বাংলাদেশে একটি যুগের অবসান ঘটল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা – যিনি গত পনেরো বছর ধরে দেশ শাসন করেছেন এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে পঞ্চম মেয়াদে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন – শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন এবং একটি ‘নিরাপদ আশ্রয়’-এর খোঁজে দেশ ছেড়েছেন। কারণ বিক্ষোভকারীরা তাঁর সরকারি বাসভবন অর্থাৎ গণভবনে হামলা করেছে, তাঁর কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এবং সংসদ অবরোধ করেছে - নাটকীয় ভাবে এই সব কিছুই আপাতদৃষ্টিতে ‘প্রায় স্থায়ী’ রাজনৈতিক শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। দেশ জুড়ে যেহেতু ব্যাপক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সামরিক শাসন বাংলাদেশের দখল নেওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়েছে, তাই এই অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দরুন ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলির জন্য, বিশেষ করে ভারতের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। ভারতের সঙ্গেই বাংলাদেশ তার দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক সীমানা ভাগ করে নিয়েছে। বিগত দশকটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, একটি অভূতপূর্ব সম্পর্ক দ্বারা চিহ্নিত এবং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার একটি ‘সুবর্ণ অধ্যায়’-এর সূচনা করেছে। যাই হোক, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভাগ্যও পরীক্ষার মুখে পড়বে। এই এক-মাসব্যাপী অরাজনৈতিক ছাত্র বিক্ষোভ – যা গণআন্দোলনের আকার ধারণ করেছে – তা শেষ পর্যন্ত দেশটিকে স্থবির করে দিয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে তা পুনরায় প্রভাবিত করতে চলেছে।
উস্কানি এবং অশান্তি
এই বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য একটি বিলুপ্ত কোটা ব্যবস্থার পুনর্বহাল করার পক্ষে রায় দেয়। ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই দেশের মধ্যে প্রায় ৩২ মিলিয়ন মানুষ অতিমারি-পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিক্ষা বা জীবিকাবৃত্তির বাইরে রয়েছেন; উপরন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের কারণে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে চলেছে – এমতাবস্তায়ে এই রায়টি ৩০ শতাংশ কোটা হ্রাস করার জন্য সারা দেশে ছাত্র-বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন সদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিতর্কিত ভাবে মন্তব্য করেন , ‘যদি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরি সংরক্ষিত না হয়, তা হলে কাদের জন্য এমনটা করা উচিত? রাজাকারদের সন্তানদের জন্য?’ প্রসঙ্গত, রাজাকার বলতে তাঁদের বোঝানো হয়েছে, যাঁরা ১৯৭১ সালের ‘মুক্তিযুদ্ধ’-এর বিরোধিতা করেছিলেন।
সরকার যখন চাপ ও প্রতিশ্রুতি - উভয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল, তখন বিক্ষোভকারী ও পুলিশ, বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। দেশব্যাপী কারফিউর মধ্যেই সেনাবাহিনীকে প্রকাশ্যে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এবং এই অঘোষিত হত্যাকাণ্ডের ফলে শতাধিক মানুষ মারা যান। সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট রায় - যা পরবর্তীতে কোটার আসন কমিয়ে এনে ৫ শতাংশ করেছিল – তা বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে পারেনি। কারণ বিক্ষোভকারীরা সহিংস ঘটনার ব্যাপক তদন্ত, অভিযুক্তদের জবাবদিহি করা এবং দোষী কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবি তুলেছিলেন। এর পাশাপাশি তাঁরা প্রধানমন্ত্রী হাসিনার কাছ থেকে জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়ার দাবিও তোলেন, যার ফলে এই চাপানউতোর আরও বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি বিরোধীদের দ্বারা বয়কট করা নির্বাচনে বিতর্কিত নির্বাচনী বিজয় এবং দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগের কারণে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ বাড়িয়ে দয়ে। জানুয়ারি মাসের নির্বাচনের পর থেকে অসন্তোষটি বিশেষ ভাবে স্পষ্ট হতে থাকে। নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪০ শতাংশের মত। বিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত এই অসন্তোষকে প্রকাশ্যে আনে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি করে। প্রসঙ্গত, রাজধানী ঢাকা ও সমগ্র দেশ জুড়ে যে অভ্যন্তরীণ হতাশার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তা হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতের অনুগ্রহের বিপরীত এবং হাসিনার প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভূত আশঙ্কা সামনে এসেছে।
স্বার্থ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: ভারতের উপর প্রভাব
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবিচ্ছিন্ন মেয়াদ বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছিল এবং একটি নিরাপদ প্রতিবেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। বাংলাদেশে আশ্রিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে - যা প্রায়শই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্রগুলিতে অশান্তির সৃষ্টি করে - তাঁর সরকারের আপসহীন ‘শূন্য সহনশীল’ অবস্থান বিশেষ করে নয়াদিল্লিকে এই অস্থির এবং ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলকে শান্ত করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সাম্প্রতিক প্রস্থান বাংলাদেশে চরমপন্থী উপদলের পুনরুত্থানের সঙ্গে সমাপতিত হয়েছে। এক সময় নিষিদ্ধ ‘তীব্র ভারত-বিরোধী’ জামাত-ই-ইসলামির রাজনৈতিক অগ্রভাগে প্রত্যাবর্তন আসলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের জন্য নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভারত ইতিমধ্যেই তার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এবং পুলিশ ও সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী ২৪/৭ সতর্কতার সঙ্গে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়া রুখতে সীমান্ত বরাবর উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কারণ হিন্দু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংস ঘটনার খবরও প্রকাশ্যে উঠে এসেছে, যাঁরা বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে চাইছেন।
তাৎক্ষণিক নিরাপত্তামূলক উদ্বেগের ঊর্ধ্বে উঠে হাসিনা শাসনের অবসান ভারত-বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক প্রকল্প, বিশেষ করে সংযোগ উদ্যোগের ভাগ্য নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উন্মোচিত হওয়া এ হেন প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর হয়ে ভারতের ভূখণ্ডবেষ্টিত উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির জন্য সামুদ্রিক বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, ১৯৪৭ সালের বিভাজনের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বহু পুরনো সংযোগের পুনঃনির্মাণ এবং রাস্তা, রেল, অভ্যন্তরীণ নৌপথ ও বিমান সংযোগের সম্প্রসারণ। নাগরিকদের মধ্যে শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধনের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় একে অপরের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হিসাবে এই উদ্যোগগুলি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে গভীরতর করার জন্য অপরিহার্য। বঙ্গোপসাগরে নিবেদিত আঞ্চলিক সংস্থা - বে অব বেঙ্গল রিজিওনাল মাল্টি-সেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমস্টেক) এঢ় সদস্য হিসেবে সেপ্টেম্বর মাসে আসন্ন ষষ্ঠ বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনে ভারত ও বাংলাদেশেরও আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সংযোগ বৃদ্ধির জন্য একটি বহুপাক্ষিক সামুদ্রিক পরিবহণ চুক্তি স্বাক্ষর করার কথা ছিল। তবে সে সব সম্ভাবনাই এখন অনিশ্চিত।
সংযোগ ছারাও গত এক দশকে ভারত ও বাংলাদেশ জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মতো একাধিক পরিসরে সহযোগিতা করেছে।
ঢাকায় স্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অন্য অনেক দেশের মতো ভারতকেও বাংলাদেশে, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এবং সাহায্যের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী করেছে। ভারত ও বাংলাদেশের সহিযোগিতা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারাতের ভূ-কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে তা বলাই বাহুল্য। তাই সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নয়াদিল্লি ঢাকার অর্থনৈতিক উত্থানের একটি বিশেষ অংশ হয়ে উঠেছে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক উত্থানকে বিশ্বব্যাঙ্ক তার ‘দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নের অসাধারণ যাত্রা’ বলে প্রশংসা করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই উন্নয়নমূলক অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা এখন তুঙ্গে। প্রাক্তন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী দল অর্থাৎ বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) তার ভারত-বিরোধী মনোভাবের জন্য পরিচিত এবং দলটি স্পষ্টতই চিনপন্থী। দলটি ভারতবিরোধী এবং সাম্প্রতিক ‘ভারতীয় পণ্য বয়কট’ অভিযানকে সমর্থন করেছে। ভারত ও চিনের মধ্যে হাসিনা সরকার এত দিন ধরে যে সূক্ষ্ম কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখেছিল, সেই সমীকরণের পাল্লা পুনরায় বেজিংয়ের পক্ষে ঝুঁকতে পারার আশঙ্কাও অমূলক নয়। নয়াদিল্লিকে এই সম্ভাবনা সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। কারণ বাংলাদেশ ভারতের বিদেশনীতির উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা - যিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ঘন ঘন ভারত সফরে এসেছেন এবং এই বছরের জুন মাসেও দু’বার সফর করেছেন - গণভবন ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সোমবার গাজিয়াবাদের হিন্দন এয়ারবেসে পৌঁছেছেন। এটি অবশ্যই তাঁর স্বাভাবিক গন্তব্য নয়াদিল্লি থেকে একটি বিচ্যুতি। তিনি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও সেখানকার বর্ষীয়ান সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হওয়ার জন্য লন্ডনের দিকে রওনা হচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সঙ্গে সমৃদ্ধ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভারতের ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশ প্রথম’ এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ বা ‘পূর্ব অভিমুখী’ নীতির সাফল্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে, যা এই বছরে এক দশক পূর্ণ করছে।
শেখ হাসিনার প্রস্থান এই ‘সোনালি অধ্যায়’-এর যবনিকা পতন ঘটালেও কিছু অপরিবর্তিত ভৌগোলিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না।
দুই দেশের মধ্যে আভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক বন্ধন, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ও ভৌগলিক আবিছিন্নতা এক অভিন্ন ভবিষ্যতের মাধ্যমে একে অপরের স্বাভাবিক অংশীদার করে তুলবে, এটাই আশা। অতএব, দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহযোগিতা অপরিহার্য। দুই দেশই তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি নতুন যুগের সন্দিক্ষনে দারিয়ে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.