ইথিওপিয়া-সোমালিল্যান্ড বিরোধ ধীরে ধীরে একটি অস্থিতিশীল অঞ্চলকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে এবং এই পরিস্থিতি ঠান্ডা লড়াই মনে করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রক্সি যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে। আঞ্চলিক দেশগুলি যখন পক্ষ নিতে শুরু করেছিল, তখন যে একটি মাত্র দেশ নিরপেক্ষ থাকতে এবং একক ভাবে আঞ্চলিক সমীকরণ পরিবর্তন করতে পেরেছিল, তা হল তুর্কিয়ে। ১১ ডিসেম্বর তুর্কিয়ে ঘোষণা করে যে, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়া আঙ্কারা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে এবং দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস পেয়েছে। এই চুক্তিটি একটি সুরক্ষার ভালভ হিসাবে কাজ করতে পারে এবং এই অঞ্চলে দু’টি প্রধান সমস্যার সমাধান করে। সেই সমস্যা দু’টি হল সোমালিয়ায় ইথিওপিয়ার সৈন্যদের ভবিষ্যৎ এবং একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সোমালিল্যান্ডের চাপ। চুক্তির সাফল্য এই অঞ্চলে তুর্কিয়ের প্রভাবকেও শক্তিশালী করবে।
তুর্কিয়ে ঘোষণা করে যে, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়া আঙ্কারা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে এবং দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস পেয়েছে।
এই অশান্তির আবহ তখন শুরু হয়েছিল, যখন ইথিওপিয়া ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি সোমালিয়ার বিচ্ছিন্ন অঞ্চল সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে সমঝোতাপত্রে (মউ) স্বাক্ষরের কথা ঘোষণা করেছিল। চুক্তির প্রতিক্রিয়া সমগ্র অঞ্চলে এবং এর বাইরেও অনুরণিত হয়েছিল। এই বিতর্কিত চুক্তিতে, ইথিওপিয়া তার বন্দরে বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রবেশাধিকারের বিনিময়ে সোমালিল্যান্ডকে তার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। চুক্তিটি ভূখণ্ডবেষ্টিত ইথিওপিয়াকে কৌশলগত বারবেরা বন্দর ও লোহিত সাগরে প্রবেশাধিকার দিলেও এটি সোমালিয়ার সার্বভৌমত্বের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। কারণ সোমালি সরকার সোমালিল্যান্ডকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে।
ইথিওপিয়া-সোমালিল্যান্ড চুক্তি ও সোমালিল্যান্ডের সম্ভাব্য স্বীকৃতি সংযুক্ত আরব আমিরশাহিকে (ইউএই) উপকৃত করবে। ইউএই অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের মধ্যে বারবেরা বন্দর ও এর আশেপাশের মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল সম্প্রসারণে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং সোমালিল্যান্ডকে সহায়তা দিয়েছে। উপরন্তু, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ইথিওপিয়ার সঙ্গে যৌথ ভাবে বারবেরা করিডোর তৈরি করছে, যার লক্ষ্য হল স্থলবেষ্টিত ইথিওপিয়াকে বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করা। এই অবদানের বিনিময়ে সোমালিল্যান্ড সংযুক্ত আরব আমিরশাহিকে বারবেরায় একটি বিমান ও নৌ ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছে।
চুক্তিটি সারা বছর ধরে এই অঞ্চলটিকে অস্বস্তিকর অবস্থায় রেখেছিল এবং এটিকে প্রতিহত করা বা খারিজ দেওয়ার লক্ষ্যে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছিল। চুক্তি ঘোষণার পরপরই সোমালিয়া চুক্তিটিকে বাতিল ও অকার্যকর বলে ঘোষণা করে এবং সোমালিল্যান্ডের উপর তার সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধেরও হুমকি দেয়। ইতিমধ্যে, মিশর ইথিওপিয়ার সঙ্গে নীল নদের জল-বণ্টন বিরোধ ও গ্রেট ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ বাঁধ (জিইআরডি) নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে এবং এই বিষয়ে পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিশর সোমালিয়া ও ইরিত্রিয়ার সঙ্গে একটি ইথিওপিয়া-বিরোধী জোট গঠন করে, যার মধ্যে একটি যৌথ নিরাপত্তা কাঠামো অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১০ অক্টোবর যখন তিনটি দেশ আসমারায় মিলিত হয়েছিল, তখন এটি স্পষ্ট ছিল যে, উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমগ্র অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে এবং সম্ভাব্য একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের দিকে চালিত করছে।
ইউএই অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের মধ্যে বারবেরা বন্দর ও এর আশেপাশের মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল সম্প্রসারণে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং সোমালিল্যান্ডকে সহায়তা দিয়েছে।
ডিসেম্বরের শুরুতে খবরে প্রকাশিত হয়েছিল যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে পারে এবং তা পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করে তোলে। কয়েক বছর ধরে, কিছু রিপাবলিকান সেনেটর সোমালিয়া থেকে সোমালিল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের চূড়ান্ত কাজগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সোমালিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া এবং ২০২১ সালে বাইডেন এই সিদ্ধান্তের উলটো পথে হাঁটেন। সেনেট কমিটির নেতারাও বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করার দরুন মার্কিন স্বীকৃতির সম্ভাবনা এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রাক্তন ব্রিটিশ আশ্রিত রাষ্ট্র হিসাবে সংযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে ট্রাম্প প্রশাসন আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশটির স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিলে সোমালিল্যান্ড সংযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের উপর চাপ বৃদ্ধি করতে পারে। এই পদক্ষেপটি এমন একটি প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিতে পারে, যা অন্যান্য দেশকে অনুসরণ করতে প্ররোচিত করবে। সোমালিল্যান্ডে সম্প্রতি আর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর পরে একটি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে, যা স্বাধীনতার জন্য দেশটির দাবিকে শক্তিশালী করেছে।
এর প্রতিক্রিয়ায়, হর্ন অফ আফ্রিকায় চিনের দূত সোমালিল্যান্ডের উপর সোমালিয়ার সার্বভৌম অধিকারকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং সোমালিল্যান্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করছেন। তাইওয়ানের সঙ্গে সোমালিল্যান্ডের একটি সুদৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। তাইওয়ান ও সোমালিল্যান্ডের মধ্যে পারস্পরিক ডি ফ্যাক্টো স্বীকৃতি চিনকে বিরক্ত করে এবং চিন এ ভাবে একটি ঐক্যবদ্ধ সোমালিয়ার জন্য প্রচার চালাচ্ছে। ফলস্বরূপ চিনের পদক্ষেপ এই অঞ্চলে চিনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারতের দুর্বল অবস্থানকে পরিবর্তনের জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারে। সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক জোরদার করতে ভারতও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করতে পারে।
তাইওয়ান ও সোমালিল্যান্ডের মধ্যে পারস্পরিক ডি ফ্যাক্টো স্বীকৃতি চিনকে বিরক্ত করে এবং চিন এ ভাবে একটি ঐক্যবদ্ধ সোমালিয়ার জন্য প্রচার চালাচ্ছে।
আঙ্কারা চুক্তির সাফল্য ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল হর্ন অফ আফ্রিকাকে স্থিতিশীল করতে অনেকটাই এগিয়ে দেবে। উভয় নেতার সঙ্গে এরদোগানের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক রয়েছে এবং ২০১১ সাল থেকে তারা সোমালিয়াতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। তুর্কিয়ে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিশুতে তার বৃহত্তম বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে, হাজার হাজার সোমালি সৈন্যকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং মোগাদিশুর বিমানবন্দর ও বন্দর পরিচালনা করেছে। এর পাশাপাশি তারা যথেষ্ট মানবিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করছে। এ দিকে, ২০২১ সালে আবির কাছে তুর্কি সশস্ত্র ড্রোন বিক্রি করার এরদোগানের সিদ্ধান্তটি ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধের ভারসাম্যকে আবির পক্ষে এবং টাইগ্রে বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিমুখ পরিবর্তন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এখন নিশ্চিত করে বলার সময় না এলেও আঙ্কারা চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে দু’টি বাড়তে থাকা বিরোধ সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। চুক্তিটি ইথিওপিয়ান সৈন্যদের সোমালিয়ায় থাকার জন্য রাজনৈতিক পরিসর প্রদান করবে এবং সোমালিল্যান্ড মউ-এর ঊর্ধ্বে উঠে বন্দরে প্রবেশাধিকারের উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্য একটি মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেছে। আঙ্কারা ঘোষণার অধীনে সোমালিয়া আসন্ন আফ্রিকান ইউনিয়ন সাপোর্ট অ্যান্ড স্টেবিলাইজেশন মিশন ইন সোমালিয়ায় (এইউএসএসওএম) ইথিওপিয়ার অংশগ্রহণে তার আপত্তি তুলে নিতে সম্মত হয়েছে। এই শান্তিরক্ষা মিশন সোমালিয়ায় আফ্রিকান ইউনিয়ন ট্রানজিশন মিশন-কে (এটিএমআইএস) প্রতিস্থাপন করবে। এই অঞ্চলে তার সামরিক অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ইথিওপিয়ার সামরিক অবদান অবশ্যই সোমালিয়ায় জিহাদি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করবে। এটি ইথিওপিয়ার জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ মিশনে এর সম্পৃক্ততা তার বাহিনীকে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আকর্ষণ করবে, যা এটিকে তার অন্যান্য কৌশলগত নিরাপত্তা লক্ষ্য অর্জনেও সহায়তা করবে।
যাই হোক, সোমালিয়ার সঙ্গে ইথিওপিয়ার সম্পর্ক আবার সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে হওয়া তার আগের চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ইথিওপিয়া জিবুতিকে বার্ষিক ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করার দরুন ইতিমধ্যেই জিবুতির বাণিজ্যিক বন্দরে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। তাই ইথিওপিয়া সোমালিল্যান্ডের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু চাইতে পারে এবং মনে করা হচ্ছে, তা হতে পারে একটি নৌ ঘাঁটি। সোমালিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি ইথিওপিয়ার লোহিত সাগরে প্রবেশাধিকারকে সুনিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে এবং সোমালি সরকারের কাছ থেকে একটি নৌ ঘাঁটি পাওয়ার বিষয়টিও সে ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং হবে।
বাইডেন প্রশাসন তুর্কিয়ের মধ্যস্থতায় হওয়া চুক্তিকে সমর্থন করলেও জোর দিয়ে এ কথাও বলেছে যে, এটি পারস্পরিক স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ভিত্তিতে সহযোগিতাকে শক্তিশালী করবে।
উপরন্তু, তাঁর লেনদেনমূলক কূটনীতির ইতিহাসের ভিত্তিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেন, তা হলে ট্রাম্প প্রতিবেশী জিবুতিতে তার ঘাঁটি ছাড়াও সোমালিল্যান্ডের ৮৫০ কিমি উপকূলরেখার একটি অংশ চাইতে পারেন। ফলস্বরূপ, ইথিওপিয়া কৌশলগত ভাবে সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ড উভয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখছে। যদিও এখনও পর্যন্ত এই পদ্ধতিটি অনিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছে।
বাইডেন প্রশাসন তুর্কিয়ের মধ্যস্থতায় হওয়া চুক্তিকে সমর্থন করলেও জোর দিয়ে এ কথাও বলেছে যে, এটি পারস্পরিক স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ভিত্তিতে সহযোগিতাকে শক্তিশালী করবে। ট্রাম্প এ বিষয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন, তা এখনও অনিশ্চিত এবং এই চুক্তিটি ইতিমধ্যেই একটি পারস্পরিক উপকারী সমাধান নিয়ে আলোচনা করার জন্য দু’জন পূর্ববর্তী বিরোধী নেতার জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করেছে। উভয় দেশে তুর্কিয়ের কৌশলগত স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে এরদোগান সম্ভবত চুক্তির সাফল্য সুনিশ্চিত করতে নিজের কূটনৈতিক সংস্থান ব্যবহার করবেন। তাঁর জন্য, এটি নিছকই তুর্কিয়ের বিনিয়োগ নয়, বরং এটি হর্ন অফ আফ্রিকার উপর প্রভাব বিস্তারের যুদ্ধও বটে। এই মুহূর্তে মনে করা হচ্ছে, এরদোগান তাঁর সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন।
সমীর ভট্টাচার্য অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.