সাম্প্রতিক অতীতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটায় চিন আমেরিকার আর্থিক আধিপত্যের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। এই প্রচেষ্টায় দেশটি গ্লোবাল সাউথ সম্পর্কিত সমস্যাগুলির সদ্ব্যবহার করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (ইউএস) তার আকাশপথে ভ্রাম্যমান একটি ‘গুপ্তচর বেলুন’কে গুলি করে নামানোয় এবং একটি চিনা প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম টিকটকের সর্বময় কর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করায় চিন ক্ষুব্ধ। এর বিপরীতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করার লক্ষ্যে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফর এবং তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের মার্কিন সফরের প্রতিশোধ হিসাবে চিনা সামরিক মহড়া আমেরিকার বিরক্তির কারণ হয়েছে। চিন আমেরিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক মেরামতের ঊর্ধ্বে বলে মনে করে। এটি চিনা কৌশলবিদ ওয়াং জিসি-র দাবি থেকে প্রমাণিত হয় যে, চিন-আমেরিকা সম্পর্ক উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ কারণে অবনতি ঘটেছে এবং উভয়ের মধ্যে কোনও আলোচনাই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সক্ষম নয়।
চিন আমেরিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক মেরামতের ঊর্ধ্বে বলে মনে করে।
এটি আমেরিকার আর্থিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে চিনের নতুন বাগ্যুদ্ধের অন্যতম কারণ। এই প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু ব্যাঙ্কের পতন এবং ‘মার্কিন ডলারের অঞ্চল বহির্ভূত অবস্থা’র বিরুদ্ধে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সমালোচনা আমেরিকার অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিতর্ক উস্কে দিতে চিনকে সাহায্য করেছে।
চিনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের ভাষ্যকাররা ২০২০ সালে অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠিত মার্কিন মুদ্রা নীতির বিরুদ্ধে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরির অভিযোগ করেছেন। এই নিবন্ধটিতে বিশেষভাবে আর্জেন্টিনার নমুনা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে ১৯৯০-এর দশকের পর প্রথম বারের মতো মুদ্রাস্ফীতি ১০০ শতাংশ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং আমেরিকান ডলারের ‘অতিরিক্ত সরবরাহ’কে এই স্ফীতির প্রধান কারণ রূপে দর্শানো হয়েছে। ভাষ্যটিতে আরও যোগ করা হয়েছে যে, আমেরিকার সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারে নগদ অর্থের সঙ্কোচন ঘটেছে, যা পুঁজি স্থানান্তরের সমস্যা বাড়িয়েছে এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এর পাশাপাশি এই নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে যে, ডলার-নির্ধারিত ঋণ পরিশোধের জন্য দেশগুলির চাপ তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নিম্ন আয়ের দেশগুলিকে খেলাপি বা ঋণ সঙ্কটের উচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ১৯৯৮ সালের এশীয় আর্থিক সঙ্কট আমেরিকা ইনক-এর জন্য বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষেত্রগুলিতে সম্পদ অর্জনের একটি সুযোগ… মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ হেন চিন্তাভাবনা এবং অন্য দেশগুলির দুর্দশাকে এই নিবন্ধে এক সূত্রে বাঁধার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমেরিকান ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অভিজাত এবং আর্থিক ক্ষেত্রের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে যোগসাজশ রয়েছে, যার ফলে বিশেষ স্বার্থ সমন্বিত গোষ্ঠীগুলি তাদের সুবিধার জন্য ক্ষমতায় আসীন হয়েছে ও নিজেদের স্বার্থে ও ব্যাঙ্ক আমানতকারীদের ক্ষতি সাধন করে আইনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
অন্য এক ভাষ্যকার যুক্তি দিয়ে বলেন যে, আমেরিকান ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অভিজাত এবং আর্থিক ক্ষেত্রের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে যোগসাজশ রয়েছে, যার ফলে বিশেষ স্বার্থ সমন্বিত গোষ্ঠীগুলি তাদের সুবিধার জন্য ক্ষমতায় আসীন হয়েছে ও নিজেদের স্বার্থে ও ব্যাঙ্ক আমানতকারীদের ক্ষতি সাধন করে আইনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। নিবন্ধটিতে প্রাক্তন কংগ্রেস সদস্য বার্নি ফ্রাঙ্কের মামলার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, মার্কিন রাজনীতিবিদ সক্রিয় ভাবে তাঁর আইন প্রণয়নের সময় কঠোর ব্যাঙ্কিং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনুসরণ করলেও সিগনেচার ব্যাঙ্কের বোর্ডে – যা মার্কিন নিয়ন্ত্রকরা সাম্প্রতিক কালে বন্ধ করে দেন – যোগদানের পরে আর্থিক নিয়ন্ত্রণহীনতার পক্ষে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেন। ভাষ্যকার এ-ও যোগ করেছেন যে, সম্প্রতি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কেও বিনিয়োগ সংক্রান্ত দক্ষ ব্যক্তিদের তুলনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরে অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাই নিযুক্ত ছিলেন।
অতি সম্প্রতি উন্নয়নশীল বিশ্ব এবং আমেরিকার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। চিনের জাতীয়তাবাদী গণমাধ্যম গুয়াঞ্চায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে চিনের ‘লাওস-কম্বোডিয়া’ উন্নয়ন প্রোটোটাইপকে আমেরিকার ‘ইরাক-আফগানিস্তান’ মডেলের বিপরীতে তুলে ধরা হয়েছে এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) অধীনে এশিয়ায় গৃহীত চিনের পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে ওবামা প্রশাসনের দ্বারা কিউবা, উত্তর কোরিয়া এবং ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে ‘ডলার অস্ত্রীকরণ’ ব্যবহারের ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ দেশ কোনও না কোনও সময়ে মার্কিন বাণিজ্যিক বা আর্থিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে। নিবন্ধটিতে উনিশ শতকের শেষের দিকে উত্তর আমেরিকায় সমগ্র মহাদেশে বিস্তৃত এক ঐক্যবদ্ধ বাজারের সূচনাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রসারণের সঙ্গে চিন দ্বারা সূচিত অর্থনৈতিক পরিসরে এবং স্থানীয় মুদ্রা ব্যবস্থায় চিন-রুশ সহযোগিতার তুলনা করা হয়েছে।
আফগানিস্তান সম্পর্কিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে চিন একতরফা ভাবে দেশটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং আফগানিস্তানের বৈদেশিক সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তার অগ্রগতি ব্যাহত করার জন্য আমেরিকাকে অভিযুক্ত করেছে। ‘উত্তপ্ত ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা’র শান্তিপূর্ণ সমাধানকে সমর্থন জোগানোর জন্য বেজিংয়ের প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা হিসাবে এই গবেষণাপত্রটিকে তুলে ধরা হয়েছে যা একটি বিকল্প আন্তর্জাতিক ক্রমে ‘যোগ্যতর’ নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে মার্কিন আধিপত্যকে আক্রমণ করার জন্য চিনের প্রচেষ্টাকে দর্শায়।
ইউক্রেনের যুদ্ধ সংক্রান্ত চিনের ১২ দফা শান্তি প্রস্তাবের পর পরই চিনা গবেষণাপত্রটিতে আফগানিস্তানের প্রতি বেজিংয়ের পদক্ষেপের মূল নীতিগুলিকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত, এটিতে কাবুলে একটি ‘মধ্যপন্থী সরকার’ গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। আফগান জনগণের প্রতি চিনের নিঃস্বার্থ সমর্থনকে অন্যান্য দেশের স্বার্থের চেয়ে আলাদা করে, এটিতে বলা হয়েছে যে, কী ভাবে বেজিং দেশের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, ‘স্বাধীন সিদ্ধান্ত’ এবং আফগান জনগণের ধর্মীয় ভাবাবেগকে সম্মান করে। আফগানিস্তানের সঙ্কটের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী ভাবে দায়ী, তা সমগ্র গবেষণাপত্রের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০২১ সালে কাবুলের পতনের পর থেকে চিন ক্রমাগত মার্কিন সে্না প্রত্যাহার, আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং তালিবানের উপর চাপিয়ে দেওয়া একতরফা পদক্ষেপকে আক্রমণ করেছে এবং মার্কিন কার্যকলাপকে ‘দস্যুতা’ বলে অভিহিত করেছে। মার্কিন আধিপত্যের উপর এ হেন আক্রমণ দেশটিতে নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য সঙ্কট বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে চিনা কৌশলেরই একটি অংশ। এটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আধিপত্যের উপর তার দখল ত্যাগ করা এবং সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আন্তঃসহযোগিতা স্থাপন’ করার আহ্বান জানানোর পূর্ববর্তী প্রচেষ্টাকে অনুসরণ করা হয়েছে।
ইউক্রেনের যুদ্ধ সংক্রান্ত চিনের ১২ দফা শান্তি প্রস্তাবের পর পরই চিনা গবেষণাপত্রটিতে আফগানিস্তানের প্রতি বেজিংয়ের পদক্ষেপের মূল নীতিগুলিকে তুলে ধরা হয়েছে।
মার্কিন আর্থিক আধিপত্যের উপর চিনের আক্রমণ এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতি দেশটির আকস্মিক সহানুভূতি কেবলমাত্র ডি-ডলারাইজেশন এবং ইউয়ানের জন্য বৃহত্তর প্রচারের এক অছিলা মাত্র। সেন্ট্রাল কমিশন ফর ডিসিপ্লিন ইনস্পেকশন-এর (সিসিডিআই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত গুয়াং জিয়াওপু-র লেখা একটি গবেষণাপত্র – যেটিকে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে দুর্নীতি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে – বলা হয়েছে যে, ডলার যে দিন থেকে সাধারণ লেনদেন ব্যবস্থায় মার্কিন ক্ষমতার যন্ত্রে পর্যবসিত হয়েছে, তার আধিপত্যও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। লেখক বলেছেন যে, রাশিয়া সুইফট ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করার জন্য একটি বিকল্প অর্থপ্রদান ব্যবস্থা তৈরি করছে এবং বাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে মুদ্রা ব্লকের প্রবণতা মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। লেখক পরামর্শ দিয়েছেন যে, ডলারের প্রতি আস্থার পতন চিনের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং মুদ্রার রিজার্ভে ইউয়ানের অনুপাতকে প্রসারিত করার একটি অন্যতম সুযোগ। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, হংকং এবং সাংহাই-এর মতো আর্থিক কেন্দ্রগুলিতে মানব পুঁজির দক্ষতার উপর ভিত্তি করে ইউয়ানকে জনপ্রিয় করার জন্য চিনকে অবশ্যই চিনের আমদানি ও রফতানি মেলা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা এবং আন্তঃসীমান্ত ই-কমার্স জোনের মতো নানা সরঞ্জাম এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করতে হবে।
উপসংহারে বলা যায়, চিন তার আক্রমণের সীমারেখার জন্য প্রাচীন চিনা মতবাদের উপরই নির্ভর করে, যার মধ্যে একটি হল ‘শেং দং জি শি’ অর্থাৎ পূর্বে গোলমাল সৃষ্টি করা এবং পশ্চিমে আঘাত হানা। এমন এক সময়ে যখন ডলারের আধিপত্যের অবসান সম্পর্কে জল্পনা চলছে, তখন উন্নয়নশীল বিশ্বের ঘটনাবলির দৃষ্টান্ত দর্শিয়ে চিনের জন্য এই জল্পনা উস্কে দেওয়া লাভজনক। চিন চায় না, মানুষ মনে রাখুক, কী ভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় আকাশ-কুসুম পরিকাঠামো প্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে দেশটি সম্পদ আত্মসাৎ করেছে এবং পরবর্তী কালে তাদের ঋণ পুনর্গঠনের জন্য কোভিড-বিধ্বস্ত দেশগুলির আবেদনেও সাড়া দেয়নি। এ ছাড়াও উন্নয়নশীল বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলি উত্থাপন করা হল আদতে ভয়েস অফ গ্লোবাল সাউথ শীর্ষ সম্মেলনের মতো মঞ্চের মাধ্যমে ভারতের জি২০ সভাপতিত্বের অধীনে গ্লোবাল সাউথের কাছে ভারতের প্রসারকে প্রতিহত করার জন্য চিনের প্রচেষ্টা।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.