এক ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধান চলে যাওয়ার ঠিক ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আর এক ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধানের ভারত সফর অবশ্যই অস্বাভাবিক। যাই হোক, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ ২৪-২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতে তাঁর তিন দিনের সফর শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে স্পেনের প্রাইম মিনিস্টার পেদ্রো সানচেজ ২৮ অক্টোবর ভারতে এসে তাঁর দ্বিপাক্ষিক সফর শুরু করেন।
গত দু’বছরে চ্যান্সেলর স্কোলজের এটি তৃতীয় ভারত সফর হলেও গত ১৮ বছরে কোনও স্প্যানিশ রাষ্ট্রপ্রধানের তরফে এটি ছিল প্রথম ভারত সফর। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্পেন সফরের সাত বছর পর পেদ্রো সানচেজ ভারত সফরে আসেন। উভয় নেতার সঙ্গেই এসেছিলেন উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল।
স্কোলজ ও মোদীর সভাপতিত্বে সপ্তম ইন্দো-জার্মান আন্তঃসরকারি পরামর্শের দরুন বাণিজ্য, অভিবাসন, প্রতিরক্ষা, গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের বিষয়ে ২৭টি চুক্তি হয়েছে এবং দূষণহীন হাইড্রোজেন পথনির্দেশিকার মতো নতুন উদ্যোগের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্য দিকে, সানচেজের সফর আটটি ফলাফল প্রদান করেছে, যার মধ্যে বিনিয়োগের জন্য একটি ফাস্ট-ট্র্যাক ব্যবস্থা স্থাপন, রেল পরিবহণে নিবিড় সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
স্কোলজ ও মোদীর সভাপতিত্বে সপ্তম ইন্দো-জার্মান আন্তঃসরকারি পরামর্শের দরুন বাণিজ্য, অভিবাসন, প্রতিরক্ষা, গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের বিষয়ে ২৭টি চুক্তি হয়েছে এবং দূষণহীন হাইড্রোজেন পথনির্দেশিকার মতো নতুন উদ্যোগের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
একই কর্মসূচি, ভিন্ন গন্তব্য
চিরাচরিত ভাবে, ইউরোপে ভারতের বৃহত্তম প্রতিরক্ষা চুক্তি ফ্রান্সের সঙ্গে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করা ছিল স্কোলজ এবং সানচেজ উভয়েরই কর্মসূচির শীর্ষে। জার্মানি এবং স্পেন উভয়ই প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব ও রফতানির জন্য ভারতের লাভজনক বাজারকে পুঁজি করতে চাইছে। কারণ ভারতে বিদেশি পণ্যের প্রবেশ সংক্রান্ত নিয়ম সহজ এবং প্রতিরক্ষা পরিসরে স্থানীয় বেসরকারি ক্ষেত্রের সংস্থাগুলির প্রবেশ অবাধ।
জার্মানির থিসেনক্রুপ এবং স্পেনের নাভান্তিয়া ভারতীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে ছ’টি প্রচলিত ডুবোজাহাজ সহ-উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সানচেজের সফরের সময় গুজরাতের ভাদোদরায় এয়ারবাস ও টাটা এয়ারক্রাফ্ট কমপ্লেক্সের উদ্বোধন হয়। এই অবকাঠামোয় ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের একটি চুক্তিতে ভারতীয় বায়ুসেনার জন্য ৫৬টি সি-২৯৫ বিমান তৈরি হবে, যার মধ্যে ১৬টি বিমান সেভিয়েতে এবং ৪০টি ভাদোদরায় সমন্বিত করা হবে। এয়ারবাস স্পেন ও টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমের মধ্যে এই অংশীদারিত্ব ভারতে হাজার হাজার স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হচ্ছে এবং এটিকে ‘প্রতিরক্ষা খাতে ভারত কর্তৃক প্রদত্ত বৃহত্তম চুক্তি’ বলে তুলে ধরা হচ্ছে। অন্য দিকে, ভারতে অস্ত্র রফতানির অনুমোদনপত্রের প্রয়োজনীয়তা শিথিল করার জন্য জার্মানির নীতির পাশাপাশি দুই সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে একটি পারস্পরিক লজিস্টিক বিনিময় চুক্তি চূড়ান্ত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটি বাঁকবদলকারী বিন্দু। ইউরোপীয় দেশগুলি নিজেদেরকে ভারতের জন্য নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে তুলে ধরছে, যখন একই সঙ্গে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি ও দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদনের উদ্যোগকে জোরদার করছে, যা নয়াদিল্লিকে রাশিয়ার উপর অস্ত্র নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিচ্ছে।
একই কর্মসূচি থাকলেও দুই নেতার সফরসূচি উল্লেখযোগ্য রকমের ভিন্ন ছিল। স্কোলজ নয়াদিল্লি ও গোয়াতে সফর করেন, যখন সানচেজ ভাদোদরা ও মুম্বই যান। মুম্বইতে সানচেজ বলিউডের সঙ্গে স্প্যানিশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সহযোগিতা অন্বেষণ করতে শিল্পাধিপতি এবং ফিল্ম স্টু্ডিয়োগুলির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ইতিমধ্যে, স্কোলজ-এর গোয়া সফরের নেপথ্যে ছিল ইন্দো-জার্মান নৌ কার্যকলাপ, যেখানে জার্মান ফ্রিগেট ব্যাডেন-ওয়ার্টেমবার্গের পোর্ট কল ও ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মেইন-এর সঙ্গে ভারতীয় নৌবাহিনীর যৌথ মহড়া হয়।
ইউরোপীয় দেশগুলি নিজেদেরকে ভারতের জন্য নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে তুলে ধরছে, যখন একই সঙ্গে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচি ও দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদনের উদ্যোগকে জোরদার করছে, যা নয়াদিল্লিকে রাশিয়ার উপর অস্ত্র নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিচ্ছে।
ইউরোপের অর্থনৈতিক মহাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও জার্মান অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে খানিক ধাক্কা খেয়েছে এবং ২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধির হার ০.৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ দিকে, ইইউ-এর চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি স্পেন তুলনামূলক ভাবে স্থিতিশীল থেকেছে এবং বৃদ্ধির হার গড় ইউরোজোনের চেয়ে বেশি ও রুশ গ্যাসের উপর কম নির্ভরতার দরুন নিম্ন মুদ্রাস্ফীতির হার দর্শিয়েছে। ২০২৩ সালে জার্মানির সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাত্রা ছাড়িয়েছে। একই সময়ে স্পেনের সঙ্গে এ দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভবিষ্যৎ বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দিয়ে স্কোলজ এবং সানচেজ উভয়ই ইইউ-ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার অগ্রগতির প্রতি তাঁদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বিশেষ করে ইউক্রেন ও গাজার যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সমস্যা উভয় নেতার সঙ্গে ভারতের আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে। তা সত্ত্বেও, একত্রে কাজ করা এবং এই ধরনের মতপার্থক্য থেকে নিজেদের সম্পৃক্ততাকে দূরে রাখার ক্ষমতা ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের দৃঢ়তাকেই দর্শায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের দরুন ভারত ও জার্মানি ২০২২ সালের মে মাসে সর্বাঙ্গীন গ্রিন অ্যান্ড সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপে স্বাক্ষর করেছে। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে স্পেনের অনন্য সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে দেশের সঙ্গেও অনুরূপ অংশীদারিত্ব লাভজনক হতে পারে। নিজের কর্মশক্তিতে উপস্থিত ফাঁক ভরাট করার জন্য অভিবাসী মেধাবীদের আকর্ষণের উদ্দেশ্যে দক্ষ ভারতীয়দের ভিসার সংখ্যা ২০,০০০ থেকে ৯০,০০০ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার জার্মানির সিদ্ধান্ত জনসংখ্যাগত ও অর্থনৈতিক সমন্বয়কেই দর্শায়।
চিনের ক্ষেত্রে – যা ভারতের জন্য শীর্ষ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে - স্কোলজ এবং সানচেজ উভয়ই ইইউ-এর আরও কড়া অবস্থানের তুলনায় তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। জার্মানিকে প্রায়শই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে দুর্বল বিন্দু হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কারণ জার্মানি নিরাপত্তা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বেজিংয়ের সঙ্গে তার বাণিজ্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে বিশ্বাসী। এ দিকে, সানচেজ ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় নেতা, যিনি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। শি-ও একই সময়ে কিছু দিন আগে মস্কো সফর করেছিলেন। ইইউ-চিন বাণিজ্যিক উত্তেজনা কমাতে এই বছরের সেপ্টেম্বরে সানচেজ আবার চিন সফর করেন। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে জার্মানি চিনা বৈদ্যুতিক যানবাহনের উপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বারা ধার্য শুল্কের বিরুদ্ধে মত দিয়েছে এবং স্পেন মতামত দানে বিরত থাকে। তবুও, অপ্রতিসম অর্থনৈতিক সম্পর্ক (২০২২ সালে চিনের সঙ্গে জার্মানির মোট বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৩.১৮ বিলিয়ন ইউরো এবং একই বছরে স্পেনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ইউরো) চিনের অন্যায্য বাণিজ্য অনুশীলন এবং চিনের প্রতি অতি-নির্ভরতার সঙ্গে জড়িত ঝুঁকিগুলি সংক্রান্ত ক্রমবর্ধমান চাপ চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বৃহত্তর পর্যবেক্ষণ ও শর্তের সূচনা করে। এর সঙ্গে রয়েছে ভারতের মতো অন্যান্য বৃহৎ বাজারের সঙ্গে বাণিজ্যে বৈচিত্র্যকরণের প্রচেষ্টা আনা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের দরুন ভারত ও জার্মানি ২০২২ সালের মে মাসে সর্বাঙ্গীন গ্রিন অ্যান্ড সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপে স্বাক্ষর করেছে।
চিনা আগ্রাসনজনিত উদ্বেগের মাঝেই একটি অবাধ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক বজায় রাখতে জার্মানি ও স্পেন উভয়েরই স্বার্থ এবং এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি জোরদার করার প্রচেষ্টা ভারতের সঙ্গে দেশ দু’টির কৌশলগত সমন্বয় ঘটিয়েছে। স্কোলজ ভারতে আসার আগে জার্মান সরকার তার ‘ফোকাস অন ইন্ডিয়া’ নামক নীতিপত্র প্রকাশ করে, যেখানে ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য উচ্চাভিলাষী ভবিষ্যৎ-ভিত্তিক কর্মসূচি ব্যক্ত করা হয়। সানচেজও ভারতকে কেন্দ্রে রেখে এক নতুন এশীয় কৌশল প্রবর্তনের স্প্যানিশ সরকারের মূল লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেন।
জার্মানি ও স্পেনের ভেতরে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনগুলিও ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। জার্মানির ক্ষেত্রে, আরও সমমনস্ক দেশগুলির উপর নির্ভরতাকে বৈচিত্র্যময় করার পক্ষে ওয়ান্ডেল ডার্চ হ্যান্ডেলের পূর্ববর্তী বণিকবাদী নীতির পরিত্যাগ এবং একটি বৃহত্তর জেইটেনওয়েন্ডে এটিকে নিরাপত্তার বিষয়ে যুদ্ধোত্তর সংবেদনশীলতা হ্রাস করতে সক্ষম করে তুলেছে। স্পেনের ক্ষেত্রে কাতালান বিচ্ছিন্নতাবাদ, অর্থনৈতিক চাপানউতোর এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা-সহ অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির অর্থ হল দেশটি অন্যত্র তার মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তা সত্ত্বেও, আরও সক্রিয় নীতি – যার নেপথ্যে আছে স্থিতিশীল অর্থনীতি - মাদ্রিদকে সম্প্রতি ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও উত্তর আফ্রিকার সঙ্গে প্রথাগত ক্ষেত্রগুলিতে সম্পৃক্ততার ঊর্ধ্বে উঠে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে সাহায্য করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ইউরোপীয় দেশ এবং উপ-অঞ্চলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করেছে। এর পাশাপাশি ভারতের ক্রমবর্ধনশীল অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা উচ্চাকাঙ্ক্ষা, দক্ষ কর্মীবাহিনী ও কার্যকরী গণতন্ত্রের অর্থ হল ভারত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জন্য আকর্ষণীয়ই থাকবে।
শায়রী মলহোত্র অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.