পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পরপরই ইসলামাবাদ তেহরানের সঙ্গে তার কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা হ্রাস করেছে, সে দেশ থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে এবং ইরানের রাষ্ট্রদূতকে পাকিস্তানে পুনরায় প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। ইসলামাবাদ যে কোনও রকমের আসন্ন উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সফর বাতিল করেছে এবং বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র একাধিক বার ‘বিনা উস্কানি’ ও ‘অবৈধ’ হামলার জবাব দেওয়ার প্রসঙ্গে পাকিস্তানের অধিকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্কটময় প্রেক্ষাপটে, ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আশঙ্কা ও উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক চলছে। একটি সামরিক প্রতিক্রিয়া বা তা না-পাওয়া আসলে পাকিস্তানের ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ইমরান খানের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর অবস্থানকে আরও প্রভাবিত করতে পারে।
ইরান প্রথম পাকিস্তানের উপর আঘাত হানার ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট স্টাফ সদর দফতর দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের সিস্তান বেলুচিস্তান প্রদেশে ‘সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিগুলি’র উপর ‘অত্যন্ত সমন্বিত এবং বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করে সামরিক হামলা’ চালানো শুরু করেছে।
ইরান প্রথম পাকিস্তানের উপর আঘাত হানার ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট স্টাফ সদর দফতর দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের সিস্তান বেলুচিস্তান প্রদেশে ‘সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিগুলি’র উপর ‘অত্যন্ত সমন্বিত এবং বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করে সামরিক হামলা’ চালানো শুরু করেছে। কিছু সূত্র অনুসারে, হামলাগুলি ইরানের ভূখণ্ডের প্রায় ৮০ কিলোমিটার ভিতরে ঘটেছে এবং সারাভান শহরে আঘাত হেনেছে। এর ফলে যে ন’জন নিহত হয়েছেন, তাঁদের সকলেই বিদেশি নাগরিক। আকাশপথে খতিয়ে দেখার পরে যে সব অঞ্চলে বেলুচিস্তান লিবারেশন ফোর্স এবং বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি ছিল, তেমন সাতটি জায়গায় ইরানের তরফে হামলা চালানো হয়েছে। সরকারি বিবৃতিতে ইরানের হামলার উল্লেখ না করে এটিকে একটি ‘গোয়েন্দাভিত্তিক অপারেশন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং ইসলামাবাদ দেশের কিছু ‘অনিয়ন্ত্রিত স্থান’ অর্থাৎ বালোচ সন্ত্রাসবাদীদের উপস্থিতি সম্পর্কে নিজস্ব উদ্বেগগুলি সমাধান করার প্রেক্ষিতে তেহরানের জড়িত থাকার কথা ঠারেঠোরে বুঝিয়েছে। পাকিস্তানের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী দ্বারা সম্ভাব্য বৃহৎ আকারের সন্ত্রাসবাদী হামলাকে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান ‘প্রিএম্পটিভ স্ট্রাইক’ করেছে বা ‘পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে হামলা’ চালিয়েছে।
এই আঘাত হামলার সফল পরিচালনা সশস্ত্র বাহিনীর ‘পেশাদারিত্ব’কেই দর্শায়। ইতিমধ্যেই কারাগারে থাকা ইমরান খানের সমর্থকদের চাপের মুখে নজিরবিহীন হামলার জবাবে সেনাবাহিনীর তরফেও তাদের শক্তি প্রদর্শন জরুরি ছিল। প্রতিশোধমূলক হামলা সেনাবাহিনীর জন্য জনগণের মধ্যে উদ্দীপ্ত অসন্তোষকে প্রশমিত করতে না পারলেও একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়ার অভাব অভ্যন্তরীণ অসুবিধাগুলিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। যেহেতু পাকিস্তান এই মাসেই একটি সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত এবং যেখানে তেহরিক-ই-তালিবান-ই-পাকিস্তানের (টিটিপি) হুমকি এখন ক্রমশ বড় আকার ধারণ করছে, তাই নিরাপত্তা পরিস্থিতির কোনও প্রকারের হ্রাস বা বৃদ্ধি দেশটিকে আরও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এই বৃদ্ধির পরিণতি সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র বলেছেন যে, তাঁরা পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলতে চান না এবং আশা করেন, তাঁদের প্রতিপক্ষরাও এমনটাই করবে। ইরান পাকিস্তানের শার্জ দ্যফেয়ার-কে ডেকে হামলার ‘ব্যাখ্যা’ দাবি করেছে। যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী উচ্চ সতর্কতার মধ্যে রয়েছে, তখন পাকিস্তানের জন্য অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক ভাবে উভয়সঙ্কটের সময় আফগানিস্তান ও ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের এর ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির অবস্থা করুণ। ভারত বলেছে, আত্মরক্ষায় দেশগুলিকে যে পদক্ষেপ করতে হবে, তা সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল এবং পাকিস্তান থেকে উদ্ভূত সন্ত্রাসবাদের হুমকি সম্পর্কে ইরানের বৈধ উদ্বেগের কথা সূক্ষ্ম ভাবে উল্লেখও করেছে ভারত। প্রাথমিক হামলাগুলির প্রভাবে সৃষ্ট সঙ্কটের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে না পড়লেও এবং সীমান্ত জুড়ে দীর্ঘ-বিদ্যমান পার্থক্যের সঙ্গে বিষয়টি সম্পৃক্ত হলেও, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কী ভাবে উদ্ভূত হবে, তা এই সঙ্কটকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে।
আকাশপথে খতিয়ে দেখার পরে যে সব অঞ্চলে বেলুচিস্তান লিবারেশন ফোর্স এবং বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি ছিল, তেমন সাতটি জায়গায় ইরানের তরফে হামলা চালানো হয়েছে।
ইরানের প্রাথমিক হামলাটি এক অদ্ভুত সময়ে ঘটেছে, যখন পরোক্ষ ভাবে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে তা উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। গাজার যুদ্ধ একটি অঞ্চলব্যাপী ভয়কে প্রসারিত করেছে, যা ইতিমধ্যেই তেহরানের সঙ্গে সংযুক্ত প্রক্সি ওয়ার অর্থাৎ ইয়েমেনের হুতিদের দ্বারা লোহিত সাগরের বাণিজ্যিক জাহাজের উপরে হামলা চালানোর মাধ্যমে ঘটছে। এর জবাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চারের মতো হুতি সামরিক সম্পদ লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে।
তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইরানের পদক্ষেপ উপসাগর জুড়ে তার কৌশলগত সমীকরণের সঙ্গে বিশেষ সম্পৃক্ত নয়। পাকিস্তানের অশান্ত বেলুচিস্তান অঞ্চল এবং ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের মধ্যে সীমান্ত বহু বছর ধরে অসন্তোষ ও শত্রুতা বিনিময়ের কেন্দ্র। এই তীব্র মাত্রার আন্তঃআঞ্চলিক সমীকরণ প্রায়শই মূলধারার বিতর্ক তৈরি করে না। কারণ এর প্রকৃতি দ্বিপাক্ষিক এবং এটি তার মূল ভৌগোলিক সমীকরণের মাত্রা অতিক্রম করে খুব কম ক্ষেত্রেই। যাই হোক, জানুয়ারি মাসে প্রত্যক্ষ করা উত্তেজনা ইসলামাবাদ এবং তেহরান উভয় দেশের জন্যই একটি নতুন নজির সৃষ্টি করেছে এবং সম্পর্কের সমীকরণ এক নতুন অন্ধকারে প্রবেশ করেছে।
কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিন ও সৌদি আরব মধ্যস্থতা করা ও উত্তেজনা হ্রাস করার চেষ্টা করেছে। ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সঙ্কটের মূলে রয়েছে জইশ উল-আদল নামক একটি সুন্নি-সালাফি বালোচ জঙ্গি গোষ্ঠী, যা মূলত ইরানের সিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশের আরও স্বায়ত্তশাসন ও বালোচদের অধিকারের লক্ষ্য নিয়ে দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সক্রিয়। সীমান্তের ওপারে জইশের শিবিরগুলি লক্ষ্য করে ইরানি হামলাগুলি চালানো হয় এবং গোষ্ঠীটি স্বীকার করেছিল যে তাদের ঘাঁটিগুলির উপর আক্রমণ চালানো হয়েছে। শত্রুতা শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে জইশ দাবি করেছে যে, তারা ইরানের অভিজাত ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পোরালস (আইআরজিসি) কর্নেল হুসেইন-আলি জাভদানফারের একজন কম্যান্ডারকে হত্যা করেছে।
পাকিস্তানের অশান্ত বেলুচিস্তান অঞ্চল এবং ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের মধ্যে সীমান্ত বহু বছর ধরে অসন্তোষ ও শত্রুতা বিনিময়ের কেন্দ্র।
ইরান ও পাকিস্তান দুই দেশই আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত। যেহেতু দুই দেশের সম্পদই অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ভাবে ইতিমধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত, তাই কেউই নিজেদের মধ্যকার সংঘর্ষকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার পর আর বৃদ্ধি করতে চাইবে না। যাই হোক, এই ঘটনাটি একটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে সংঘাতের আর একটি অবাঞ্ছিত সক্রিয় মঞ্চ প্রদান করেছে। এটি ইতিমধ্যে একাধিক সংঘর্ষ বিন্দুতে জর্জরিত থেকেছে এবং ২০২৪ সালের শুরুতেই তার সমস্যাভাণ্ডারে এক নতুন চ্যালেঞ্জ যোগ করেছে।
শিবম শেখাওয়াত অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের জুনিয়র ফেলো।
কবীর তানেজা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.