এক ‘প্রথাবিরুদ্ধ ঘটনা’য় নেপালের প্রাইম মিনিস্টার কেপি শর্মা অলি জুলাই মাসে ক্ষমতা গ্রহণের পর তাঁর প্রথম সরকারি সফর শুরু করেছিলেন। তাঁর পূর্বসূরিদের বিপরীতে হেঁটে - যাঁরা সাধারণত প্রথমে নয়াদিল্লি সফরে যেতেন - অলি চিন সফর করেছিলেন। অলি ও তাঁর ৮৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং প্রিমিয়ার লি কিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই সফরটিকে অনেকেই নেপালের বিদেশনীতির এক কৌশলগত ‘পদক্ষেপ’ বলে বিবেচনা করেছিলেন, যা দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারত থেকে চিনের প্রতি এক স্পষ্ট স্থানান্তরকেই দর্শায়। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, অবকাঠামো এবং জনসংযোগের বিষয়ে মোট ১২টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) কথা এক-আধ বার উল্লিখিত হলেও উভয় পক্ষই সংযোগ উদ্যোগটিকে কেন্দ্র করে একটি পৃথক অবকাঠামো সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
প্রথম অবকাঠামো চুক্তি স্বাক্ষরের সাত বছর পর নেপালে বিআরআই প্রকল্পগুলি স্থবির অবস্থায় রয়েছে। প্রাথমিক ভাবে, বিআরআই-এর অধীনে উন্নয়নের জন্য ৩৫টি প্রকল্প নির্ধারণ করা হলেও চিনের প্রভাবের দরুন সংখ্যাটি নয়টিতে নামিয়ে আনা হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে প্রায়শই পরিবর্তনশীল সরকারের পাশাপাশি প্রকল্পগুলির জন্য অর্থায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে উদ্বেগ এবং বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করতে নেপাল সরকারের অনীহা বিআরআই-এর অধীনে প্রকল্পগুলিকে অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান সরকার ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটি বিআরআই সম্পর্কিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য চাপের মধ্যে রয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউনিফায়েড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) বা সিপিএন (ইউএমএল) নেপালি কংগ্রেসের (এনসি) সঙ্গে অংশীদারিত্বে ক্ষমতাসীন জোট যে কোনও রকম অগ্রগতিকেই কঠিন করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে বিআরআই-তে আর একটি অবকাঠামো সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
অলির প্রস্থানের আগে ক্ষমতাসীন জোট ঐকমত্য অর্জনের জন্য এবং বিআরআই নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছতে একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করেছিল, যাতে সেটির কথা তাঁর সফরে উল্লেখ করা যায়। সফর-পূর্ববর্তী একটি বৈঠকে অলি এ কথাও বলেছিলেন যে, নেপাল সফরের সময় কোনও ঋণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না এবং বিআরআই নিয়ে মতবিরোধের কারণে জোটের উপর সম্ভাব্য চাপের গুজবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। যৌথ বিবৃতি প্রকাশের একদিন পর নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নেপালের বিদ্যমান আশঙ্কাকে দূর করার লক্ষ্যে উভয় পক্ষ বিআরআই প্রকল্পগুলির জন্য অর্থায়নের বিষয়ে একটি মধ্যম পন্থায় আসেন। নেপাল যখন বিবৃতিতে ‘অনুদানের অর্থায়ন সহযোগিতার মাধ্যম’-এর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল, তখন চিন কেবল ‘সহকারী অর্থায়নের পদ্ধতি’র উপর গুরুত্ব দিয়েছে। চূড়ান্ত চুক্তিতে উচ্চ সুদের হার-সহ চিনা ঋণের বিষয়ে উদ্বেগ মোকাবিলার জন্য ‘সহায়তা অর্থায়ন’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যান্য বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সুদের হার-সহ একটি প্রকল্প অনুদান বা একটি রেয়াতি ঋণের জন্য দেশটি আদৌ যোগ্য হবে কি না… সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রকল্প থেকে প্রকল্পের নিরিখে পরিবর্তিত হবে। এই অস্পষ্টতা নেপালকে তার অর্থায়নের ধরন সংক্রান্ত নমনীয়তা প্রদান করবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, কোন প্রকল্পগুলি বিআরআই-এর আওতায় পড়ে এবং কোনটি নয়, তা নিয়ে বিভ্রান্তি আর কোনও সমস্যার কারণ হবে না। কারণ এ বার থেকে সমস্ত চিনা প্রকল্প বিআরআই সহযোগিতার অধীনে থাকবে।
চুক্তির বিবৃতিতে যৌথ বাস্তবায়নের জন্য অবকাঠামো-উন্নয়নমূলক কর্মসূচির অধীনে বেশ কয়েকটি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই প্রকল্পগুলি হল টোখা চাহারে টানেল রোড, হিলসা সিমকোট রোড প্রকল্প, কাঠমান্ডু-খান্দবাড়ি রোড, কিমাথাঙ্কা সেতু ও সমন্বিত চেকপোস্ট প্রকল্প, রসুওয়াগাধি থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত আন্তঃসীমান্ত রেলওয়ে প্রকল্প, অমরগাধি সিটি হল প্রকল্প, জিলং-রসুওয়াগাধি-চিলিমে ২২০ কেভি ক্রস বর্ডার পাওয়ার ট্রান্সমিশন লাইন, মদন ভাণ্ডারু ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কাঠমান্ডু সায়েন্টিফিক সেন্টার, চায়না-নেপাল সায়েন্টিফিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, স্পোর্টস কমপ্লেক্স ইত্যাদি। এই তালিকার বেশির ভাগ প্রকল্পই প্রাথমিক ভাবে প্রস্তাবিত বিআরআই-এর ন’টি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।
যেহেতু নেপাল নয়াদিল্লি ও বেজিং উভয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাই কাঠমান্ডুর সঙ্গে তার দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের জন্য আরও সক্রিয় পদ্ধতি অবলম্বন করা অপরিহার্য। গত বছরে উভয় পক্ষই জ্বালানি ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা সম্প্রসারিত করলেও বাণিজ্য ঘাটতি ও সীমান্ত সমস্যা ইত্যাদির মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর ছায়া ফেলেছে।
ঐকমত্যে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে জোটের সাফল্য নেপালে সাধারণ ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাভাবিক দোষারোপ করার চরিত্র থেকে সরে আসার মনোভাবকেই দর্শায়। প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা ব্যাখ্যা করেছেন যে, কী ভাবে দুই দেশ ২০২০ সাল থেকে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা করছে এবং উভয় পক্ষই নথিটি গ্রহণ করার পরে চূড়ান্ত নথিটি চিনের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল। উভয় পক্ষের এই সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতি এখনও বেশ সদ্যোজাত হলেও এবং ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সমস্যাগুলি মোকাবিলা করার জন্য একটি ঐকমত্য-নির্মাণের দৃষ্টিভঙ্গিকেই দর্শায়। বিআরআই-এর উদ্যোগগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু নেপালি উদ্বেগের সমাধান করার প্রয়োজনীয়তা চিনও বুঝতে পেরেছিল। গত বছরও তৎকালীন প্রাইম মিনিটার প্রচণ্ডের বেজিং সফরের সময়, দুই পক্ষ পূর্ববর্তী তারিখে বাস্তবায়ন পরিকল্পনা স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছিল। জোট সরকারের পুনর্গঠনের পর ২০২৪ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যখন বেজিং সফর করেছিলেন, তখন বিষয়টির পুনরাবৃত্তি হলেও কোনও অগ্রগতি হয়নি।
উভয় পক্ষই বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, চিনা ভাষার শিক্ষক নিয়োগ ও দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ প্রযুক্তি বিনিময়ের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। চিন নেপালকে আরও বেশি পরিমাণে বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছে এবং আগামী বছরগুলিতে পর্যটনের প্রচারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। উভয় পক্ষই সীমান্তের যৌথ পরিদর্শন এবং আইন প্রয়োগে সহযোগিতার পাশাপাশি সীমানা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে স্বাক্ষর করার বিষয়েও সম্মত হয়েছে। এমনকি নেপাল ‘ওয়ান চায়না’ নীতির প্রতি তার ‘দৃঢ়’ সমর্থন পুনঃনিশ্চিত করেছে এবং পুনরায় সমন্বিত হওয়ার নিরিখে চিনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে। এর পাশাপাশি নিজের বক্তব্যকে আরও সশক্ত করে নেপালের মাটিতে যে কোনও প্রকারের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ কার্যকলাপ বন্ধ করার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পুনরায় ব্যক্ত করেছে।
যেহেতু নেপাল নয়াদিল্লি ও বেজিং উভয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাই কাঠমান্ডুর সঙ্গে তার দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের জন্য আরও সক্রিয় পদ্ধতি অবলম্বন করা অপরিহার্য। গত বছরে উভয় পক্ষই জ্বালানি ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা সম্প্রসারিত করলেও বাণিজ্য ঘাটতি ও সীমান্ত সমস্যা ইত্যাদির মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর ছায়া ফেলেছে। সেপ্টেম্বর মাসে ইউএনজিএ-র অনুষ্ঠানের পাশাপাশি অলি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সাক্ষাৎ করলেও নতুন সরকারের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠক ছাড়া উভয় পক্ষের মধ্যে কোনও ব্যাপক দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার কথা শোনা যায়নি।
ভারতের জন্য নেপালে চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব উদ্বেগের কারণ এবং নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিবেচনা… দুই-ই উত্থাপন করে। অবকাঠামো চুক্তি স্বাক্ষর প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি না দর্শালেও তহবিল নিয়ে ঐকমত্য অবশ্যই কিছুটা স্পষ্টতা প্রদান করে। তাই নেপালে চিনা সহায়তায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে যে কোনও অগ্রগতি নেপালের সঙ্গে খোলা সীমান্তের কারণে ভারতের ঝুঁকির ধারণাকে বাড়িয়ে তোলে। আগামিদিনে চুক্তিটি প্রকল্প-নির্দিষ্ট বাস্তবায়ন চুক্তির দ্রুত স্বাক্ষরের বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যায় কি না এবং তহবিলের ধরন নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছয় কি না, তা লক্ষ্যণীয় হবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ওপেন-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.