Published on Dec 24, 2021 Updated 0 Hours ago

কৃষিক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি অকৃষিক্ষেত্রগুলির উন্নয়ন ভারতীয় অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

কৃষি বিল ২০২০ এবং কৃষিক্ষেত্র ও অকৃষিক্ষেত্রগুলির মধ্যে অদৃশ্য ভারসাম্য

২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর ভারত সরকার তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেয়, যেগুলির বিরুদ্ধে দেশের রাজধানীর সীমানায় — প্রধানত পঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষকেরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। এই আইনগুলি বলবৎ হলে কৃষকেরা সরকারের তরফে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এম এস পি) বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন এবং ফসলের পর্যাপ্ত মূল্য পেতে তাদের বাজারের ঝুঁকির সঙ্গে যুঝতে হবে এই মর্মে প্রস্তাবিত আইনগুলি তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও এই সংস্কারমূলক আইন প্রণয়নের ব্যর্থতার কারণগুলি বুঝতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে অকৃষিক্ষেত্র এবং শ্রম বাজার বা লেবার মার্কেটের দিকে।

চেন্নাইয়ের গ্রেট লেকস ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের মাহামবারে এবং অন্যদের করা এক গবেষণায় কৃষিক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে রাজ্য, লিঙ্গ এবং বয়সের ভিত্তিতে ভারতে কর্মসংস্থানের ধাঁচ পরিবর্তনের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো হয়। তাঁদের গবেষণা পদ্ধতিতে কর্মসংস্থান ও শ্রমশক্তির অনুপাতের বদলে ক্ষেত্রভিত্তিক কর্মসংস্থান ও জনসংখ্যার অনুপাত নির্ধারণে তাঁরা ২০০৪-০৫ সালের এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড আনএমপ্লয়মেন্ট সার্ভে বা কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব সমীক্ষা এবং ২০১৮-১৯ সালের পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে বা পর্যায়ক্রমিক শ্রম শক্তি সমীক্ষা থেকে ইউনিট লেভেল ডেটা আহরণ করেছেন। ক্ষেত্রভিত্তিক কর্মসংস্থান এবং জনসংখ্যার অনুপাত ব্যবহারের পিছনে অন্যতম কারণটি হল যে, এর ফলে অর্থনীতির কোনও একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সার্বিক কর্মসংস্থান নির্ভরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। অন্য দিকে, কর্মসংস্থান এবং শ্রমশক্তির অনুপাত থেকে শুধু মাত্র চাকরিরত এবং চাকরির খোঁজে থাকা মানুষদের পরিসংখ্যান জানা যায়। এই গবেষণার জন্য বয়ঃসীমা ২০ থেকে ৫৯ বছর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল — যেটিকে প্রাইম ওয়ার্কিং এজ বলে ধরা হয়।

এই আইনগুলি বলবৎ হলে কৃষকেরা সরকারের তরফে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এম এস পি) বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন এবং ফসলের পর্যাপ্ত মূল্য পেতে তাদের বাজারের ঝুঁকির সঙ্গে যুঝতে হবে এই মর্মে প্রস্তাবিত আইনগুলি তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও এই সংস্কারমূলক আইন প্রণয়নের ব্যর্থতার কারণগুলি বুঝতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে অকৃষিক্ষেত্র এবং শ্রম বাজার বা লেবার মার্কেটের দিকে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, পঞ্জাব এবং হরিয়ানায় — যেখানে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় অর্থনীতিতে কৃষিক্ষেত্রের প্রভাব ব্যাপকতর — ২০১৮-১৯ সালে গ্রামাঞ্চলে পূর্ণ বয়স্ক যুব সম্প্রদায়ের মাত্র ২০% কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত। এর পাশাপাশি হরিয়ানা এবং পঞ্জাব দেশের সেই মুষ্টিমেয় রাজ্যগুলির মধ্যে পড়ে যেখানে ২০০৪-০৫ সালের পর থেকে কৃষিক্ষেত্রে কাজের সুযোগ সর্বাধিক পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। এটি লক্ষ করার মতো যে, এই রাজ্যগুলিতে কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের উপরে কম নির্ভরতা পরোক্ষ ভাবে কৃষিক্ষেত্রে উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং উপার্জনের প্রতি ইঙ্গিত করে। ফলে মহিলাদের কর্মক্ষেত্র থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে হয় এবং তাঁরা গৃহস্থালির অবৈতনিক দেখভালের কাজ করতে বাধ্য হন। ফলে খাদ্যশস্যের সুনিশ্চিত চাহিদা এবং মূল্যের নিরিখে স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ঘটলে (যেগুলির জোগান এখনও প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত) ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে, যেমনটা ঘটেছিল গত বছর তিনটি কৃষি আইন প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে।

কৃষি আইনগুলি বলবৎ করার ফলস্বরূপ চাল এবং গমের দাম সম্পর্কে নিশ্চয়তা না থাকার ফলে ব্যাপক হারে উদবৃত্ত এই সব খাদ্যশস্যের দাম হ্রাস পাবে অনেকটাই। এই খাদ্যশস্যগুলির উৎপাদন ইতিপূর্বেই তাদের চাহিদার তুলনায় অনেকটাই বেশি ছিল। এমতাবস্থায় এই ‘ধনী’ কৃষকেরা তাঁদের বর্তমান উপার্জন এবং জীবনযাত্রা বজায় রাখতে অক্ষম হয়ে পড়বেন এবং তাঁদের বিকল্প উপার্জনের উৎস খুঁজতে হবে — যেমনটা করতে হলে যুব সম্প্রদায় এবং মহিলাদের সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি হল যে, কৃষিক্ষেত্রে উপার্জন অধিক থাকার ফলে এই মহিলারা এর আগে বাড়ির কাজেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন এবং নতুন আইনের ফলে মহিলারা সবেতন কাজে নিজেদের নিযুক্ত করলে তাঁদের সামাজিক সম্মান কমে যাবে — যা সাংস্কৃতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

কৃষি আইনগুলি বলবৎ করার ফলস্বরূপ চাল এবং গমের দাম সম্পর্কে নিশ্চয়তা না থাকার ফলে ব্যাপক হারে উদবৃত্ত এই সব খাদ্যশস্যের দাম হ্রাস পাবে অনেকটাই। এই খাদ্যশস্যগুলির উৎপাদন ইতিপূর্বেই তাদের চাহিদার তুলনায় অনেকটাই বেশি ছিল।

২০১৮-১৯ সালের পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান দর্শাচ্ছে যে, পঞ্জাব এবং হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলিতে বিগত দেড় দশকে কৃষিক্ষেত্রে মহিলাদের নিয়োগের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩০%। পাশাপাশি হয় বেকার অথবা পড়াশোনা করছে এমন যুবকদের (২০ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে) শতাংশের হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য রকম। এই দুটি পরিস্থিতি বহাল রাখা তখনই সম্ভব, যদি আলোচ্য রাজ্যগুলিতে কৃষিক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত উপার্জনের পরিমাণ বর্তমানের মতোই বেশি থাকে।

সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার কারণটি হল, এই যুবকেরা যখন চাকরি বা কাজের অন্বেষণে বেরোবেন, তখন তাঁরা সরাসরি দেশের দুই অঙ্কের বেকারত্বের পরিসংখ্যানের মুখোমুখি হবেন। তাই ভারতীয় অর্থনীতিতে কৃষিক্ষেত্রের সংস্কারের জন্য অকৃষিক্ষেত্রের উন্নয়ন এবং সামাজিক ভাবে মুক্তমনস্ক এক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা আরও বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এ কথা উল্লেখযোগ্য যে, প্রস্তাবিত আইনগুলি পঞ্জাব এবং হরিয়ানা ব্যতীত অন্যান্য রাজ্য তথা গরিব কৃষকদের তরফে কোনও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। এ রকমটা হওয়ার কারণ এটা হতে পারে যে, ছোট কৃষকেরা এম এস পি ব্যবস্থা থেকে ততটা লাভবান হননি, যতটা ধনী কৃষকেরা হয়েছেন। সেন্টার ফর সাস্টেনেবল এগ্রিকালচার-এর (সি এস এ) জি ভি রমনজানেয়ুলু পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘বিগত দু’-তিন বছরে চাষবাস ছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকে উপার্জনের পরিমাণ তীব্র ভাবে হ্রাস পেয়েছে। অথচ শস্যক্ষেত্রে এক-ফসলি চাষের বৃদ্ধি ঘটেছে চোখে পড়ার মতো। শস্যক্ষেত্রের এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করে সুসংহত কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। অন্যথায় পঞ্জাবে এক জন ৩০ একর জমির মালিকও একই হারে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পেতে থাকবেন যতটা অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুরের এক জন ৩ একর জমির মালিক পেয়ে থাকেন। এই ব্যবস্থা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বৃহৎ ডেয়ারিগুলি গৃহভিত্তিক ক্ষুদ্র পশুপালনকারীদের উপার্জনের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে গ্রামীণ পরিবারগুলির জন্য অতিরিক্ত উপার্জনের উৎসগুলি সীমিত হয়ে পড়ছে।’’

পঞ্জাবে এক জন ৩০ একর জমির মালিকও একই হারে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পেতে থাকবেন যতটা অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুরের এক জন ৩ একর জমির মালিক পেয়ে থাকেন।

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কৃষি সচিব এবং কৃষি অর্থনীতিবিদ টি নন্দ কুমারের মতে, ‘‘সমগ্র ব্যবস্থাটির মধ্যে আরও বেশি করে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার সঞ্চার করা প্রয়োজন। কারণ প্রত্যেক রাজ্যের সমস্যা আলাদা এবং রাজ্যগুলির রাজনৈতিক সদিচ্ছাও। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটিগুলি (এ পি এম সি) পঞ্জাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অন্য রাজ্যগুলি তুলনায় অনেক বেশি করে হাইব্রিড মডেলের (যেখানে উৎপাদিত শস্যের একটি অংশ কৃষকেরা এ পি এম সি-র বাইরেও বিক্রি করতে পারেন) পক্ষপাতী। এ ছাড়া রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করে ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফারের মতো সংস্কারের কথাও ভাবা যেতে পারে।’’

অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত উন্নতি করা ছাড়াও অকৃষিক্ষেত্রগুলিতে যুবক-যুবতীদের — সদ্য পাশ করে বেরোনো স্নাতক এবং পুনরায় পড়াশোনা চালু করেছে এমন — জন্য যথেষ্ট পরিমাণ নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করতে হবে। কৃষি এবং অকৃষিক্ষেত্রগুলির মধ্যে এই অদৃশ্য ভারসাম্যকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং প্রত্যাখ্যাত কৃষি বিলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই সম্পর্কের উন্নতি সাধন করার সময় আগত।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.