ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লি ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে তৃতীয় বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপের জন্য সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে এসেছিলেন। পার্লি ও ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং প্রতিরক্ষা শিল্প সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা ও প্রতিরক্ষা প্ল্যাটফর্মের যৌথ উৎপাদন সহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। দুই মন্ত্রী দুই দেশের সেনাবাহিনী পর্যায়ের সহযোগিতার পর্যালোচনাও করেছেন, যা অতিমারির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ক্রমশ জোরালো হয়েছে। এ ছাড়াও, দুই মন্ত্রী একাধিক স্তরে, বিশেষ করে আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক মঞ্চে, সহযোগিতার মাত্রা আরও বাড়াতে সম্মত হয়েছেন। এই ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ফ্রান্স এখন ইন্ডিয়ান ওশন নেভাল সিম্পোজিয়াম–এর সভাপতি এবং ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করবে।
ভারতে ফরাসি দূতাবাস একটি বিবৃতিতে বলেছে যে ‘এই সফরটি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে ফ্রান্সের কর্মতৎপরতা ও ফরাসি কৌশলগত ভাবনায় ভারতের কেন্দ্রীয় স্থানকে তুলে ধরেছে’। বিবৃতিতে অতিমারির মধ্যেও ভারত-ফ্রান্সের সামরিক যোগাযোগের সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছে – জানুয়ারিতে ডেজার্ট নাইট ২১, এপ্রিলে বরুণা ও নভেম্বরে শক্তি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই বিবৃতিতে ‘সব ধরনের আধিপত্যবাদ প্রত্যাখ্যান করা’ ও আইনের শাসন বজায় রাখার প্রতি দায়বদ্ধতার উল্লেখ করা হয়েছে, এবং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এর লক্ষ্য চিন।
ভারত ও ফ্রান্স প্রতিরক্ষা, মহাকাশ ও অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্র সহ বেশ কয়েকটি কৌশলগত ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে এসেছে। এখন তারা তা প্রসারিত করেছে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে, যেমন ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্রমবিকাশশীল কৌশলগত গতিশীলতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সুপারকম্পিউটিং, সাইবার ও মহাকাশ নিরাপত্তা।
দু’দেশের আস্থা, বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব কোন স্তরে রয়েছে তা স্পষ্ট করে দিয়ে ফরাসি মন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গেও দেখা করেছেন। মোদি টুইট করে বলেন যে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ঘটনাবলি ও ইইউ-এর ফরাসি নেতৃত্ব সহ নানা বিষয়ে কথোপকথন হয়েছে। ঐতিহ্যগত ভাবে ভারত ও ফ্রান্স প্রতিরক্ষা, মহাকাশ ও অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্র সহ বেশ কয়েকটি কৌশলগত ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে এসেছে। এখন তারা তা প্রসারিত করেছে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে, যেমন ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্রমবিকাশশীল কৌশলগত গতিশীলতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সুপারকম্পিউটিং, সাইবার ও মহাকাশ নিরাপত্তা।
যে তিনটি দেশের সঙ্গে ভারতের মহাকাশ নিরাপত্তা সংলাপ চলছে তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পরে ফ্রান্স সর্বশেষতম। একদিকে যেমন ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে কয়েক দশক ধরে অসামরিক মহাকাশ ক্ষেত্রে সহযোগিতা রয়েছে, তেমনই তারা পরিবর্তনশীল মহাকাশ সুরক্ষা গতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগেরও শরিক। মন্ত্রীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ‘‘লক্ষ্য হল বিপদ সংক্রান্ত মূল্যায়ন ভাগ করে নেওয়া, আমাদের প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত কৌশলগুলির সমন্বয়, এবং মহাকাশ যাতে মুক্ত ও নিরাপদ থাকে তা নিশ্চিত করতে যৌথ ভাবে আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি গড়ে তোলা। আমরা এক সঙ্গে উপগ্রহ তৈরি করি, কাজেই এটা স্বাভাবিক যে সেগুলির সুরক্ষার জন্য এক সঙ্গে কাজ করব।”
বহুপাক্ষিকতাকে জোরদার করা ও নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলিতে ভারত-ফ্রান্সের দায়বদ্ধতা ও ঐকমত্যও এই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। একটি সাক্ষাৎকারে পার্লি জোর দিয়েছেন যে অওকাস–এর মতো নতুন ব্যবস্থা ভূগোল পাল্টে দিতে পারে না, এবং ফ্রান্স একটি ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশই থাকবে। তিনি ফ্রান্সের ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলে ভারতের গুরুত্বের কথা আবার বলতে গিয়ে যোগ করেন যে ‘আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এই বছর গুরুত্বপূর্ণ বিমান, নৌ ও সেনা মহড়া করে আন্তঃকার্যক্ষমতার নতুন স্তরে পৌঁছেছে’।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও প্যারিস জলবায়ু বৈঠকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি ব্যবসা–বাণিজ্যে চিন যে কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, সে কথাও মন্ত্রী উল্লেখ করেন।
মন্ত্রী চিন সম্পর্কে উদ্বেগের কথা স্বীকার করেছেন, তবে সেই সঙ্গেই বলেছেন, ‘‘এটি একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য যা অবশ্যই খুঁজে পেতে হবে। চিন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এমন বেশ কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে সহযোগিতার কথা ভাবা যেতে পারে ও তা নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।” জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও প্যারিস জলবায়ু বৈঠকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে চিন যে কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, সে কথাও মন্ত্রী উল্লেখ করেন। কিন্তু তার পরেও পার্লি দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের কর্মকাণ্ড ‘ক্রমশ বেশি আক্রমণাত্মক’ হয়ে উঠছে বলে উল্লেখ করতে দ্বিধা করেননি।
ফরাসি মন্ত্রীর সফরের যা প্রধান বিষয় ছিল সেই প্রতিরক্ষা শিল্প সহযোগিতার বিষয়ে, খবর অনুযায়ী, ফরাসি মন্ত্রীকে সিং বলেছেন যে হয় ফরাসি সংস্থাগুলি ‘ভারতীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে সহযোগিতা করুক, অথবা ভারতে উৎপাদন করুক’। পার্লি বলেছেন যে ফ্রান্স অতিরিক্ত রাফাল যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন মেটাতে ভারতকে সহায়তা করতে প্রস্তুত, এবং ভারতীয় নির্মাতাদের বিশ্বের বিস্তৃত সরবরাহ শৃঙ্খলে অন্তর্ভুক্ত করে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগকে শক্তিশালী করার জন্য তারা ভারতের সঙ্গে কাজ করবে।
ফ্রান্স ইতিমধ্যেই সাবমেরিনের মতো প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে। ভারতে একটি নিরাপত্তা ফোরামে বক্তৃতা করার সময় পার্লি আরও বলেছেন ‘‘ভারতের যে কোনও অতিরিক্ত প্রয়োজন বা অনুরোধে সাড়া দিতে আমরা প্রস্তুত। আমরা জানি যে শীঘ্রই একটি বিমানবাহী জাহাজ এসে যাবে।(এরপর) বিমান দরকার।’’ ভারতের নিজের তৈরি নতুন বিমানবাহী জাহাজ, আইএনএস বিক্রান্ত, ২০২২ সালের আগস্টে কাজ শুরু করতে চলেছে৷ ভারত ইতিমধ্যেই বিমান বাহিনীর জন্য এখনই ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কিনেছে, যার মধ্যে ৩৩টি ভারতকে দেওয়া হয়েছে এবং বাকি তিনটি ২০২২ সালের প্রথম দিকে দেওয়া হবে।
এই সক্রিয়তাভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে ভারতের একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা। ভারত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ইন্দো–প্যাসিফিক মিনিস্টেরিয়াল ফোরামেরও অংশ হবে।
ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব নিলে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, তা ভারতের কাছেও আগ্রহের বিষয়। পার্লি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে কৌশলগত স্বাধীনতার মতো ধারণাগুলির প্রতি ভারতীয় ও ফরাসিদের আকর্ষণের কারণে ইইউ ভারতের ‘স্বাভাবিক অংশীদার’ হয়ে থাকবে। তিনি বলেন যে ইইউ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হবে এবং ‘সংযোগ, পরিবেশ রক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাস্তব সমাধানের জন্য নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়াবে’। এই সক্রিয়তাভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে ভারতের একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা। ভারত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ইন্দো-প্যাসিফিক মিনিস্টেরিয়াল ফোরামেরও অংশ হবে।
ফ্রান্স ভারতের অন্যতম বিশ্বস্ত কৌশলগত অংশীদার হিসেবে থেকে গেছে, এবং অনেক বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। চিন থেকে উদ্ভূত বিপদের মোকাবিলার জন্য ভারতের সক্ষমতার বিকাশে ফ্রান্সের ভূমিকা খুবই বাস্তব, কারণ এই অঞ্চলে তার বস্তুগত ঝুঁকি রয়েছে। গালওয়ান সংঘর্ষ ও ক্রমাগত প্রতিকূল ভারত-চিন সম্পর্কের কারণে ভারত ও ফ্রান্স আগামী বছরগুলিতে আরও বেশি অর্থপূর্ণ ভাবে তাদের নিরাপত্তা ও কৌশলগত যোগাযোগ জোরদার করবে বলে আশা করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতের কৌশলগত ইতিহাসে কোনও নেতিবাচক ঐতিহাসিক বোঝা ফ্রান্সের নেই; আর তাই নয়াদিল্লি ফ্রান্সের সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ যত বেশি ঘনিষ্ঠ করে তুলতে পারবে ততই বেশি করে রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.