অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহটি ভারতীয় কূটনীতির সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাশিয়ায় ব্রিকস সম্মেলনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সাক্ষাতের মাধ্যমে বিদ্যমান উত্তেজনা হ্রাস করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই বৈঠকের ঠিক আগেই সাউথ ব্লক ঘোষণা করেছিল যে, উভয় পক্ষ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর টহলদারি ব্যবস্থাপনায় সম্মত হয়েছে। এই সব কিছুই চার বছর ধরে চলতে থাকা উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক সংঘাতের অবসান ঘটানোর এক উদ্যোগকে দর্শায়। ২০২০ সালে এই সংঘাতের সূত্রপাত হয় যখন বেজিং একতরফা ভাবে এলএসি বরাবর স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করে এবং এর দরুন ভারত ও চিন উভয় পক্ষের সেনারই মৃত্যু হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমে বৈঠকের বিষয়টি প্রতিক্রিয়ার ঝড় তুললেও চিনা ম্যান্ডারিনরা তেমন গুরুত্ব না দিয়ে জানিয়েছে যে, ‘কার্যকর ভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নয়াদিল্লির সঙ্গে কাজ করতে’ তাঁরা একটি ‘সমাধানে পৌঁছেছেন।’
এলএসি সঙ্কট এই বৃহত্তর সমস্যাটির উপরেও জোর দিয়েছে যে, উভয় দেশকে অবশ্যই অনির্ধারিত সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।
ভারতের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলিও এই ঘটনাপ্রবাহের মূল্যায়ন করার সময় সতর্ক থেকেছে। সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী পিপলস লিবারেশন আর্মি-র (পিএলএ) ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের পূর্ববর্তী অবস্থানে ফেরত যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন এবং একই সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলি লঙ্ঘন করে সীমান্তের সামরিকীকরণের সমস্যাটি সমাধান করার জন্য চিনের সক্রিয়তার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এলএসি সঙ্কট এই বৃহত্তর সমস্যাটির উপরেও জোর দিয়েছে যে, উভয় দেশকে অবশ্যই অনির্ধারিত সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে সীমানা প্রসঙ্গে বিশেষ প্রতিনিধি অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করার পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। এই শর্ত পূরণের মাধ্যমেই চিন আসলে চিন-ভারত সম্পর্কের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। সর্বোপরি, চিনকে ‘বিশ্বাস’ করার আগে ‘যাচাই’ করে নেওয়ার বর্তমান মনোভাবের দরুন সরেজমিনে ভারত-চিন প্রতিযোগিতার নিখুঁত চিত্র পেতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। কথায় আছে, সব ভাল যার শেষ ভাল। কিন্তু এই সমগ্র পর্ব থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলিকে গুরুত্ব না দিয়ে সমগ্র বিষয়টিকেই খারিজ করে দেওয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। প্রথমত, এ কথা বোঝা দুষ্কর যে, ঠিক কী কারণে চিন একতরফা ভাবে এলএসি বরাবর স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। একই ভাবে বেজিংয়ের পশ্চাদপসরণের প্রেরণার কারণ বোঝাও কঠিন।
যাই হোক, চিনা ব্যবস্থার উপর চাপের পরিমাণ বাড়ছে। ২০২০ সালে চিন ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছয়, যখন দেশটি উহানে কোভিড-১৯ অতিমারিকে সীমাবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিল। এর পর দেশটি সংক্রমণে জর্জরিত বিশ্বের বহু অংশের সঙ্গেই উহানের তুলনা করে। এই সব কিছুই চিনের বিজয়বাদ সম্পর্কিত বাগাড়ম্বরকে সুদৃঢ় করেছে, যা হয়তো বেজিংকে এলএসি বরাবর সংঘর্ষে প্ররোচিত করেছিল। ২০২৪ সালে চিন এখনও ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে তার নিজস্ব পদ্ধতিজনিত অর্থনৈতিক চাপে জর্জরিত। ত্রৈমাসিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত অর্থনৈতিক সূচকগুলি দর্শায় যে, চিন তার নিজস্ব লক্ষ্য পূরণের মতো অবস্থায় নেই। এ ছাড়াও নিম্নগামী অর্থনীতির অন্যান্য প্রভাবও বিদ্যমান। যেমন একটি বিপর্যস্ত রিয়েল এস্টেট ক্ষেত্র জিডিপি-র এক চতুর্থাংশ এবং উচ্চ বেকারত্বে অবদান রেখেছে। চিনের জন্য ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পরিবর্তিত হচ্ছে। তার নিজস্ব কৌশলবিদদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, স্বাধীনতামনস্ক উপাদানগুলি – যেমন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং তে – আরও শক্তিশালী হয়েছে। তাঁর প্রথম জাতীয় দিবসের ভাষণে লাই তাইওয়ানের ‘স্বাধীনতা’র উপর জোর দিয়ে বলেছেন যে, বেজিংয়ের কোনও অধিকার নেই তাইপেই-এর প্রতিনিধিত্ব করার। এটি শি-র আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণবাদের উপর প্রভাব ফেলে, যার লক্ষ্য হল প্রয়োজন সামরিক শক্তির মাধ্যমে তাইওয়ানকে চিনের সঙ্গে পুনরায় একত্রিত করা।
ত্রৈমাসিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত অর্থনৈতিক সূচকগুলি দর্শায় যে, চিন তার নিজস্ব লক্ষ্য পূরণের মতো অবস্থায় নেই।
এর পরপরই চিন লাইকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার জন্য যৌথ সামরিক মহড়া চালানোর নির্দেশ দেয়। এই বছর দ্বিতীয় বারের মতো চিন তাইওয়ান প্রণালীর আশপাশে তার যুদ্ধমহড়া চালিয়েছে।
ফিলিপিন্স দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের দাবির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দরুন অন্যত্রও চিন প্রতিরোধের সাক্ষী হচ্ছে। বিষয়গুলি জটিলতর হয়, যখন নবনিযুক্ত জাপানি প্রাইম মিনিস্টার শিগেরু ইশিবা ট্রান্সআটলান্টিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অনুরূপ একটি ‘এশিয়ান ন্যাটো’র প্রস্তাবনা দিয়েছেন। বেজিংয়ের জন্য - যে ওয়াশিংটনের ‘ব্লক রাজনীতি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এসেছে - ইশিবার নতুন নিরাপত্তা পরিকল্পনা এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সাযুজ্য বজায় রাখতে উদ্যোগী দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। এই ঘটনাপ্রবাহ বেজিংয়ের জন্য এলএসি বরাবর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করার চেষ্টায় প্রণোদনা জুগিয়েছে।
মোদী-শি শীর্ষ সম্মেলনের প্রভাব এবং ব্রিকস সম্মেলনে ভারতের কেন্দ্রে উঠে আসা - যা অ্যাংলোস্ফিয়ারে একটি ‘পশ্চিম-বিরোধী’ মঞ্চ হিসাবে পরিচিত – বেশ কিছু মহলে তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষোভ বা ঈর্ষার জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী রাশিয়ার শীর্ষ সম্মেলনে ব্যক্ত করেছেন যে, ব্রিকস ভারতের জন্য একটি অ-পশ্চিমী মঞ্চের বিকল্প এবং গোষ্ঠীটি যে কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে প্রতিস্থাপন করতে চায়, এমন ধারণা পোষণ করা উচিত নয়। পাশ্চাত্য বরাবরই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে মৌখিক ভূমিকা পালন করেছে এবং তা সত্ত্বেও দেশগুলি প্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক উত্থান এবং নতুন উদীয়মান শক্তিগুলির পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ-পরবর্তী একই আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। ভারত পশ্চিম-নেতৃত্বাধীন কোয়াড এবং ব্রিকস গোষ্ঠী উভয়ের সঙ্গেই সহজাত ভাবে মিশেছে এবং এই বিষয়ের উপর জোর দিয়েছে যে, উদীয়মান ভারত অতীতের মতো তার অংশীদারদের আশাহত করবে না এবং তার বাহ্যিক সম্পৃক্ততার গতিপথকে জাতীয় স্বার্থ দ্বারা চালিত হতে দেবে। ব্রিকস-এর মতো মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ভারতকে তার নিজস্ব কণ্ঠস্বরের পাশাপাশি গ্লোবাল সাউথের উদ্বেগগুলিকেই তুলে ধরতে সাহায্য করে। তার অর্থ এই নয় যে, ব্রিকস-এর কোনও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব নেই। নয়াদিল্লির জন্য, ব্রিকস-এর মধ্যে বেজিংয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করা এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। এক দিকে রাশিয়ার সঙ্গে এবং অন্য দিকে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলির সঙ্গে কাজ করা নয়াদিল্লিকে চিনের সঙ্গে একই দক্ষতায় কাজ করতে সাহায্য করবে এবং এর পাশাপাশি উন্নয়নশীল বিশ্বের উদ্বেগগুলিও তুলে ধরবে। কাজান শীর্ষ সম্মেলন দেখিয়েছে যে, দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার জন্য নতুন সুযোগের দ্বার খুলে যেতে পারে। যদি ২০১৭ সালে ব্রিকস-এর শিয়ামেন শীর্ষ সম্মেলন ডোকলামের জট খুলতে সক্ষম হয়, তা হলে কাজান শীর্ষ সম্মেলন গলওয়ানের পরে চিন-ভারত সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের অনুঘটক রূপে কাজ করতে পারে।
এমনটা আশা করা যেতেই পারে যে, ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের জন্য আরও একটি ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের প্রয়োজন হবে না।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.