অন্তত এক দশক যাবৎ অভিবাসন ইউরোপীয় রাজনীতিতে একটি জ্বলন্ত প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে, যা মতাদর্শগত বৈচিত্র্যের দক্ষিণপন্থী দলগুলিকে রীতিমতো খোরাক জুগিয়েছে। ইউরোপের অভিবাসী জনসংখ্যা ২০১০ সালে ৮.৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ১০ শতাংশ হয়েছে। এই পরিস্থিতি ফ্রান্সেও একই রকম এবং এই সমস্যাটি দীর্ঘকাল ধরে ফরাসি রাজনীতির অংশ হয়ে থেকেছে।
ডিসেম্বর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অভিবাসন এবং আশ্রয় নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছনোর ঠিক পরে ফরাসি পার্লামেন্ট অবৈধ অভিবাসন মোকাবিলার উদ্যোগে অভিবাসন পদ্ধতি সংস্কারের জন্য একটি আইন পাস করে। প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর এই অভিবাসন বিলের আগের যে আরও নমনীয় সংস্করণটির খসড়া শ্রমসাধ্য ভাবে ১৮ মাস যাবৎ করা হয়েছিল, তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দেওয়া হয়। অবশেষে অতি দক্ষিণপন্থীদের মন জুগিয়ে চলার জন্য পার্লামেন্টে পাস হওয়া সংস্করণটিকে যথেষ্ট কঠোর করা হয়।
ইউরোপের অভিবাসী জনসংখ্যা ২০১০ সালে ৮.৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ১০ শতাংশ হয়েছে। এই পরিস্থিতি ফ্রান্সেও একই রকম এবং এই সমস্যাটি দীর্ঘকাল ধরে ফরাসি রাজনীতির অংশ হয়ে থেকেছে।
ফ্রান্স ঐতিহ্যগতভাবে তার উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কল্যাণ ব্যবস্থার জন্য পরিচিত। এবার সেখানে শ্রমের ঘাটতিতে জর্জরিত কর্মক্ষেত্রগুলির জন্য অস্থায়ী বসবাসের অনুমতি দেওয়ার সময় বিলটি কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অভিবাসীদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসার জন্য কঠোর শর্ত, অভিবাসীদের জন্য বার্ষিক কোটা, ফরাসি নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিতে অগ্রাধিকারমূলক লভ্যতা ও কল্যাণমূলক সুবিধা, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ভিসা মূল্য, অপরাধে অভিযুক্ত দ্বৈত নাগরিকদের ফরাসি নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা, ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারীদের সরাসরি নাগরিকত্বের অধিকার হ্রাস করা এবং অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বহিষ্কার করার জন্য একটি সহজ প্রক্রিয়ার প্রবর্তন।
‘মৃত্যু চুম্বন’
ফ্রান্সের বিতর্কিত পেনশন সংশোধনের বিপরীতে - যা ২০২৩ সালের মার্চ মাসে পার্লামেন্টকে বাইপাস করেছিল এবং বিশেষ সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে অগণতান্ত্রিক ভাবে আরোপ করা হয়েছিল - অভিবাসন বিল নিম্ন কক্ষে ভোট পেয়েছে। কঠোর আইনটির পক্ষে ৩৪৯টি ভোট এবং বিপক্ষে ১৮৬টি ভোট পড়েছে, যেখানে ম্যাক্রোঁর নিজস্ব রেনেসাঁ পার্টি ও তার মধ্যপন্থী জোটের অনেকেই বিলটির বিরোধিতা করেছেন বা মতপ্রকাশে অনুপস্থিত থেকেছেন। অন্য দিকে, অতি-দক্ষিণপন্থী ৮৮ জন সদস্য বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন এবং তাঁদের জোরালো সমর্থন জানিয়েছেন। ফরাসি গণমাধ্যমের অনেকেই এই পদক্ষেপটিকে অতি দক্ষিণপন্থী বিরোধী নেতা মেরিন লে পেনের ‘কিস অব ডেথ’ বা ‘মৃত্যু চুম্বন’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর দল ন্যাশনাল র্যালি বিলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার পর এই প্রাথমিক ধারণা দানা বেঁধেছে।
ম্যাক্রোঁ গণতান্ত্রিক ভাবে আইন পাস করতে পেরেছিলেন, যা তার দ্বিতীয় ম্যান্ডেটের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তবে আপসের সূচকগুলি এর চেয়ে খারাপ হতে পারত না।
ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অরেলিয়েঁ রুসো পদত্যাগ করলে গ্রিন পার্টির ইয়ানিক জাবোট বিলটিকে ফ্রান্সে ট্রাম্পবাদের আগমন বলে উল্লেখ করেছেন।
একটি সমীক্ষার ফলাফল দর্শিয়েছে যে, ফরাসি নাগরিকদের মধ্যে ম্যাক্রোঁর নিজস্ব ৮৭ শতাংশ সমর্থকদের পাশাপাশি মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষ নতুন বিলটিকে সমর্থন করলেও ৭৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে, বিলটি লে পেনের ধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। এর ফলে অতি দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে ম্যাক্রোঁর সমর্থনকারীদের জন্য এক ব্যাপক ‘মতাদর্শগত বিজয়ের’ সম্ভাবনার কথাও অস্বীকার করা যায় না। লে পেনের আশ্চর্য অভ্যুত্থান ও বিলে যে কঠোর পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে তা ম্যাক্রোঁর জোটের বামপন্থী সদস্যদের ক্ষুব্ধ করেছে এবং ম্যাক্রোঁর উপর অভিযোগ আনা হয়েছে যে, তিনি অতি দক্ষিণপন্থীদের চাপের মুখে বশ্যতা স্বীকার করেছেন এবং ফরাসি প্রজাতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন। তদুপরি বিলটির মধ্যে অতি-দক্ষিণপন্থীদের বিশ্বাসকে অন্তর্ভুক্ত করার ঘটনা সেই সমর্থকদের ক্ষুব্ধ করেছে, যাঁরা অতি দক্ষিণপন্থীদের বিকল্প হিসেবে ম্যাক্রোঁর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এবং সেই ক্ষুব্ধ সদস্যরা বর্তমানে অতি দক্ষিণপন্থীদের ধারণাকে প্রতিহত করার বদলে সেই ভাবনারই ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে ওঠার দোষে ম্যাক্রোঁকে অভিযুক্ত করছেন। ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অরেলিয়েঁ রুসো পদত্যাগ করলে গ্রিন পার্টির ইয়ানিক জাবোট বিলটিকে ফ্রান্সে ট্রাম্পবাদের আগমন বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া, প্রক্রিয়াটি ২০২২ সালের নির্বাচন থেকে ম্যাক্রোঁর দুর্বল ম্যান্ডেটের সঙ্গে সংযুক্ত শাসন সংক্রান্ত অসুবিধাগুলিকেও উন্মোচিত করেছে, যা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষতির কারণ হয়েছিল। জুন মাসে নির্ধারিত ইইউ নির্বাচনের আগে যেখানে ইউরোস্কেপ্টিক দলগুলি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে, সেখানে নতুন অগ্রাধিকারের দিকে মনোনিবেশ করার আশায় এই পুরো ঘটনাটি একটি সরকারি রদবদল এবং ফরাসি প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ বোর্নের পদত্যাগের প্ররোচনা দিয়েছে।
অতি দক্ষিণপন্থীদের মূলধারায় আনা
অভিবাসন বিষয়ে কঠোর জনমতের মধ্যে ভোটারদের উদ্বেগ প্রশমিত করার প্রচেষ্টায় সর্বস্তরে দলগুলি অভিবাসনের সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে, যা অতি দক্ষিণপন্থীদের খোরাক জুগিয়েছে। এই ভাবে অতি দক্ষিণপন্থীদের আলোচ্য বিষয়গুলি কেন্দ্রের বার্তাতেও উঠে আসার ঘটনাটি সমগ্র ইউরোপীয় রাজনীতি জুড়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি এমন একটি ঘটনা, যেখানে মূলধারাটি পুনরায় ভাষা খুঁজে পেয়েছে এবং অতি দক্ষিণপন্থীদের রাজনীতিকে বৈধতা দিচ্ছে।
আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না বা সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য বলটি এ বার ফ্রান্সের সাংবিধানিক আদালতের কোর্টে।
ম্যাক্রোঁর জন্যও এটি প্রথম বার নয় যে, তিনি রাজনৈতিক ভাবে টিকে থাকার জন্য অতি-দক্ষিণপন্থীদের আখ্যানকে জায়গা করে দিয়েছেন বা অনুকরণ করেছেন এবং ২০২৩ সালে ইসলাম বিষয়ে তাঁর ক্রমবর্ধমান কট্টরপন্থী বক্তব্যেও এ কথা ভীষণ ভাবে স্পষ্ট। ফ্রান্সের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পরে ম্যাক্রোঁ ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে স্কুলে মুসলিম আবায়া বা বোরখা পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না বা সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য বলটি এ বার ফ্রান্সের সাংবিধানিক আদালতের কোর্টে। এ ছাড়াও, ফ্রান্স-সহ ইউরোপীয় দেশগুলি যখন অভিবাসন রোধ করছে, তারা একই সঙ্গে ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যার সম্মুখীন হচ্ছে এবং অভিবাসী শ্রমেরও যে প্রয়োজন রয়েছে, সেই বিষয়টি ভুলে গেলেও চলবে না।
যেহেতু ফ্রান্স অভিবাসন বিষয়ে ক্রমশ দক্ষিণপন্থী অবস্থান গ্রহণ করছে, তাই ম্যাক্রোঁ ফরাসি রাজনীতির সবচেয়ে বিতর্কিত প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক ভাবে একটি আইন পাস করতে সক্ষম হতে পারেন। কিন্তু উদার গণতন্ত্রের একজন রক্ষক এবং অতি-দক্ষিণপন্থীদের মধ্যপন্থী বিকল্প হিসেবে ম্যাক্রোঁর নিজের ভাবমূর্তি যে ক্ষুণ্ণ হয়েছে, সে কথা অস্বীকার করার আর কোনও অবকাশ নেই।
শায়রী মলহোত্র অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.