ভারতে পুলিশ ও আইনজীবীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিশেষ ভাবে দিল্লি সেই ১৯৮৮ সাল থেকে আইনজীবী ও পুলিশের মধ্যে এই ধরনের অশোভন সংঘাতের জন্য পরিচিতি পেয়েছে। সেই বছর ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল একজন আইনজীবীকে সেন্ট স্টিফেনস কলেজের ছাত্ররা মেয়েদের কমন রুম থেকে চুরি করার অভিযোগে ধরার পরে দিল্লি পুলিশের তাঁকে গ্রেফতার করা থেকে। এরপর লাঠিচার্জ করা হয় এবং পুলিশ ও আইনজীবীদের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। দেশের রাজধানীতে ঘটে চলা এই ধরনের হিংসার শেষতম উদাহরণ হল ২০১৯-এর ২ নভেম্বর তিস হাজারি আদালত চত্বরের ঘটনা, যার শুরু হয়েছিল পার্কিং সমস্যা থেকে। তারপর দ্রুত তা পুরোদস্তুর হিংসাত্মক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল৷
তবে এই নিবন্ধে যে ঘটনাটি আলোচনা করা হয়েছে তা পুরো বিষযটিকে আরও এক কদম এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বিহারে সম্প্রতি এক বিচারক, পুলিশ ও আইনজীবীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মধুবনী জেলার ঝঞ্ঝারপুর মহকুমা দেওয়ানি আদালতের অন্যতম অতিরিক্ত জেলা জজ (এডিজে) স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে সাঙ্ঘাতিক অভিযোগ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ঘোগরডিহা থানার দুই পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর তাঁকে প্রথমে গালাগালি এবং পরে মারধর করে। ঘটনাটি ২০২১–এর ১৮ নভেম্বর বিকেলে তাঁর চেম্বারের মধ্যে ঘটেছিল, এবং তারপর তাঁর দিকে একটি পিস্তল তাক করা হয়েছিল।
মধুবনী জেলার ঝঞ্ঝারপুর মহকুমা দেওয়ানি আদালতের অন্যতম অতিরিক্ত জেলা জজ (এডিজে) স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে সাঙ্ঘাতিক অভিযোগ করেছেন।
আশেপাশে থাকা আইনজীবী ও বিচারবিভাগীয় কর্মীরা ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে দৌড়ে বিচারকের চেম্বারে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন, এবং পুলিশদের মারধর করে তাঁদের আটকে রাখেন। এই ভয়ঙ্কর খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য ও জেলা আধিকারিকেরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় ঘটনাস্থলে চলে আসেন। ওই দিন রাত ৯টা নাগাদ পুলিশদের যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে আধিকারিকেরা তাঁদের উদ্ধার করতে সক্ষম হন। পরে পুলিশদের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে এবং সিনিয়র পুলিশ অফিসারেরা আরও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, তাঁদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
প্রত্যাশিত ভাবে, ঝঞ্ঝারপুর বার অ্যাসোসিয়েশন ও বিহার পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) এরপর সক্রিয় হয়ে ওঠে৷ স্থানীয় বার অ্যাসোসিয়েশন এই ঘটনার নিন্দা করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, এবং ঘটনাটিকে বিচারবিভাগের উপর প্রশাসনের আক্রমণ বলে অভিহিত করে৷ এই ঘটনায় জেলা ও দায়রা জজকে অ্যাসোসিয়েশন চিঠিও লিখেছে। অন্যদিকে, বিপিএ সভাপতি বলেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হলেই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে। তাঁর বক্তব্য, বিচারকের কী হয়েছে তা কেউ দেখেনি, তবে পুলিশ সদস্যদের ইউনিফর্মে রক্তের দাগ স্পষ্ট দেখা গেছে, এবং যারা আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশকে মারধর করেছে তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।
এই এডিজে এর আগে তাঁর নানা বিচিত্র আদেশের কারণে বেশ কয়েক বার বড় ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। একটি ক্ষেত্রে শ্লীলতাহানির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দেওয়ার সময় তিনি অভিযুক্তকে নিখরচায় পুরো গ্রামের জামাকাপড় ধোয়ার নির্দেশ দেন। এই বছরের শুরুর দিকে অন্য একটি মামলায় পুলিশ যাঁর বিরুদ্ধে পকসো আইনে অভিযোগ দাখিল করেনি তেমন এক অভিযুক্তকে জামিন দিতে অস্বীকার করার সময় তিনি মধুবনীর সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ (এসপি) ও সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার (এসডিপিও)–এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারণ তাঁরা নাবালিকা মেয়েদের সম্পর্কিত আইন সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান কতটা সীমিত তা স্পষ্ট করে ফেলেছিলেন। আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন যে এডিজে–র উপর পুলিশের হামলার সঙ্গে নিশ্চিত ভাবে উপরোক্ত শ্লীলতাহানির মামলায় তাঁর প্রশিক্ষণের আদেশের সম্পর্ক আছে। পাটনায় তাঁর আগের পোস্টিংয়ের সময় এই এডিজে একটি পিটিয়ে মারার মামলায় নির্দেশনীতি মেনে না–চলার কারণে বিহারের মুখ্যসচিব ও পুলিশের ডিজিকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছিলেন, এবং জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারের বেতন থেকে ২,৫০০ টাকা কেটে নিয়ে তা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করার আদেশ দিয়েছিলেন। পরে, হাইকোর্ট তাঁর আচরণে ভুল খুঁজে পায় এবং এডিজে–র সব বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা কেড়ে নেয়।
পাটনায় তাঁর আগের পোস্টিংয়ের সময় এই এডিজে একটি পিটিয়ে মারার মামলায় নির্দেশনীতি মেনে না–চলার কারণে বিহারের মুখ্য সচিব এবং পুলিশের ডিজিকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছিলেন, এবং জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারের বেতন থেকে ২,৫০০ টাকা কেটে নিয়ে তা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করার আদেশ দিয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে, বিহার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে ঘটনাটি হাতে তুলে নেন। তিনি বিষয়টি শুনানির জন্য একটি বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চও গঠন করেন। ২০২১-এর ২৯ নভেম্বর বিশেষ শুনানির দিন ধার্য হয়েছিল, এবং বিহার পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেলকে উপস্থিত হয়ে একটি সিল করা খামে স্টেটাস রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল। সেই নির্দেশ মান্য করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে যে হাইকোর্ট বিষয়টিকে বিচারবিভাগের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করেছে। কাজেই এরপর হাইকোর্টে কী ঘটে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
আমরা স্মরণ করতে পারি যে মাত্র কয়েক মাস আগে, ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ শহরে, বিচারক উত্তম আনন্দ সকালে জগিংয়ের সময় শহরের একটি নির্জন রাস্তায় একটি গাড়ির ধাক্কায় মারা যান। প্রাথমিক ভাবে এই ঘটনাকে একটি হিট অ্যান্ড রান মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হলেও শেষ পর্যন্ত হত্যার অভিযোগে এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। এই ক্ষেত্রেও বিহারের মতোই ঝাড়খণ্ড হাইকোর্ট বিষয়টি হাতে তুলে নেয় এবং পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। এই ঘটনার পরে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, “বিচারবিভাগের স্বাধীনতা হল প্রত্যেক বিচারকের স্বাধীনতা।” বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছিলেন, “জেলার বিচারবিভাগের বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতা সমগ্র ব্যবস্থার সংহতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেলা বিচারবিভাগের আদালতগুলো নাগরিকদের মুখোমুখি হওয়ার প্রথম সোপান। ন্যায়বিচার দেওয়ার প্রশ্নে নাগরিকের বিশ্বাস যদি রক্ষা করতে হয়, তা হলে ‘উচ্চতর’ বিচারবিভাগের মতোই জেলা বিচারবিভাগের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।”
সামাজিক প্রভাব
এই ধরনের ঘটনার পরিণতি সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। প্রথমত, এগুলো আইন ও বিচারের প্রতিষ্ঠানগুলির নাম খারাপ করে। সেই সঙ্গেই এগুলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেকার উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ককেও প্রকাশ্যে নিয়ে আসে, এবং তাদের ন্যায্য ভাবে ও জনস্বার্থে কাজ করার ক্ষমতা সম্পর্কে নানা গুরুতর প্রশ্ন তোলে। এটা প্রত্যাশিত যে যাঁরা সরকারে ক্ষমতা ও দায়িত্বের পদে অধিষ্ঠিত, তাঁরা পেশাদারি শোভনতা বজায় রাখবেন, এবং সব সময় তাঁদের প্রকাশ্য আচরণে সংযম প্রদর্শন করবেন। এই বিষয়টি বিচারক, আইনজীবী ও পুলিশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সরকারি কর্মচারীদের সব সময় মনে রাখতে হবে তাঁদের আচরণ এবং কাজকর্ম যেন অবশ্যই নাগরিকদের মধ্যে আস্থা জাগিয়ে তোলে, এবং এমন যেন মনে না–হয় যে তাঁদের কাজের মধ্যে ব্যক্তিগত বিবাদের জের পড়ছে। এই ক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের কেউই প্রতিষ্ঠিত আচরণ–ধারার চৌহদ্দির মধ্যে থাকছেন বলে মনে হচ্ছে না।
এটা প্রত্যাশিত যে যাঁরা সরকারে ক্ষমতা ও দায়িত্বের পদে অধিষ্ঠিত, তাঁরা পেশাদারি শালীনতা বজায় রাখবেন এবং সব সময় তাঁদের প্রকাশ্য আচরণে সংযম প্রদর্শন করবেন।
এই ঘটনা সুস্পষ্ট ভাবে উচ্চমানের বিচারের ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে বিচারবিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা নিয়ে নাগরিকদের মনে প্রশ্ন তুলেছে। অন্যদিকে, এই ঘটনা অসামাজিক ও দেশবিরোধীদের কাছে এই বার্তা পাঠায় যে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, এবং তাদের আরও ভয়রহিত হয়ে বিপথগামী হতে উৎসাহিত করে। এই দেশে যা ঘটে তার সব ক্ষেত্রেই যা সত্য তা হল রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে এক কদম এগিয়ে যাওয়ার জন্য এই ধরনের প্রতিটি ঘটনাকে কাজে লাগায়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় এ সবের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সুশাসন ও নাগরিকদের। বিচারপতি আনন্দের হত্যাকাণ্ড সকলকে সচেতন করে তোলার জন্য যথেষ্ট, কারণ তা দেখিয়ে দিয়েছে যে অপরাধীরা সুশাসনকে ধ্বংস করতে কতদূর যেতে পারে।
স্থানীয় বিষয়ে শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঢুকে পড়া আরেকটি উদ্বেগজনক ঘটনা। এটি ইতিমধ্যেই কার্যনির্বাহী শাখায় ঘটেছে, যেখানে মন্ত্রী এবং রাজ্যস্তরের কর্মকর্তারা এমন কাজের তত্ত্বাবধানে ছুটে যান যা স্থানীয় ভাবে জেলা কর্তৃপক্ষের দেখার কথা। এখন বিচারবিভাগেও এই ঘটনা ঘটছে। এই ধরনের ঘটনা স্থানীয় অফিসারদের কর্তৃত্বকে ছেঁটে ফেলে, এবং তাঁদের প্রয়াস সমস্যা মোকাবিলার পরিবর্তে নিয়মমাফিক কাজ করার দিকে ঘুরে যায়। এই ধরনের ঘটনা এই সংকেতও পাঠায় যে শাসনের প্রতিটি শাখা নাগরিকদের দেখভালের পরিবর্তে নিজস্ব ক্ষেত্রটিকে রক্ষার চেষ্টা করছে। প্রতিটি ঘটনার পৃথক অনুসন্ধান না করে এই ধরনের বিষয়গুলি কী ভাবে এবং কতটা প্রস্তুতি নিয়ে মোকাবিলা করা উচিত সে সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশিকা জারি করলে তা আরও বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.