অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক শক্তিচালিত অ্যাটাক সাবমেরিন (এসএসএন) সরবরাহ করার জন্য একটি রোডম্যাপ কয়েক মাসের সাসপেন্সের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন (ইউকে) ও অস্ট্রেলিয়া তৈরি করে ফেলেছে। বহুপ্রতীক্ষিত ঘোষণাটি মার্চের মাঝামাঝি ক্যালিফর্নিয়ার সান দিয়েগোতে একটি নৌঘাঁটি থেকে এসেছিল, যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক অওকাস সাবমেরিন প্রোগ্রামের পরামিতিগুলিকে রূপরেখা দিয়েছেন। চুক্তির শর্তাবলি অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০৩০–এর দশকের গোড়ার দিকে অস্ট্রেলিয়ার কাছে তিনটি ব্যবহৃত ভার্জিনিয়া শ্রেণির পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন বিক্রি করবে, এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে প্রয়োজনে আরও দুটি কেনার সুযোগ থাকবে। এর সঙ্গে থাকছে একটি যৌথ মার্কিন–ইউকে সাবমেরিন নির্মাণের উদ্যোগ ও তার পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার নাবিকদের এসএসএন চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া।
অংশীদারেরা চার ধাপের পরিকল্পনায় একমত হয়েছে। ২০২৩ সালের গোড়া থেকেই মার্কিন এসএসএন অস্ট্রেলিয়ায় বন্দরে আরও বেশি করে যেতে থাকবে, আর সেই সময় অস্ট্রেলিয়ার সামরিক ও বেসামরিক কর্মীরা অ্যালায়েড বোট চালনায় অংশ নেবেন এবং পারমাণবিক শক্তিচালিত অ্যাটাক সাবমেরিন চালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। তারপর, ২০২৭ থেকে শুরু করে, মার্কিন ও ব্রিটিশ সাবমেরিনগুলি ঘুরে ঘুরে অস্ট্রেলিয়ায় মোতায়েন হতে থাকবে, এবং অস্ট্রেলিয়া এসএসএন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্দরগুলিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে।
তৃতীয় ধাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ভার্জিনিয়া শ্রেণির এসএসএন স্থানান্তর শুরু হবে। চুক্তি অনুযায়ী ক্যানবেরা ব্রিটেনের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগ করবে। তৃতীয় ও চূড়ান্ত পর্যায়ে, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেন এসএসএন অওকাস তৈরি করতে সহযোগিতা করবে, যা হবে একটি ‘নতুন অত্যাধুনিক প্ল্যাটফর্ম যা তিনটি দেশের সেরা সাবমেরিন প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে’। ইউএস হোয়াইট হাউস প্রকাশিত একটি ফ্যাক্ট শিট অনুসারে, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেন উভয়েই এই সাবমেরিন তৈরি ও মোতায়েন করবে, যা পরবর্তী প্রজন্মের এসএসএন ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হবে এবং তার মধ্যে অত্যাধুনিক মার্কিন সাবমেরিন প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত হবে।
ঘোষণার আগে অস্ট্রেলিয়ার জন্য তিনটি সম্ভাব্য ‘অনুকূল পথ’ ছিল। ক্যানবেরা হয় ইউএস–নির্মিত অথবা ব্রিটেন–নির্মিত জাহাজগুলির মধ্যে একটি বেছে নিতে পারত, বা একটি নতুন প্রজন্মের সাবমেরিন তৈরি করতে এগিয়ে যেতে পারত। তিনটি বিকল্পই চূড়ান্ত পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এবং এইভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে যে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান নেভি (আরএএন) ইউএস ও ইউকে–নির্মিত সাবমেরিন থেকে উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি ইউকে–র সহায়তায় পরবর্তী প্রজন্মের এসএসএন নির্মাণের কাজ শুরু করবে। নিজস্ব এসএসএন–এর কমিশনিং পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার বছরগুলিতে অস্ট্রেলিয়া সহায়তা পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে, যা তার সাবমেরিনের বৈদেশিক মোতায়েন করবে। ঘটনাটিকে তিন সহযোগী ‘সাবমেরিন রোটেশনাল ফোর্স ওয়েস্ট’ হিসাবে উল্লেখ করছে। এর মধ্যে একটি ব্রিটিশ অ্যাসটিউট ক্লাস সাবমেরিনও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা যে মার্কিন বাহিনীর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট খরচ থাকা সত্ত্বেও অংশীদারের সক্ষমতায় বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক, তা বুঝিয়ে দেয় ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে সমন্বিত প্রতিরোধের প্রতি ওয়াশিংটন কতটা দায়বদ্ধ।
উল্লেখযোগ্যভাবে, পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া মিশ্র হয়েছে। অস্ট্রেলীয় বিশেষজ্ঞরা চিনকে নিরস্ত করার জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসাবে এই কর্মসূচিকে দেখে অনেকাংশে উৎসাহিত হয়েছেন। অনেকে বলছেন নতুন সাবমেরিন তৈরির জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় নকশা ও ব্রিটেন–অস্ট্রেলিয়া যৌথ প্রচেষ্টা একটি সপ্রতিভ পদক্ষেপ, কারণ এটি ‘অস্ট্রেলীয় নির্মাণকে ঝুঁকিমুক্ত করতে’ সাহায্য করে৷ একটি নতুন ধরনের পারমাণবিক জাহাজ নির্মাণের অভিজ্ঞতা নেই এমন একটি দেশ অস্ট্রেলিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জগুলি সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। প্রবক্তারা উল্লেখ করেছেন যে অওকাস রোডম্যাপ তৈরিই করা হয়েছে ক্যানবেরার জন্য তার উৎপাদন সুবিধাগুলিকে প্রসারিত করার সময় যন্ত্রণা লাঘবের উদ্দেশ্যে, কারণ এটি নিশ্চিত করে যে প্রাথমিক বছরগুলিতে উৎপাদনের বৃহত্তর অংশ ব্রিটেনের হাতে থাকবে। তা হলেও অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ জাহাজ অস্ট্রেলিয়াই তৈরি করবে, যা সে দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে উপকৃত করবে।
কিন্তু সমালোচকরা দাবি করছেন যে কৌশলটি ব্যয়বহুল এবং খরচ বাড়ার সম্ভাবনা আছে। পরবর্তী তিন দশকে অস্ট্রেলিয়ার মোট খরচ ৩৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা এক বিপুল ব্যয়। অনেক বেশি খরচ–কার্যকর উপায়ে এই একই ফল পাওয়া যেতে পারে। সংশয়বাদীরা যুক্তি দিয়েছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের জন্য ঝুঁকিগুলিও উপেক্ষা করা উচিত নয়। ব্রিটেনের ‘ইন্দো–প্যাসিফিক ঝোঁক’ দেশটির সামরিক বাহিনীকে ক্লান্ত করে দিতে পারে, এবং রাশিয়ার বিপদ মোকাবিলায় সম্পদের ঘাটতি হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার যেহেতু পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় আয়তনগত অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করার ক্ষমতা বা আর্থিক ব্যান্ডউইডথ নেই, তাই খুব বেশি প্রাপ্তি ছাড়াই ওয়াশিংটন দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত প্রযুক্তিগত গোপনীয়তাগুলিকে ভাগাভাগি করতে চলেছে। কেউ কেউ বলেন যে অওকাস–এর দ্বন্দ্বমূলক প্রকৃতি আরও উদ্বেগজনক। চুক্তিটি, তাঁরা মনে করেন, ক্যানবেরার জন্য অশুভ প্রভাবসহ অস্ট্রেলিয়াকে মার্কিন–চিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার পুরোভাগে নিয়ে এসেছে। তাঁদের বক্তব্য, অওকাস অংশীদারেরা সেই অন্তর্ভুক্তির ভারসাম্যকে উপেক্ষা করে যা ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে এত পরিশ্রমের ফলে অর্জন করা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন দেওয়ার পরিকল্পনাটি চিনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অওকাস–এর পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট অভিপ্রায়ের ইঙ্গিত দেয়।
ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঘটনার তাৎপর্য আলাদা। প্রথমত, অস্ট্রেলিয়া ২০২৭ সালের প্রথম দিকে তার প্রথম চারটি মার্কিন ভার্জিনিয়া শ্রেণির সাবমেরিন পেতে পারে, যা বোঝায় যে আগামী বছরগুলিতে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। এটি আরও বোঝায় যে আঞ্চলিক উপকূলগুলি আগের চেয়ে আরও বেশি ঘনসন্নিবিষ্ট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। নয়াদিল্লির জন্য আরও লক্ষণীয় হল ওয়াশিংটন তার ‘মুকুটের রত্ন’ পারমাণবিক চালনা প্রযুক্তি এক কৌশলগত অংশীদারের সাথে ভাগ করে নিতে ইচ্ছুক, যা মার্কিন শক্তির আধুনিকীকরণের পরিকল্পনার জন্য আপাতদৃষ্টিতে একটি খরচ বহন করতে ইচ্ছুক৷ অস্ট্রেলিয়ার কাছে আমেরিকার এসএসএন–এর প্রস্তাব আস্থার একটি বিরাট পদক্ষেপ, কারণ মার্কিন নৌবাহিনী পারমাণবিক অ্যাটাক সাবমেরিনের অভাব পূরণ করতে লড়াই করছে। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা যে মার্কিন বাহিনীর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট খরচ থাকা সত্ত্বেও অংশীদারের সক্ষমতায় বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক, তা বুঝিয়ে দেয় ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে সমন্বিত প্রতিরোধের প্রতি ওয়াশিংটন কতটা দায়বদ্ধ। নিজের জন্য যথেষ্ট মূল্যে অংশীদারদের সহায়তা করার নতুন মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি যদি অ্যাংলোফোন জোটের বাইরেও প্রসারিত করা হয়, তবে আশা করা যায় যে ভারত সেই সহায়তা পেতে পারে যা সে সর্বদা চাইলেও কখনও পায়নি।
অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন দেওয়ার পরিকল্পনাটি চিনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অওকাস–এর পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট অভিপ্রায়ের ইঙ্গিত দেয়। ভারতের মতো অস্ট্রেলিয়াও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে প্রতিকূল কৌশলগত পরিবেশের সম্মুখীন। ক্যানবেরা আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও আগ্রাসী চিনের হুমকির সম্মুখীন। অস্ট্রেলিয়ার নীতিনির্ধারকেরা সঠিকভাবে এমন একটি ভবিষ্যতের বিষয়ে সতর্ক আছেন যেখানে চিন ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাবশালী কুশীলব হয়ে উঠবে, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল থেকে সরে যাবে। তাই তাঁরা মনে করেছেন পারমাণবিক সাবমেরিন তাঁদের অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থরক্ষায় সক্ষম করে তুলতে পারে। অস্ট্রেলীয় অ্যাটাক সাবমেরিনগুলি ভবিষ্যতে এমনকি পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং পূর্ব ভারত মহাসাগরে টহল দিতে পারে, এবং মূল চোকপয়েন্টগুলিকে সুরক্ষিত করতে পারে। এই হল ভারতীয় পর্যবেক্ষকদের কাছে সার কথা। নিজের সামুদ্রিক এলাকার পেছনের অঙ্গনে ভারতের প্রধান নিরাপত্তা ভূমিকাকে ছাপিয়ে অ্যালায়েড নেভির ভূমিকা নিয়ে ভারতের যতই আশঙ্কা থাক, এখন অস্ট্রেলিয়া ও অওকাসের কারণে এই ঝুঁকি নেওয়া উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.