এটি ‘চায়না ক্রনিকলস’ সিরিজের ১৬৫তম প্রতিবেদন।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের জাতীয় দিবসের ভাষণের পরে তাইওয়ান প্রণালীতে আবার উত্তেজনা বাড়ছে। তাঁর ভাষণে লাই বলেছিলেন যে, দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা যাবে না এবং চিনের তাইওয়ানের প্রতিনিধিত্ব করার কোনও অধিকারই নেই। বেজিং ‘জয়েন্ট সোর্ড ২০২৪বি’ মহড়ার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) অনুযায়ী, এটির মূল উদ্দেশ্য যৌথ সামুদ্রিক ও আকাশ যুদ্ধের প্রস্তুতি, অবরোধ ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নিয়ন্ত্রণ, সমুদ্র ও স্থল লক্ষ্যবস্তুতে হামলা এবং ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ এবং যুদ্ধবাহিনীর বাস্তব-যুদ্ধ ক্ষমতা পরীক্ষা করা।
মূল ভূখণ্ডের বিমানবাহী রণতরী ‘লিয়াওনিং’ এই মহড়ায় অংশ নেয়। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ঘোষণা করেছে যে, তারা ১৪ অক্টোবর ১২৫টি চিনা বিমান শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে ৯০টি বিমান তাইওয়ানের বিমান প্রতিরক্ষা শনাক্তকরণ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। এই ঘটনা এক দিনে তাদের আকাশসীমায় সবচেয়ে বড় অনুপ্রবেশ। মহড়ার সময় দ্বীপের চারপাশে ১৭টি চিনা যুদ্ধজাহাজ এবং সমান সংখ্যক কোস্টগার্ড জাহাজকেও দেখা গিয়েছে।
চিন তাইওয়ানের সামরিক সক্ষমতাকে উপহাস করার চেষ্টা করেছে এবং উদাহরণ দিয়ে বলেছে, এটি আসলে একটা সামান্য পিঁপড়ের (তাইওয়ান) এক সুবিশাল মহীরুহকে (চিনকে) উপড়ে ফেলার চেষ্টা।
মূল ভূখণ্ড ও দ্বীপের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে চিন লাইয়ের প্রথম জাতীয় দিবসের ভাষণটিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে চালিকাশক্তি বলে মূল্যায়ন করেছে। পিএলএ ডেলি-তে প্রকাশিত একটি ভাষ্যে লাইকে ‘দ্বি-রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব’ প্রচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পিএলএ ডেলি-র আর একটি ভাষ্যে সামরিক মহড়াকে ন্যায্যতা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা’র লক্ষ্যে এগোনোর ফল হবে অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ। সেই ভাষ্যেই এই (তাইওয়ানের) বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের মোকাবিলা করার জন্য সামরিক সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা ফলাও করে বলা হয়েছে। চিন তাইওয়ানের সামরিক সক্ষমতাকে উপহাস করার চেষ্টা করেছে এবং উদাহরণ দিয়ে বলেছে, এটি আসলে একটা সামান্য পিঁপড়ের (তাইওয়ান) এক সুবিশাল মহীরুহকে (চিনকে) উপড়ে ফেলার চেষ্টা। পিপলস ডেলি-র একটি নিবন্ধে ‘তাইপে-কে স্বাধীনতার দিকে ঠেলে দেওয়া’র জন্য ওয়াশিংটনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সেই নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের তরফে লাইয়ের বক্তৃতাকে ‘সংযত’ এবং ‘মধ্যপন্থী’ হিসাবে বর্ণনা করা আসলে বিচ্ছিন্নতাবাদী উদ্দেশ্যকেই সমর্থন জোগানোর নামান্তর। নিবন্ধটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে তুরুপের তাস হিসেবে তাইওয়ানকে ব্যবহার করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। চিন আবার এই সমগ্র পরিস্থিতিতে ভারতকে টেনে এনেছে। তাইওয়ান ভারতের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা আরও গভীর করার জন্য সম্প্রতি মুম্বইতে আর একটি প্রতিনিধি কার্যালয় খুলেছে। ফলে চিনা বিদেশমন্ত্রক উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং তাইপে-র সঙ্গে কোনও প্রকার আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপনের বিরুদ্ধে ভারতকে সতর্ক করেছে।
তাইপে বেজিংয়ের বিরুদ্ধে আখ্যানের পুনর্বিন্যাস করেছে
প্রেসিডেন্ট লাই বিশ্বব্যাপী সংঘাতের উত্থানের কথাও উল্লেখ করেছেন এবং তাইওয়ানের পরিস্থিতিকে কর্তৃত্ববাদের সম্প্রসারণ প্রতিহত করার জন্য প্রতিরোধ বলে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের ‘তাইওয়ান বনাম চিন’ দ্বন্দ্বের কাঠামোটি তাঁর পূর্বসূরি সাই ইং-ওয়েনের চাইতেও শক্তিশালী হয়েছে। বার্ষিক ফোরাম ২০০০ সম্মেলনে যোগদানের জন্য ইউরোপে তাঁর সাম্প্রতিক ভ্রমণের সময় তিনি বলেছিলেন যে, তাইওয়ান গণতন্ত্রের প্রথম সারিতে ছিল এবং স্বৈরাচারের আক্রমণ মোকাবিলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাহসী একটি দেশ। তিনি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ব্যবস্থার নমুনা রফতানি করার জন্য স্বৈরাচারী শাসকদের দ্বারা তথ্যযুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও সামরিক বলপ্রয়োগের বিষয়েও সতর্ক করেছিলেন। প্রাক্তন চেক প্রেসিডেন্ট ভাক্লাভ হাভেল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ফোরাম ২০০০ কনক্লেভ-এ মানবাধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মত নিয়ে আলোচনা করার জন্য জনপ্রতিনিধি ও কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। মূল ভূখণ্ড ও তাইওয়ান উভয়ই পরিস্থিতিকে কোন আলোকে দেখে, সে বিষয়ে একটি সুবিশাল পার্থক্য রয়েছে। চিনা রাষ্ট্রের একটি ভাষ্যে বর্তমান উত্তেজনাকে সমন্বিতকরণ ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এটি নিছকই দুই ব্যবস্থার মধ্যেকার প্রতিযোগিতা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট লাই তাঁর রাজনৈতিক শিকড়ের সন্ধানে বিশ শতকের গোড়ার দিকে মূল ভূখণ্ডে ঘটা বিপ্লবের সূত্র টেনে এনেছেন, যা চিনের ইম্পেরিয়াল কিং রাজবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এটি ১ অক্টোবর বেজিংয়ের ৭৫তম জাতীয় দিবস উদ্যাপনের বিপরীতে তাইপে-র ১১৩তম বার্ষিকী উদ্যাপনকে দর্শায়। লাইও আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়েছেন এবং বেজিং ও মস্কোর মধ্যে এক সম্ভাব্য আঁতাঁতের উল্লেখ করেছেন। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট যুক্তি দিয়েছেন যে, বেজিং যদি তাইপে-র অধিকার ধরে রাখার দাবি করে, তা হলে উনিশ শতকে রুশ সাম্রাজ্যের কাছে ইম্পেরিয়াল কিং রাজবংশের হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা উচিত।
চিনা রাষ্ট্রের একটি ভাষ্যে বর্তমান উত্তেজনাকে সমন্বিতকরণ ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, এটি নিছকই দুই ব্যবস্থার মধ্যেকার প্রতিযোগিতা নয়।
সামরিক জবরদস্তির প্রভাব
সাম্প্রতিক অতীতে তৃতীয় বারের মতো চিন তাইওয়ানের প্রতি সামরিক জবরদস্তির মাধ্যমে জবাব দিয়েছে। ২০২২ সালে মার্কিন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির দ্বীপ সফরের পরে এবং সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট লাই দায়িত্ব নেওয়ার পরে পিএলএ অনুরূপ মহড়া শুরু করেছিল। ২০২২ সালে ন্যাশনাল পার্টি কংগ্রেসে তাঁর বক্তৃতার সময় চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, প্রয়োজনে তাইওয়ানকে একত্রিত করার বিকল্পটি চিনের কর্মসূচিতে ছিল। তিনি তাঁর পিএলএ কম্যান্ডারদের সৈন্যদের আরও ভাল এবং যুদ্ধের পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলেছেন। এই বছরের গোড়ার দিকে শি চংকিং-এর আর্মি মেডিকেল ইউনিভার্সিটিও পরিদর্শন করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার কৌশল, চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সমন্বিত লজিস্টিক সহায়তার কথা বলেছেন। পিএলএ ঝেজিয়াং প্রদেশের উপকূলরেখার কাছে অবস্থিত দ্বীপগুলিতে উচ্ছেদ ব্যবস্থার কার্যকারিতা সুনিশ্চিত করার জন্য মহড়া চালিয়েছে… এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরে শি পরিদর্শন করেছিলেন। তাইওয়ানকে সংযুক্ত করার সম্ভাব্য পদক্ষেপের ক্ষেত্রে পিএলএ-র যুদ্ধের প্রস্তুতি মূল্যায়ন করার উদ্দেশ্যে সামরিক মহড়া চালানো হয়েছে কি না… তা জল্পনা উস্কে দিয়েছে। প্রথমত, বারবার অবরোধ অনুশীলনের ফলস্বরূপ পিএলএ মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাইওয়ানের আশপাশের জলরাশিতে কাজ করার ক্ষমতা উন্নত করছে। দ্বিতীয়ত, চিন সম্প্রতি তার জাতীয় সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়লে নিজের কোস্ট গার্ডকে অস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। এ ছাড়া চিনের কোস্ট গার্ডকে ‘বিশেষ অঞ্চল’কে ঘেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যেখানে অন্যান্য দেশের জাহাজ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। ফলস্বরূপ, তাইওয়ান প্রণালীর আশপাশে এই ধরনের সামরিক মহড়ায় চিনের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ দুর্ঘটনার বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে। সবশেষে বলা যায়, এই ধরনের বারবার সামরিক জবরদস্তির স্বাভাবিকীকরণ এবং অন্যান্য দেশের নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া ভবিষ্যতে চিনকে মহড়ার উদ্দেশ্যে পিএলএ-কে সংগঠিত করতে উত্সাহিত করতে পারে এবং তার পরেই তা দ্রুত আক্রমণে রূপান্তরিত হতে পারে। তাই বেজিংয়ের গ্রে জোন যুদ্ধের কৌশলের (যার কোনও স্পষ্টতা নেই) উপর নজর রাখা অত্যন্ত জরুরি।
কল্পিত এ মানকিকর অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.