে এহেন উদাহরণও রয়েছে, যেখানে বাণিজ্যএবং সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য একজোটে ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনীও লড়াই করেছিল। এ ভাবে যে দেশগুলি বিআরআই বিনিয়োগের গন্তব্য হয়েউঠছে, তাদের অবশ্যই চিনের নতুন বৈদেশিক সম্পর্ক আইনের প্রভাবগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।

 

আইনটির কিছু বাহ্যিক প্রভাব রয়েছে কারণ এটিতে বিশেষ ভাবে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) উল্লেখ করা হয়েছে এবং নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, বিদেশে চিনা নাগরিক এবং সংস্থার স্বার্থকে রক্ষা করতে হবে

 

চিন ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক লাভের জন্য বিদেশে তার ঋণ ব্যবহার করার পদ্ধতির জন্য সমালোচিত হয়েছে। বর্তমানে সেই ব্যাপারটিকেই ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নতুন আইনে এই বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয়েছে যে, চিন প্রাপক দেশগুলির সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে এবং তারা প্রদেয় আর্থিক সহায়তার সঙ্গে রাজনৈতিক শর্তকে সংযুক্ত করবে না। যাই হোক প্রমাণগুলি অবশ্য অন্য সত্যই তুলে ধরে, বিশেষত ইউয়ান ওয়াং ঘটনাটির ক্ষেত্রে, যেখানে চিন একটি অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল এবং ঋণের চাপে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার উপর একটি ট্র্যাক স্যাটেলাইট এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণে সক্ষম একটি গবেষণা জাহাজকে নোঙর করার অনুমতি দিতে চাপ দেয়। উল্লেখযোগ্য ভাবে কানাডা চিন পরিচালিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক-এর (এআইআইবি) সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত করেছে এবং চিনের কমিউনিস্ট পার্টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিতে অনুপ্রবেশ করেছেএক প্রাক্তন ব্যাঙ্ক কর্মচারীর করা এহেন অভিযোগের তদন্ত করছে

 

নতুন আইনটি অন্যান্য অংশীদার-সহ ব্যবসা, দেশ এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য সুদূরপ্রসারী ফলাফল ডেকে আনতে পারে। চিনা ভিন্নমতাবলম্বীদের রাষ্ট্রের সমালোচনার জন্য বা এমনকি চিনা স্বার্থের যথেষ্ট সমর্থন না করার জন্য চিন শাস্তি দিতে পারে, তা সে চিনে হোক বা বিদেশে। চিনের উন্নয়ন বা নিরাপত্তার বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগের ভয়ে চিনা সংস্থাগুলির সঙ্গে আদান-প্রদান করার সময় ব্যবসাগুলিকে, বিশেষ করে বিদেশি সংস্থাগুলিকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। আইনটি তাইওয়ানের কূটনৈতিক পরিসরকে সঙ্কুচিতকরতে পারে কারণ দেশ এবং সংস্থাগুলি আইনি প্রতিশোধ ও নিষেধাজ্ঞার ভয়ে চিনের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন করার আগে দুবার ভেবে দেখবে সম্প্রতি তাইওয়ানের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা আরও সুদৃঢ় করার চেষ্টা করা হয়েছে, যার উপর চিন তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে। তাইওয়ান তার চায়না-প্লাস-ওয়ানপদ্ধতিতেও কাজ করছে এবং দেশটির প্রযুক্তি সংস্থাগুলি চিন থেকে ভারতে নিজেদের কার্যকলাপ স্থানান্তর করতে চাইছে ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বইতে তাইপেই ইকোনমিক অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার (এর ডি-ফ্যাক্টো কূটনৈতিক কেন্দ্র) স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। ভারতের মতো দেশগুলির ক্ষেত্রে তা কী ভাবে কার্যকর হয়, সেটাই দেখার। কারণ চিন এই পদক্ষেপগুলিকে তার উন্নয়নমূলক স্বার্থ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসাবে দেখতে পারে

 

কানাডাও চিন পরিচালিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক-এর (এআইআইবি) সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত করেছে এবং চিনের কমিউনিস্ট পার্টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিতে অনুপ্রবেশ করেছেএক প্রাক্তন ব্যাঙ্ক কর্মচারীর করা এহেন অভিযোগের তদন্ত করছে

 

উপসংহারে বলা যায়, আইনটি চিনা জাতীয় নিরাপত্তা ও উন্নয়নমূলক স্বার্থ বা আইনের লঙ্ঘন হতে পারে এমন কাজের প্রকৃতির পরিধিকে সুনির্দিষ্ট করে না, যা এর বিধানগুলিকে রাজনৈতিক ব্যাখ্যার জন্য বিশেষ ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। স্যাম হিউস্টন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ডেনিস ওয়েং এটিকে বিশ্বের কাছে যতটা না আইনি বিধান’, তার চেয়ে বেশি একটি রাজনৈতিক বিবৃতিবলে বর্ণনা করেছেন। এ ভাবে বৈদেশিক সম্পর্ক আইন এনে চিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তার আইনি ভাণ্ডারে একটি নতুন অস্ত্র যোগ করেছে এবং বৈদেশিক সম্পৃক্ততার উপর পার্টির দখলকে আরও সুসংহত করেছে। এটি পশ্চিমী এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে চিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই তীব্রতর করে তুলবে।

 


কল্পিত মানকিকর অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।

মায়া প্রকাশ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ইন্টার্ন।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.