Published on Apr 11, 2023 Updated 0 Hours ago

গণতান্ত্রিক কল্যাণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময় লাগলেও এটিতে একটি খারাপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা এবং তা সংশোধনের সুযোগ থাকে।

ভাল গণতন্ত্র, খারাপ গণতন্ত্র এবং অগ্রগতির সন্ধান

এই প্রতিবেদনটি রাইসিনা ফাইলস ২০২৩ সিরিজের অংশ।


ভারতকে প্রায়শই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসাবে বর্ণনা করা হয়। সেই গণতন্ত্রের রূপগুলি তার বর্তমান আকারে সংবিধান-নির্ধারিত কাঠামোর মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ভারত বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্রগুলির মধ্যেও অন্যতম। এর গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যগুলি সহস্রাধিক বছর প্রাচীন[১] এবং সভা ও সমিতির আকারে প্রকাশিত যার সমান্তরাল উদাহরণ প্রাচীন গ্রিস এবং রোমেও খুঁজে পাওয়া যায়। এই দুই সত্তার মধ্যে পার্থক্য এবং তাদের নিজ নিজ ভূমিকা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী এর আখ্যানও পরিবর্তিত হয়। সহজ কথায় বললে, সমিতিটি ছিল একটি সাধারণ সমাবেশের মতো, যেখানে প্রতিটি পরিবার থেকে প্রতিনিধিত্ব করা হত। অন্যদিকে সভা একটি কার্যনির্বাহী সমিতির অনুরূপ ছোট দল, যার বিচারবিভাগীয় কার্যাবলিও ছিল।[২]> সভা আসলে সমিতির একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ।

আধুনিক রাষ্ট্রগুলির মতো এই প্রাচীন যৌথ সংস্থাগুলি অংশগ্রহণ, আলোচনা এবং বাণিজ্যের বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম ছিল। এই সিদ্ধান্তগুলিই পরিণতির দিকে ত্বরান্বিত করে এবং এমন পরিস্থিতি বিরল যেখানে একটি সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই ইতিবাচক হয়। যদি পরিস্থিতি X এমন একটি ফলাফলের দিকে চালনা করে যা প্রত্যেকের জন্য পরিস্থিতি Y-এর চেয়ে ভাল, তা হলে অর্থনীতিবিদরা X-কে Y-এর চেয়ে ‘পারেতো সুপিরিয়র’ বা ‘উন্নততর সমাজনীতি’ বলে ব্যাখ্যা করেন। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উন্নততর পারেতো লব্ধ করা কঠিন। যে কোনও সিদ্ধান্তই কারও জন্য লাভ এবং অন্যের জন্য ক্ষতি ডেকে আনে। সেগুলি একে অপরের সঙ্গে তুলনা করা দরকার এবং সমাজের নিরিখে সামগ্রিক লাভ (বা ক্ষতি) পরিমাপ করা জরুরি। সুতরাং, কল্যাণমূলক অর্থনীতিতে ক্ষতিপূরণ নীতির উপর তাত্ত্বিক কাজকর্মের একটি অংশ রয়েছে। ক্ষতিপূরণ কার্যকর করা যেতে পারে কি না তা লাভ বা ক্ষতির আন্তঃ-ব্যক্তিগত (বা আন্তঃ-গৃহস্থালী) তুলনা করার প্রয়োজন রয়েছে। এটি কার্যত অসম্ভব। কারণ যে কোনও ব্যক্তিরই শুধুমাত্র আন্তঃ-ব্যক্তিগত তুলনাই নয়, সংখ্যাগত মূল পরিমাপও প্রয়োজন। শুধুমাত্র ক্রমিক পরিমাপ এবং আনুমানিক একটি যুক্তিসঙ্গত ধারণার ভিত্তিতে যে কোনও মানুষই কেনেথ অ্যারোর প্রাথমিক কাজ দ্বারা সোশ্যাল চয়েজ দ্বারা বর্ণিত সমস্যাগুলির সম্মুখীন হন।[৩]

অ্যারোর প্রাথমিক পসিবিলিটি / ইমপসিবিলিটি উপপাদ্য স্বতঃসিদ্ধের সেই যুক্তিসঙ্গত ধারণা দ্বারাই সংজ্ঞায়িত, যা একজন স্বৈরাচারীর অস্তিত্বের দিকেই চালনা করে। অ্যারোর অনুমানের শিথিলকরণ প্রাথমিক সমস্যা থেকে দূরে সরে না গিয়ে অনুক্রম এবং অভিজাততন্ত্রের দিকে পরিচালিত করেছে — অর্থাৎ সমষ্টিগত সংস্থার দ্বারা ব্যক্তিগত পছন্দগুলিকে একত্র করা। গণতন্ত্র তা দিয়েই তৈরি।

কিছু কিছু সিদ্ধান্ত প্রকৃতিগতভাবেই অন্য সিদ্ধান্তের তুলনায় জটিল হয়। সমষ্টিগত সংস্থার আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্তগুলিও জটিলতর হয়ে ওঠে। সমসাময়িক শব্দার্থে একটি সভা প্রতিনিধি গণতন্ত্র এবং একটি সমিতি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের কথাই তুলে ধরে। বিশুদ্ধভাবে দেখতে গেলে স্থানীয় সিদ্ধান্ত ব্যতীত প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র খুব কমই কাজ করে। সম্মিলিত সংস্থাটি অংশগ্রহণ, আলোচনা এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুব বড় ভূমিকা গ্রহণ করে। আধুনিক রাষ্ট্রগুলি এভাবে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে গিয়েছে, এমনকি বহুবার উদ্ধৃত সুইস শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের একটি চরম উদাহরণ হল গণভোট। কিন্তু একটি গণভোট তখনই কার্যকর হয়, যখন কোনও সিদ্ধান্ত নির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের যুগ্ম সম্ভাবনার উপরে নির্ভরশীল হয়; ব্রেক্সিট গণভোট তেমনই একটি ঘটনা। তবে যৌথ সিদ্ধান্ত প্রায়শই বিরল হয়, যেখানে ভাল-মন্দ নিয়ে আলোচনা করতে হয় এবং যা প্রায়শই দ্বিমুখী প্রকৃতির হয়।

পঞ্চায়েতি রাজ কাঠামোর পার্থক্যকে তুলে ধরে। এর নামকরণটি সারা দেশে সামান্য পরিবর্তিত হলেও একটি জেলা পরিষদ (জেলা-স্তর), পঞ্চায়েত সমিতি (ব্লক-স্তর) এবং একটি গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ (গ্রাম-স্তর) একটি ত্রিস্তরীয় কাঠামো রয়েছে। প্রাক-স্বাধীনতা ঔপনিবেশিক বিবেচনা এবং স্বাধীনতা-উত্তর পরিকল্পনা অগ্রাধিকার দ্বারা চালিত ভারতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে সম্পূর্ণ পৃথক যুক্তি প্রদর্শন করে। বেশ কয়েকটি কমিশন এবং কমিটি এটিকে চিহ্নিত করেছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিকেন্দ্রীকরণকে রাজস্ব হস্তান্তরের ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়েছে।[৪] এটি কেন্দ্র থেকে রাজ্য এবং রাজ্যগুলির মধ্যে স্থানীয় প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়।[৫]> ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোয় কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় সরকার রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যই কেন্দ্র, রাজ্য এবং স্থানীয়… যৌথ সিদ্ধান্তের জন্য সর্বোত্তম স্তর রয়েছে। ঊর্ধ্ব এবং নিম্ন স্তর উভয় ক্ষেত্রই সর্বোচ্চ নয় এবং এর নেপথ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি হল যে বর্তমান কাঠামো অত্যধিক মাত্রায় কেন্দ্রীভূত এবং সর্বোচ্চ নয়।[৬] যদিও বর্তমানে এ প্রশ্নও জাগছে: একবার যে স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, তা স্থির হয়ে গেলে, সমগ্র যৌথ সংস্থা কি সিদ্ধান্ত নিতে একত্র হয়, না কি এটি সাধারণ সংস্থার একটি নির্বাচিত উপ-সেট? গ্রামের স্তরে গ্রাম সভা হল সাধারণ প্রশাসনের পরিপূরক অংশ। তবে সিদ্ধান্তগুলি সাধারণত নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েত দ্বারা গৃহীত হবে, যার তথ্য পরবর্তী সময়ে গ্রামসভার কাছে উপলব্ধ হবে।

অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে গণতন্ত্র শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে, প্রত্যক্ষভাবে নয়। প্রসঙ্গের কিছুটা বাইরে বেরিয়ে দেখলে এটি ওলসনের প্যারাডক্স ছাড়া আর কিছুই নয়।[৭] বড় দলগুলি তর্ক-বিতর্ক করে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ছোট দল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দ্রুত। এর একটি কারণ হল দক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তথ্যের লভ্যতা প্রয়োজন, যা সর্বদা বড় গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯৭৪ এবং ১৯৯৮ সালে পোখরান পরীক্ষার আগে কি একটি গণভোট অনুমেয় ছিল? বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে থাকলে কি কেউ গণভোট বেছে নিতে পারে? ব্যুৎপত্তিগত ভাবে গণতন্ত্র মানে জনগণের শাসন। তবে জটিল সমাজে জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসন করে না, বরং পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তা হয়।

বর্তমানে দেশগুলিকে একাধিক সূচকের সাহায্যে ক্রমান্বিত করাই দস্তুর হয়ে উঠেছে। তবুও এই সূচকগুলি প্রায়শই মূল্য বিচারকে প্রতিফলিত করে। সূচককে মাথায় রেখে শ্রেণিবদ্ধ করা, তাদের গুরুত্ব নির্ধারণ করে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য একটি সূচক তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে এই ক্ষেত্রগুলির গুরুত্ব নির্ধারণ করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট দেশ বা রাষ্ট্রের জন্য সূচকের মূল্য লাভ করে। এভাবে কিছু পরিমাণ করতে এবং পরিমাপ করার ক্ষেত্রে সাফল্য আসে, যা প্রায়শই অপরিমেয় এবং অস্পষ্ট এবং এমন একটি দৃঢ়তা দর্শায়, যা আদতে বিদ্যমান নয়। উদ্দেশ্যমূলক তথ্য উপলব্ধ না হলে এটি খারাপতর হয়ে ওঠে। নমুনার ছোট আকার নির্বিশেষে উপলব্ধিভিত্তিক প্রশ্নাবলি পরিচালনা করা হয়, উত্তরদাতাদের একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করতে বলা হয়, সেগুলিকে যোগ করে একটি সামগ্রিক মূল্য প্রদান করা হয়। জননীতি সংক্রান্ত একাধিক ক্ষেত্রে এমনটা করা হয়ে থাকে এবং তাদের দ্বারা উল্লিখিত বিষয়গুলিতে অধ্যয়নের স্বচ্ছতার অভাব দেখা যায়। গণতন্ত্রের জন্য ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এমন একটি সংস্থা, যা অসাধ্য সাধনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০২২ সালের ক্রম অনুযায়ী, র‍্যাঙ্কিংয়ে ফ্রান্সের মতো ভারতকে একটি ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।[৮] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসাবেও বর্ণনা করা হয়েছে। ব্রিটেনকে একটি ‘সম্পূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হলেও এর গণতন্ত্রের সাম্প্রতিক কার্যকারিতায় কিছু ত্রুটি প্রকাশ্যে এসেছে, যা বাইরের লোকের কাছেই স্পষ্ট। কানাডা হল একটি ‘সম্পূর্ণ গণতন্ত্র’ – এমন একটি দেশ যেখানে আদিবাসীদের (পুরুষ ও মহিলা উভয়) ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। ভারতে সংবিধানের বাস্তবায়নের পর ১৯৫১-৫২ সালে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।  সকল প্রাপ্তবয়স্ককে সর্বজনীন ভোটাধিকার দেওয়া হয়।

ইআইইউ-এর মতে, অস্ট্রেলিয়া হল একটি ‘সম্পূর্ণ গণতন্ত্র’। তবুও এটি ১৯৬২ সালে আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের ভোট দেওয়ার অনুমতি দেয়। ‘সম্পূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ আর একটি দেশ সুইজারল্যান্ডে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মহিলারা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দান করতে পারত না।

এই ধরনের সমীক্ষা যে কথাই তুলে ধরুক না কেন, তার কিছু বিষয় সুস্পষ্ট। প্রথমত, ভারতে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য হাজার হাজার বছর পুরনো। সম্ভবত এই কারণেই তার কিছু নিকটবর্তী প্রতিবেশীর বিপরীতে হেঁটে ভারতে নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র বজায় থেকেছে – ১৯৭৫ সালের জুন মাস থেকে ১৯৭৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত জরুরি অবস্থার সময়টুকু বাদ দিলে। দ্বিতীয়ত, শহুরে অভিজাতদের নিষ্ঠুরতা এবং অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও ভারতে নির্বাচনের সব স্তর জুড়ে মতদানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আন্তর্দেশীয় তুলনায় ২০১৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে ভারতে ভোট দানের পরিমাণ ছিল ৬৭.৪ শতাংশ। ইআইইউ দ্বারা ‘সম্পূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ ব্রিটেনে ২০১৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দানের পরিমাণ ছিল ৬৭.৫৫ শতাংশ।[৯]

তৃতীয়ত, প্রতিটি দেশের প্রত্যেক নাগরিক এবং প্রতিটি ভোটারের নিজের দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কার্যপদ্ধতি ও তার ত্রুটি সম্পর্কে অভিযোগ থাকে। কিন্তু তা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনও যুক্তি নয়। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকে প্রায়শই অক্সিজেনের সঙ্গে তুলনা করা হয় এবং একমাত্র তার অনুপস্থিতিতেই এর মর্ম বোঝা যায়। যেমনটা উইনস্টন চার্চিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে হাউস অফ কমন্সে তাঁর দেওয়া একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন: ‘একাধিক ধরনের সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং এই কষ্টজর্জর পৃথিবীতে আরও সরকার ক্ষমতায় আসবে। কেউ এমনটা মনে করেন না যে, গণতন্ত্র নিখুঁত বা সর্বজ্ঞানী। প্রকৃতপক্ষে এটা বলা যেতে পারে যে, গণতন্ত্র হল বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষিত অন্য সব ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাদে প্রশাসনের নিকৃষ্টতর রূপ।’[১০]

প্রশ্ন রয়ে যায়, গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি না। শুরুতে, উভয় শব্দবন্ধ — ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘উন্নয়ন’ — বিভিন্ন ব্যাখ্যাসাপেক্ষ এবং একাধিক গবেষণায় বিভিন্ন দেশব্যাপী এই দু’টির আন্তঃসম্পর্কের উপরে পরীক্ষা চালানো হয়েছে।

একটি পর্যায়ে, কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে গণতন্ত্র নিজেই একটি অন্তিম পন্থা। এটি এমন একটি মূল্য যা অর্জনের জন্য মানুষ প্রচেষ্টা চালাবে এবং শুধুমাত্র উন্নয়নের পথে শেষতম উপায় নয়। একটি ইতিবাচক পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে বলে ধরে নেওয়া হলেও এই পারস্পরিক সম্পর্ক কার্যকারণকে দর্শায় না। গণতন্ত্রের দক্ষ কার্যকারিতা উন্নততর উন্নয়ন ফলাফলের দিকে চালিত করতে পারে; উন্নততর উন্নয়নের ফলাফল একটি ভাল কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্ব জুড়ে গণতন্ত্রের অভাব থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটেছে।

বহিরাগত কিছু উপাদান দ্বারা সৃষ্ট হওয়ার ফলে এই দুইয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক অসত্য হতে পারে। এমনটা গণতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত আর একটি শব্দ – ‘প্রশাসন’-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রশাসনিক সূচকের সেটটি – কণ্ঠস্বর এবং দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং হিংসা/সন্ত্রাসবাদের অনুপস্থিতি, সরকারের কার্যকারিতা, নিয়ন্ত্রক গুণমান, আইনের প্রশাসন এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মতো ছ’টি মাত্রার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।[১১] বিভিন্ন দেশব্যাপী সমস্যা সম্পর্কে আগে যা বলা হয়েছিল তার সাপেক্ষে, এই মাত্রাগুলি গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে সমাপতন ঘটায়। এ কথা বলার পর আন্তর্দেশীয় অভিজ্ঞতামূলক গবেষণা দর্শায় যে, গণতন্ত্র উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বা পর্যাপ্ত শর্ত নয়। এমনকি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা উন্নয়নের জন্যও তা সহায়ক নয়। পূর্ব এশিয়া থেকে নির্বাচিত প্রমাণ, চিন এবং ভিয়েতনাম অন্তর্ভুক্ত বা কর্তৃত্ববাদী তেল-সমৃদ্ধ দেশগুলি গণতান্ত্রিক কল্যাণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময় লাগলেও এটিতে একটি খারাপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা এবং তা সংশোধনের সুযোগ থাকেএই প্রস্তাবটিকে দর্শায় না।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, স্বৈরাচারী প্রক্রিয়ার তুলনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধীর। তার অর্থ এই নয় যে, একটি কর্তৃত্ববাদী সিদ্ধান্তই সর্বোচ্চ। গণতান্ত্রিক কল্যাণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময় লাগলেও এটিতে একটি খারাপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা এবং তা সংশোধনের সুযোগ থাকে। সুতরাং ‘গণতন্ত্র কর’-এর মতো অভিব্যক্তি শুধুমাত্র একপাক্ষিকই হয়। ‘গণতন্ত্র ভর্তুকি’র মতো একটি উপাদানও রয়েছে।

সিইউটিএস ইন্টারন্যাশনাল ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট এবং ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের সম্মুখে নির্বাচিত মামলাগুলির অর্থনৈতিক প্রভাব পরীক্ষা করেছে। পাঁচটি ক্ষেত্রে অধ্যয়ন করে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, ভারতে প্রায় ৭৫০০০ জন মানুষ এই সিদ্ধান্তগুলির ফলে বিরূপভাবে প্রভাবিত হন এবং প্রায় ১৬০০০ কর্মী তাঁদের কাজ হারিয়েছিলেন। ‘সরকার প্রায় ৮০০০ কোটি টাকার রাজস্ব পায়নি, যে পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হলে এবং মূলধনী ব্যয় হিসাবে বিনিয়োগ করা সম্ভব হলে তা ২০০০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারত। শিল্প ক্ষেত্রে এর দরুন রাজস্ব বাবদ প্রায় ১৫০০০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে এবং উল্লিখিত সময়কালে কর্মীরা প্রায় ৫০০ কোটি টাকার উপার্জন হারিয়েছেন।’[১২] এ বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য কোনও বিচারগত প্রসারের বিরুদ্ধে যুক্তি এবং যথাযথ বিচারগত প্রভাব মূল্যায়ন করতে বিচারবিভাগের ব্যর্থতার সঙ্গে সহানুভূতিশীল হওয়া দরকার।[১৩]

যে কোনও গণতন্ত্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান কোনগুলি? সংবিধান রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গকে বর্ণনা করে: কেন্দ্রীয় ও রাজ্য-স্তরের সরকার উভয় ক্ষেত্রেই আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচারবিভাগ। এগুলি সব ক্ষেত্রেই নির্বাচিত নয়। যেমন বিশ্ব ব্যাঙ্কের সূচকগুলিকে ব্যাখ্যা করে ‘প্রশাসন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তেমন শাসনব্যবস্থাকে অবশ্যই সরকারের চেয়ে অধিক প্রসারিত হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে প্রশাসন ও গণতন্ত্র নাগরিক, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে জড়িত করে এবং সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতিতে (অনুচ্ছেদ ৫১ক)[১৪] নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যগুলিও উল্লেখ করে।

ভারতে একটি সমৃদ্ধশালী নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যম রয়েছে যা তথাকথিত সম্পূর্ণ গণতন্ত্রে তাদের অনুরূপ ব্যবস্থার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম। নাগরিকরা রাষ্ট্রের অঙ্গগুলির অপূর্ণ কার্যকারিতার দিকে আঙুল তোলার অধিকার রাখেন। এগুলি উলটো চাপ হিসাবে কাজ করে। বিশেষ করে একটি অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর)[১৫] এবং পিআরএস আইনি গবেষণার[১৬] কথা উল্লেখ করা উচিত। এই ধরনের অনুশীলনগুলি স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতার উন্নতি ঘটাতে পারে এবং তাদের লক্ষ্য হল সংসদের কার্যক্রম।[১৭] তারা নির্বাচিত না হওয়ার কারণে নির্বাহী ও বিচারবিভাগের তুলনামূলকভাবে কম নিরীক্ষণ করা হয়।

সমালোচনা স্বাভাবিক হলেও দু’টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা জরুরি। প্রথমত, অন্যান্য দেশের মতো ভারতও একটি পরোক্ষ ও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র। যদি কেউ প্রশাসনের প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ণ করে, তা হলে তা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে দুর্বলতর করে তোলে। দ্বিতীয়ত, বাইরের দিকে আঙুল তোলা ছাড়াও অন্তর্মুখী অনুসন্ধান চালানোও জরুরি যাতে ব্যক্তি ও উদ্যোগগুলি তাদের নিজস্ব পরিধির মধ্যে গণতন্ত্র গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সর্বোপরি, এ কথা মনে রাখা উচিত যে, সংবিধানের প্রস্তাবনা শুরু হয় ‘আমরা জনগণ’ শব্দবন্ধ দিয়ে।

প্রকৃতপক্ষে আমরা, এ দেশের জনগণ, হাজার হাজার বছর ধরে ভারতে গণতন্ত্র গড়ে তুলেছি। স্বভাবতই গণতন্ত্র ভাল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেই গণতন্ত্রের সাধনা এবং এর পরিপূর্ণতার অন্বেষণকেই অগ্রগতির সাধনী বলা যেতে পারে। এর অপূর্ণতাগুলিকে ‘খারাপ’ বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ভারতীয়ের কাছে গণতন্ত্র অনালোচনাযোগ্য বা তর্কাতীত।


পাদটীকা

[১] এই সূত্রগুলির কিছু নথিভুক্ত করা হয়েছে: দ্য মাদার অফ ডেমোক্রেসি, সম্পাদনা রঘুবেন্দ্র তানওয়ার এবং উমেশ অশোক কদম (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ, ২০২২)-এ।

[২] ঋগ্বেদের বর্ণনায় লিঙ্গ পক্ষপাতের কোনও প্রমাণ নেই।

[৩] কেনেথ জে অ্যারো, সোশ্যাল চয়েস অ্যান্ড ইন্ডিভিজুয়াল ভ্যালুস (ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫১)।

[৪] প্রথম প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন (১৯৬৬), রাজমান্নার কমিটি (১৯৬৯), সরকারিয়া কমিশন (১৯৮৩), দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন (২০০৫) এবং পুঞ্চি কমিশন (২০০৭) এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। পুঞ্চি কমিশনকে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের কমিশন বলা হয়, যা কেন্দ্রে একটি কেন্দ্র এবং পরিধিতে রাজ্যগুলির জন্য পরামর্শ প্রদান করে। সংবিধানে ‘ইউনিয়ন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, ‘কেন্দ্র’ নয়। যদিও ‘কেন্দ্র’ শব্দবন্ধটি নিয়মিত ব্যবহৃত হয়।

[৫] রাজ্যগুলি পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠান (পিআরআই) এবং শহুরে স্থানীয় সংস্থাগুলির (ইউএলবি) কাছে হস্তান্তর করতে অনিচ্ছুক। মূলত ১৯৩৫ সালের ভারত সরকারের আইনের উপর ভিত্তি করে সংবিধানের সপ্তম তফসিল সংশোধন করার একটি বিস্তৃত বিষয়ও রয়েছে।

[৬] রাষ্ট্র গঠনের স্পর্শক সম্পর্কিত যুক্তিও বিদ্যমান। রাজ্যগুলি প্রশাসনিক নীতির ভিত্তিতে গঠিত হয়নি – রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সময় বা পরবর্তী কালে নয়।

[৭] এই অর্থে যে গোষ্ঠীর আকার গুরুত্বপূর্ণ, মানকুর ওলসন, দ্য লজিক অফ কালেকটিভ অ্যাকশন (হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৫)-এর বক্তব্য। ওলসন জনসাধারণের পণ্য সরবরাহে আগ্রহী ছিলেন।

[৮] আ নিউ লো ফর গ্লোবাল ডেমোক্র্যাসি, দি ইকনমিস্ট, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২২

[৯] ভোটার টার্নআউট বাই কান্ট্রি ২০২৩, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ

[১০] ‘দি ওয়র্স্ট ফর্ম অব গভর্নমেন্ট’, উইনস্টন চার্চিল। অভিব্যক্তিটি ইঙ্গিত করে যে, ‘প্রকৃতপক্ষে বলা হয়েছে’ চার্চিল মৌলিক হওয়ার পরিবর্তে একটি প্রচলিত চিন্তার ব্যাখ্যা এবং উদ্ধৃত করেন।

[১১] ওয়ার্ল্ডওয়াইড গভর্ন্যান্স ইন্ডিকেটরস, বিশ্ব ব্যাঙ্ক

[১২] সিইউটিএস ইন্টারন্যাশনাল, ইকনমিক ইমপ্যাক্ট অব সিলেক্ট ডিসিশনস অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অ্যান্ড ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল অফ ইন্ডিয়া, ২০২২। পাঁচটি মামলার মধ্যে তিনটি সুপ্রিম কোর্ট এবং দু’টি ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের আওতাধীন।

[১৩] এটির আইনি প্রভাব মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সঠিক।

[১৪] ১৯৭৭ সালে সন্নিবেশ।

[১৫] অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস

[১৬] পিআরএস লেজিসলেটিভ রিসার্চ

[১৭] উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উৎপাদনশীলতা, নির্বাচনী হলফনামা, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং অপরাধীদের রাজনীতিকরণ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.