যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়মুক্তির অবসান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য বরাবররই অগ্রাধিকারের শীর্ষে থেকেছে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যে দু’টিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হওয়া গণঅপরাধের দোষীদের সাব্যস্ত করা হয়েছিল। পূর্ববর্তী যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একই ভাবে ১৯৯০-এর দশকে সশস্ত্র সংঘাতের সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। তবে, এই বিচার সংস্থাগুলি স্থায়ী আদালত ছিল না। সময় ও পরিসরের সীমাবদ্ধতার কারণে এগুলির প্রভাব ছিল স্থানীয়।
গুরুতর অপরাধের দায়ে দুষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহিতে বাধ্য করার জন্য একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইচ্ছা ১৯৯৮ সালে বাস্তবায়িত হয়েছিল, যখন ১২০টি দেশ রোম সংবিধি মেনে চলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) তৈরি করেছিল। আইসিসির আন্তর্জাতিক ক্ষমতা থাকলেও তার অস্তিত্বের গত দুই দশক বা তারও বেশি সময়ে এটি শুধুমাত্র তৃতীয় বিশ্বের নেতা ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে (প্রধানত আফ্রিকা থেকে) বা যে সব দেশ পশ্চিমের বিরোধিতা করেছে, তাদের দোষী সাব্যস্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বুরুন্ডির মতো কয়েকটি দেশ রোম সংবিধি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা প্রত্যাহার করার হুমকি দিয়েছে।
পূর্ববর্তী যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একই ভাবে ১৯৯০-এর দশকে সশস্ত্র সংঘাতের সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইজরায়েলের প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং ইজরায়েলের প্রাক্তন ডিফেন্স মিনিস্টার ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার (পিটিসি) দ্বারা জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা এই প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ। গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে ইজরায়েলের চ্যালেঞ্জকে অগ্রাহ্য করে পিটিসি ‘বিশ্বাসযোগ্য কারণ খুঁজে পেয়েছে’, যেখানে দেখা গিয়েছে যে, নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট গাজায় যুদ্ধের মাধ্যম হিসাবে ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২০ মে পর্যন্ত হত্যা, নিপীড়ন ও অন্যান্য অমানবিক অন্যায়ের পাশাপাশি অনাহার ও হত্যার মতো মানবতা-বিরোধী অপরাধের দায়ে দুষ্ট। ২০২৪ সালের মে মাসে এই গ্রেফতারি পরোয়ানার অনুরোধ করেন আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খান।
আইসিসির ইতিহাসে এই প্রথম বারের মতো এই গ্রেফতারি পরোয়ানা এমন এক নেতার বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে, যিনি পশ্চিমী দেশগুলির ঘনিষ্ঠ। আশ্চর্যজনক ভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (ইউএস) আইসিসির এই গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাখ্যান করেছে।
অনাক্রম্যতা এবং এক্তিয়ার
এ ক্ষেত্রে দু’টি প্রাথমিক প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। প্রথমত, আইসিসি কী ভাবে রাষ্ট্রপ্রধানদের বিচার করতে পারে, যাঁরা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিদেশি বা আন্তর্জাতিক আদালতে ফৌজদারি কার্যক্রম থেকে অনাক্রম্যতা পেয়েছেন? উত্তরটি রোম সংবিধির ২৭(১) অনুচ্ছেদেই লুকিয়ে রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘সরকারি ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে কোনও পার্থক্য ছাড়াই আইনটি সকল ব্যক্তির জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য হবে।’ এটিতে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান, সরকার বা পার্লামেন্ট সদস্য, একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা কোনও অবস্থাতেই একজন ব্যক্তিকে অপরাধমূলক দায়বদ্ধতা থেকে অব্যাহতি দেবে না।’ রোম সংবিধির অনুচ্ছেদ ২৭(২)-এ আরও জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, সরকারি ক্ষমতার কারণে একজন ব্যক্তির সঙ্গে সংযুক্ত অনাক্রম্যতা – তা সে আন্তর্জাতিক বা পৌর আইনের অধীনেই হোক না কেন - আইসিসিকে এমন ব্যক্তির উপর এক্তিয়ার বর্তাতে কোনও বাধা দেবে না। জর্ডাল রেফারেল রে আল-বশির আপিল মামলায় আইসিসি এই নীতিটি বহাল রেখেছে, যার সিদ্ধান্ত ২০১৯ সালে নেওয়া হয়েছিল।
এই নীতি অনুসারে, যদি কোনও অপরাধ আইসিসি সদস্য দেশের ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়, তা হলে আদালত সেই অপরাধকে নিজের এক্তিয়ারে আনতে পারে, এমনকি যদি অপরাধী দেশ আইসিসি সদস্য দেশ না-ও হয়।
পরবর্তী প্রাথমিক প্রশ্নটি হল, আইসিসি কী ভাবে ইজরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে, যখন ইজরায়েল নিজেই আইসিসির সদস্য নয়। উত্তরটি রোম সংবিধির ১২(২)(ক) অনুচ্ছেদে দেওয়া হয়েছে, যেখানে আঞ্চলিক বিচারব্যবস্থার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এই নীতি অনুসারে, যদি কোনও অপরাধ আইসিসি সদস্য দেশের ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়, তা হলে আদালত সেই অপরাধকে নিজের এক্তিয়ারে আনতে পারে, এমনকি যদি অপরাধী দেশ আইসিসি সদস্য দেশ না-ও হয়। যেহেতু প্যালেস্তাইন আইসিসি-র সদস্য, তাই গাজায় ইজরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ এই আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। একই ভাবে, ইজরায়েলের মাটিতে হামাসের আচরণও আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে, যার কারণে আইসিসি ইজরায়েলি ভূখণ্ডে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য হামাস নেতা মোহাম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরির বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
ভবিতব্য কী?
অতীতের নজির অনুসারে, ইজরায়েলি নেতাদের গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করে তোলার জন্য আইসিসি-র কাছে হস্তান্তর করার বিষয়টি খুব অসম্ভাব্য। উদাহরণস্বরূপ, আইসিসি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল। যাই হোক, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি, যদিও গত ১৮ মাসে তাঁর আন্তর্জাতিক ভ্রমণের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর কারণ হল আইসিসি এক বার কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে, সমস্ত ১২৩টি আইসিসি সদস্য দেশের (যাতে ভারত অন্তর্ভুক্ত নয়) এই আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে যে, যখনই অভিযুক্ত ব্যক্তি তাদের এক্তিয়ারে আসবেন, তখনই দেশটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেফতার করবে এবং তাঁকে আইসিসি-র হাতে তুলে দিতে হবে। এ কথা লক্ষ্যণীয় যে, প্রেসিডেন্ট পুতিন ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মঙ্গোলিয়া ভ্রমণ করেছিলেন, যেটি একটি আইসিসি সদস্য হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি।
আইসিসি ২০০৯ সাল থেকে সুদানে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
একই ঘটনা ঘটেছে সুদানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের ক্ষেত্রে। আইসিসি ২০০৯ সাল থেকে সুদানে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর বশির চাদ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জর্ডানের মতো আইসিসি সদস্য দেশগুলিতে ভ্রমণ করলেও কোনও দেশই তাঁকে গ্রেফতার করেনি। এই পুরো বিষয়টি আসলে দু’টি জিনিসকেই দর্শায়। প্রথমত, আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার বিষয়টি সদস্য দেশগুলির করুণাসাপেক্ষ। আইসিসির নিজস্ব পুলিশ বাহিনী নেই, যা মোতায়েন করে ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা সম্ভব। যদি দেশগুলি সহযোগিতা না করে, তা হলে আইসিসির পক্ষে নিজে থেকে গ্রেফতার করা সম্ভবই নয়। দ্বিতীয়ত, যে দেশগুলি গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে ব্যর্থ হয়, তারা প্রায়শই উল্লেখযোগ্য আইনি মূল্য পরিশোধ না করেই পার পেয়ে যায়।
এই ভাবে দুই ইজরায়েলি নেতার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বাস্তবিক প্রভাব হল এই যে, এ হেন পরোয়ানা অন্তত আইসিসি সদস্য দেশগুলিতে তাঁদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণকে ব্যাপক ভাবে সীমিত করে দেবে। এমনকি নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টকে গ্রেফতার করে বিচারের মঞ্চে হাজির করার জন্য আইসিসি-র কাছে হস্তান্তর অকল্পনীয় হলেও, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আন্তর্জাতিক আইনে নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এটি ইজরায়েলের জন্য একটি বড় আইনি ও কূটনৈতিক ধাক্কাও বটে, বিশেষ করে গত বছরে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত দু’টি প্রধান আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে। প্রথমত, আইসিজে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে পূর্ব জেরুজালেমের মামলা-সহ পলিসিজ অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস অফ ইজরায়েল ইন দ্য অকুপায়েড প্যালেস্তানিয়ান টেরিটোরি (অধিকৃত প্যালেস্তাইনি ভূখণ্ডে ইজরায়েলের নীতি ও অনুশীলন) থেকে উদ্ভূত আইনি পরিণতি অনুযায়ী অধিকৃত প্যালেস্তাইনি ভূখণ্ড (ওপিটি) ইজরায়েলের অব্যাহত জবরদখল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও ইজরায়েলকে যত দ্রুত সম্ভব ওপিটি থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বারা উত্থাপিত একটি মামলায় আইসিজে রায় দিয়েছিল যে, গাজায় গণহত্যার নেপথ্যে ইজরায়েলের চাতুর্য রয়েছে। এ কথার সত্যতা অবশ্য আইনি ভাবে নির্ধারিত হয়নি। সংক্ষেপে বললে, দুই ইজরায়েলি নেতার বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানার জের গ্রেফতারে না পৌঁছলেও এ হেন ঘোষণা আসলে দর্শায় যে, ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনের ফাঁস আরও শক্ত হচ্ছে।
প্রভাস রঞ্জন ও পি জিন্দাল গ্লোবালের জিন্দাল গ্লোবাল ল স্কুলের অধ্যাপক ও ভাইস ডিন (কন্টিনিউং এডুকেশন)।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.