Published on Dec 05, 2021 Updated 0 Hours ago

তিনটি কৃষি আইন রদ করার সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ের সূচনা করতে চলেছে যেখানে আগামী ২৫ বছর কোনও রাজনৈতিক দলই কৃষিক্ষেত্র সংস্কারের চেষ্টা করবে না।

কৃষি আইন নিয়ে মোদীর মতবদল: ভারতের আর্থিক সংস্কারের ইতিহাসে বড় ধাক্কা

ভারতের কৃষিক্ষেত্র সংস্কারের সিদ্ধান্ত থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরে আসার পাঁচটি নিহিতার্থ সুস্পষ্ট। এই প্রচেষ্টা থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্তটি দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর মোদী তিনটি কৃষি আইন — দ্য ফার্মারস প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট ২০২০, দি এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০২০ এবং দ্য ফার্মারস (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাশিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট ২০২০ বাতিল করার কথা ঘোষণা করেন। মোদীর অন্য সব ঘোষণার মতো এই বিপরীত পন্থা অবলম্বনের ঘোষণাটিও সময় বুঝেই করা। পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের ঠিক আগেই গুরু নানক জয়ন্তীর দিন এ রকম ঘোষণা সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে এক ধর্মীয় রং দিয়েছে।

প্রথমত গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জি এস টি) প্রণয়নের পরে এটি মোদীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী এক সংস্কারের প্রচেষ্টা। জি এস টি চালু করার ফলে ভারতে যে ভাবে পরোক্ষ করের চরিত্র বদল হয়েছে, কর দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সহজতর হয়েছে এবং তার গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে (যদিও এখনও বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটির সংস্কারের প্রয়োজন), ঠিক সে ভাবেই প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি আইন কৃষিক্ষেত্রে সেই চাষিদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারত যাঁরা স্বচ্ছল নন এবং যাঁদের বড় জোত নেই। ১৯৯১ সালে শিল্প নীতি নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওয়ের বিবৃতি উৎপাদন এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এনেছিল, মোদীর প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি আইন কৃষিক্ষেত্রে তেমনটা করতে পারত। এই মতবদলের সবচেয়ে দুঃখজনক দিকটি হল, সিদ্ধান্তটির ফলে আরও একটি প্রজন্মব্যাপী ভারতের কৃষিক্ষেত্রটি ধনী কৃষক, ব্যবসায়ী এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কুক্ষিগত হয়ে থাকবে। কোনও রাজনৈতিক দলই আগামী ২৫ বছর এই সংস্কারের কাজে আর হাত দেবে না। এটি ভারতের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি।

এই মতবদলের সবচেয়ে দুঃখজনক দিকটি হল, সিদ্ধান্তটির ফলে আরও একটি প্রজন্মব্যাপী ভারতের কৃষিক্ষেত্রটি ধনী কৃষক, ব্যবসায়ী এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কুক্ষিগত হয়ে থাকবে। কোনও রাজনৈতিক দলই আগামী ২৫ বছর এই সংস্কারের কাজে আর হাত দেবে না।

দ্বিতীয়ত, যাঁরা এই তিনটি কৃষি আইনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, তাঁরা এখন পরিত্যক্ত বোধ করছেন। শুধু মাত্র মন্ত্রিসভা বা সাংসদরাই নন, তৃণমূল স্তরের বিজেপি কর্মীরাও এখন থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর জারি করা বিবৃতি সম্পর্কে নিশ্চয়তার বদলে সংশয়ে ভুগবেন। সর্বভারতীয় বিজেপি নেতৃত্বকে তাঁদের দলের কর্মীদের পুনরায় উৎসাহিত করতে বেগ পেতে হবে অনেক বেশি। বর্তমানে এই কর্মীদের আবেগ রাজনৈতিক সমীকরণের নিচে চাপা পড়েছে। এঁদের মধ্যে অনেক কর্মীই ঘুরে দাঁড়াবেন এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে শুরু করবেন। কিন্তু এ বার থেকে তাঁরা এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন যে, তাঁদের বেছে নেওয়া পথ তাঁদেরকে এক রাজনৈতিক খাদের কিনারায় পৌঁছে দিতে পারে। ফলে এই কর্মীরা রক্ষণশীল হয়ে পড়বেন এবং রাজনৈতিক সাবধানতা অবলম্বন করবেন। আগামী দিনে কী ভাবে তাঁরা ব্লক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্নের সম্মুখীন হন, এখন সেটাই দেখার।

তৃতীয়ত, যাঁরা প্রথম থেকেই প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি আইনের বিরোধিতা করেছিলেন, এই সিদ্ধান্তে তাঁদের মনে নতুন বলের সঞ্চার হবে। এবং তাঁরা আগামী দিনে আরও বেশি দাবি জানাবেন। মূলত কৃষক নেতা এবং তাঁদের সহযোগী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব-সহ যে মানুষরা এত দিন এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তাঁরা সহজে সন্তুষ্ট হবেন না। এ বার তাঁরা আরও চাপ বাড়াবেন এবং করদাতাদের উপরে শোষণের মাত্রা বাড়বে। ধনী কৃষক, মহাজন, ব্যবসায়ী বা আড়তদার এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা এ বার আরও বেশি মুনাফা দাবি করবেন। পাশাপাশি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে আইনি শিলমোহর দিয়ে তাঁরা সেই সব শস্যমূল্যের স্ফীতি ঘটিয়ে নিজেদের মুনাফা সুনিশ্চিত করতে চাইবেন যেগুলি দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হলেও সুলভ মূল্যে পাওয়া সম্ভব হত। ফলে করদাতারা পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের এই অবস্থাপন্ন এবং অকর্মণ্য জমির মালিকদের জীবনযাত্রার খরচ নির্বাহ করতে বাধ্য হবেন।

চতুর্থত, এই অবস্থান বদলের মাধ্যমে পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে কি রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করা সম্ভব হবে? সম্ভবত নয়। সেই সব নেতাই নির্বাচনী সুবিধে পাবেন, যাঁরা এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই নেতারা কৃষক মৃত্যুর আবেগকে কাজে লাগাবেন, জনমানসে মৃত কৃষকদের শহিদ করে তুলবেন এবং মৃত্যুর মতো হৃদয়বিদারক ঘটনাকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করবেন। বিজেপি এত কিছুর পরেও হয়তো উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে জয়লাভ করবে কিন্তু এই মত বদল সে রাজ্যে বিরোধী পালেও হাওয়া লাগাবে। পাশাপাশি ভোটারদের মনে বিজেপির অপরাজেয়তা নিয়েও সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করবে। প্রস্তাবিত কৃষি আইনগুলি বাতিল না করা হলেও পঞ্জাব কখনওই বিজেপির আয়ত্তাধীন ছিল না এবং পঞ্জাবে নির্বাচনে যদি বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তা হলে তা আশ্চর্যের হবে। প্রসঙ্গত, এ কথা উল্লেখযোগ্য যে, কৃষি আইন রদের ঘোষণা করার আগেও এ বছরের শুরুতে বিজেপি অসমে দ্বিতীয় বারের জন্য নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, প্রস্তাবিত আইন এবং ভোট পাওয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক নেই অর্থনীতি এবং রাজনীতির। এটি নিঃসন্দেহে নির্বাচনের একাধিক আঙ্গিকের মধ্যে একটি।

যদি তিনি সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সি এ এ) নিয়ে অবস্থান বদল না করে থাকেন, তা হলে প্রস্তাবিত কৃষি আইন নিয়ে তাঁর এ রূপ মনোভাব পরিবর্তনের কারণ কী? তবে কি এই পদক্ষেপ সি এ এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বদলেরও পূর্বাভাস? মোদী কি তাঁর বিশেষত্ব হারাতে বসেছেন? ভারত সে ব্যাপারে ২০২৪ সালে তার মতামত জানাবে।

পঞ্চমত, যাঁরা কৃষিক্ষেত্র সংস্কারে কী হয় দেখার অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁরা এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে মোদীর যে কোনও ধরনের সংস্কারের চেষ্টার বিরোধিতা করবেন। যেমন ভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে তাঁকে পরাজিত করার কৌশল বলে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমন ভাবেই মোদী তাঁর প্রতিপক্ষের হাতে নিজের দুর্বলতার চাবিকাঠি তুলে দিয়েছেন। নিজের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে তিনি যেন বিরোধীদের প্রতিরোধ সংক্রান্ত হিংসা এবং স্বেচ্ছাচারিতাকে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি বিক্ষোভকারীদের আশ্বাস দিলেন যে শহরের রাস্তাঘাটে শান্তি বজায় রাখতে এবং ব্যালট বক্সে এগিয়ে থাকার মূল্য চোকাতে তিনি চুপ করে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করতে পারেন। তাঁর এই মত বদলের ফলে তিনি বিক্ষোভকারীদের জয়ই শুধু সুনিশ্চিত করেননি, পাশাপাশি গরিব কৃষকদের আরও এক বার এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেট কমিটির শোষণের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এটি এমন একটি কমিটি যা ২০১৮-২০১৯ সালের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন এগ্রিকালচারের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘রাজনীতি, দুর্নীতি এবং আড়তদার ও মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের একচ্ছত্র আধিপত্যের আঁতুড়ঘর’ হয়ে উঠেছে।

যে বিষয়টি সবচেয়ে ধন্দ জাগায় তা হল এই যে, মোদী — যিনি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণের পর থেকে অভূতপূর্ব দৃঢ়তার সঙ্গে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সূচনা করেছেন এবং ডিমনিটাইজেশন, জি এস টি, কোভিড-১৯ অতিমারির মোকাবিলা এবং সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি নিয়ে একাধিক কড়া সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হননি — কেন প্রস্তাবিত কৃষি আইনগুলি নিয়ে এ হেন বিপর্যয়কর অবস্থান বদলের সিদ্ধান্ত নিলেন, যখন তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্ত গরিব কৃষকদের সশক্তিকরণ এবং ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রের ভাবমূর্তির আমূল পরিবর্তন করতে পারত। যদি তিনি সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সি এ এ) নিয়ে অবস্থান বদল না করে থাকেন, তা হলে প্রস্তাবিত কৃষি আইন নিয়ে তাঁর এ রূপ মনোভাব পরিবর্তনের কারণ কী? তবে কি এই পদক্ষেপ সি এ এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বদলেরও পূর্বাভাস? মোদী কি তাঁর বিশেষত্ব হারাতে বসেছেন? ভারত সে ব্যাপারে ২০২৪ সালে তার মতামত জানাবে।

যাঁরা এই বিষয়ে বিশেষ অবগত নন, তাঁদের জন্য উল্লেখ্য যে, প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি আইন স্বাধীনতার পর থেকে এখনও পর্যন্ত কৃষিক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ সংস্কারগুলির অন্যতম। এই আইনগুলি সংস্কারক হিসেবে মোদীর ভাবমূর্তিকে আরও সুদৃঢ় করতে পারত। এই প্রস্তাবিত আইনগুলি সংসদের অভ্যন্তরে এবং বাইরে ২০ বছর ব্যাপী আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক এবং পর্যালোচনার ফসল। (‘অ্যান ইন্টেলেকচুয়াল বায়োগ্রাফি অফ ইন্ডিয়াজ নিউ ফার্ম লজ’ নিয়ে পড়তে ক্লিক করুন।)

সমগ্র বিরোধিতার প্রক্রিয়াটিতে সেই চাষিদের স্বার্থের কথা এক বারের জন্যও ভাবা হয়নি, যাঁরা আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল নন এবং বিশাল পরিমাণ জমির মালিক নন। তাঁর অবস্থান বদলের ফলে মোদী এই কৃষকদের আরও ২৫ বছরের জন্য অর্থনৈতিক শোষণের মুখে ঠেলে দিলেন। ফলে এই কৃষকরা তিন দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। প্রথমত, তাঁরা মান্ডির বাইরে গিয়ে অধিক মূল্যে তাঁদের কৃষিজ উৎপাদন বিক্রি করার সুবিধে হারালেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণের’ যুগে ফেরত যেতে বাধ্য হলেন যেখানে পচনশীল শস্য মজুত রাখার জন্য তাঁদের গুদামের চড়া মূল্য চোকাতে হবে। এবং তৃতীয়ত, শোষণকারী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁরা আর কোনও সুরক্ষা কবচ পাবেন না

কৃষকদের জন্য এটি একটি দুঃখের দিন; এবং এর ফলে আগামী ২৫ বছর কৃষিক্ষেত্র সংস্কারের প্রেক্ষিতে একটি হতাশাজনক সময় আসতে চলেছে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.