বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ করার কাজটির চেয়ে নির্বাচনী বছরে অন্তর্বর্তী বাজেট পড়া সম্ভবত সহজতর। এটি আরও বেশি করে সত্য এই কারণে যে অন্তর্বর্তী বাজেট কোনওভাবেই পুরো বছরের জন্য অর্থনীতির পথ নির্দেশ করে না। বরং একে একটি ‘সাময়িক’ ব্যবস্থা হিসাবে দেখতে হবে, যা হয় অতীতের নীতিগুলির ধারাবাহিকতা নির্দেশ করতে পারে, অথবা সেই পরিকল্পনাগুলির রূপরেখা চিহ্নিত করতে পারে যা ক্ষমতাসীন পক্ষ ফের ক্ষমতায় ফিরে এলে অনুসৃত হবে। প্রায়শই একটি নির্বাচনী বছরে অন্তর্বর্তী বাজেটের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে ‘জনতাবাদ’ (পপুলিজম), যার কারণ সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। অতএব, একটি বিদ্যমান ব্যবস্থার জন্য একটি নির্বাচনী বছরে অন্তর্বর্তী বাজেট প্রণয়নের নীতিগুলি খুব ভালভাবে নির্দিষ্ট করা আছে।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন উপরে উল্লিখিত সমস্ত নীতিগুলিই অনুসরণ করেছেন। বাজেটে এমন কিছু নেই যা নাটকীয় বা যা অতীতের প্রবণতা থেকে কোনও দৃষ্টান্তমূলক বিচ্ছেদ বোঝায়। বর্তমান ভূ–রাজনৈতিক ও বিশ্বের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটের পরিপ্রেক্ষিতে এর কোনও প্রয়োজনও নেই। সমস্ত প্রধান অর্থনীতির মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতি হল সেরা কর্মক্ষমতা–প্রদর্শনকারী অর্থনীতি, এবং স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস গ্লোবাল ক্রেডিট আউটলুক ২০২৪ অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার মঞ্চ বাঁধা হয়ে গিয়েছে। অর্থনীতির অনুমিত জিডিপি বৃদ্ধি ২০২৩ সালের ৬.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি তা সত্য হয়, ভারত আগামী তিন বছরে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি হিসাবে আবির্ভূত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বলাই বাহুল্য, গত কয়েক বছরে ভারতীয় অর্থনীতিতে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তন এসেছে, এবং তা এখনও রূপান্তরিত হচ্ছে!
সুতরাং, এই পর্যায়ে অর্থমন্ত্রীর কাজ ছিল বৃদ্ধির সেই পরামিতিগুলির হেরফের না–করা, যেগুলি নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে বা স্বাভাবিকভাবে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রস্থলে এসে গিয়েছে এবং সামষ্টিক সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুত লক্ষ্যের দিকে অর্থনীতিকে চালিত করেছে। সম্মিলিত সমৃদ্ধির দৃষ্টিভঙ্গি এই ব্যবস্থার মূল মন্ত্র, এবং যথাযথভাবে এই বাক্যাংশে তার মর্মার্থ দেওয়া হয়েছে: ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, অওর সবকা বিশ্বাস’। এই বাজেটেও সেই শব্দগুচ্ছ প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেছেন: ‘‘... আমাদের উন্নয়ন দর্শন অন্তর্ভুক্তির সমস্ত উপাদানকে আবৃত করে, যেমন, সমাজের সকল স্তরের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং দেশের সমস্ত অঞ্চলের উন্নয়নের মাধ্যমে ভৌগোলিক অন্তর্ভুক্তি।’’
বিগত কয়েকটি বাজেটে সরকার একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে: তার উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘বৃদ্ধি–কেন্দ্রিকতা’ থেকে গেলেও তা বিতরণমূলক ন্যায়বিচার বা স্থিতিশীলতার মূল্যে নয়। বরং, কিছু কিছু বিবেচনায় গত কয়েকটি বাজেট এই ধারণাই দেয় যে সরকার ক্রমাগতভাবে চিন্তা করছে যে বৃদ্ধি মানব পুঁজি ও প্রাকৃতিক পুঁজি দ্বারা চালিত হবে, এবং তা ধরে রাখতে হবে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন: ‘‘... আমাদের উন্নয়ন দর্শন অন্তর্ভুক্তির সমস্ত উপাদানকে আবৃত করে, যেমন, সমাজের সকল স্তরের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং দেশের সমস্ত অঞ্চলের উন্নয়নের মাধ্যমে ভৌগোলিক অন্তর্ভুক্তি।’’ এটি এই ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি, যা আঞ্চলিক উন্নয়ন ও সামাজিক গতিশীলতার মাধ্যমে সামাজিক পুঁজির বিকাশের উপর জোর দেয়।
অতএব, অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পদ’–এর দৃষ্টিভঙ্গির মূল বিষয়গুলিকে আঁকড়ে থেকেছে, এবং এর চারটি পরামিতির উপর কাজ করেছে: ভৌত পুঁজি, প্রাকৃতিক পুঁজি, সামাজিক পুঁজি ও মানবিক পুঁজি। ভৌত পুঁজির ক্ষেত্রে সংযোগ ও সম্পদ সৃষ্টির জন্য ভৌত পুঁজি বিকাশের মূলধন ব্যয় (ক্যাপেক্স) তিনগুণ করে ভারতীয় অর্থনীতি গত চার বছরে বিরাট সাফল্য দেখেছে। অন্তর্বর্তী বাজেটে আগামী বছরের জন্য ব্যয় ১১.১ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা জিডিপির ৩.৪ শতাংশের সমান। এটা লক্ষণীয় যে ক্যাপেক্সের গুণক প্রভাব বিভিন্ন পরিস্থিতিতে রাজস্ব ব্যয় গুণকের চেয়ে ১.৫–৩ গুণ বেশি বলে অনুমান করা হয়েছে। রেলওয়ে, মেট্রো ইত্যাদির ক্ষেত্রে সংযোগ উদ্যোগের ইঙ্গিত ছাড়াও, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ক্যাপেক্স সাধারণত ব্যবসা করার লেনদেনের খরচ কমিয়ে আনে এবং ব্যবসা–সক্ষম পরিবেশকে বাড়িয়ে তোলে। অন্যদিকে, সামাজিক পুঁজি ‘সবকা সাথ’–এর বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে সংযুক্ত, যা দরিদ্রদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায়িত অংশীদার করে তুলেছে। এর থেকে আসে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার প্রশ্ন, যা পিএম–জন ধন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে সরাসরি সুবিধা হস্তান্তর প্রকল্পগুলিতে মূর্ত রয়েছে। তবে, মানব পুঁজির গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি যুব ও নারীদের দক্ষতা, ক্ষমতায়ন ও শিল্পোদ্যোগীদের মধ্যে নিহিত রয়েছে বলে মনে হয়। প্রাকৃতিক পুঁজির জটিল অংশটি সবুজ বৃদ্ধির মাধ্যমেও সমাধান করা হয়েছে, যেমন, ইভি বাস্তুতন্ত্র প্রণোদনা, জৈব–উৎপাদন ও বায়ো–ফাউন্ড্রি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, নীল অর্থনীতি।
ভৌত পুঁজির ক্ষেত্রে সংযোগ ও সম্পদ সৃষ্টির জন্য ভৌত পুঁজি বিকাশের মূলধন ব্যয় (ক্যাপেক্স) তিনগুণ করে ভারতীয় অর্থনীতি গত চার বছরে বিরাট সাফল্য দেখেছে।
ন্যায্যতা ও দক্ষতার একটি উপাদান হিসাবে আঞ্চলিক উন্নয়ন
বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে: “... আমাদের উন্নয়ন দর্শন অন্তর্ভুক্তির সমস্ত উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যথা,
❁ সমাজের সকল স্তরের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, এবং
❁ দেশের সকল অঞ্চলের উন্নয়নের মাধ্যমে ভৌগোলিক অন্তর্ভুক্তি।
প্রথম অংশ, ‘সামাজিক অন্তর্ভুক্তি’, বিশুদ্ধভাবে বিতরণমূলক ন্যায়বিচারের বিষয়। দ্বিতীয় অংশ, ‘ভৌগোলিক অন্তর্ভুক্তি’, লক্ষ্য রাখে ন্যায্যতা ও দক্ষতার দিকে। দক্ষতার বিষয়টি এই সত্য থেকে উদ্ভূত হয় যে বাজেট বক্তৃতায় দেশের পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে – আঞ্চলিক উন্নয়ন অবশ্যই সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এখানে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ পূর্বাঞ্চলে আছে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পুঁজি এবং সস্তা মানব পুঁজির বড় ভান্ডার। এটি অর্থনীতির বৃদ্ধিকে সমর্থন করার জন্য পূর্বাঞ্চলকে একটি নিখুঁত পশ্চা্ৎভূমিতে (হিন্টারল্যান্ড) পরিণত করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, প্রচুর ও সস্তা মানব পুঁজি এবং প্রাকৃতিক পুঁজি উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে পারে, দক্ষতা বাড়াতে পারে এবং ভারতের তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশের ক্রমবর্ধমান উপভোগের চাহিদা পূরণ করতে পারে। তা ছাড়া, এটি ভারতকে বৈশ্বিক ব্যবসার ‘চিন+১’ কৌশলের দৃশ্যে তার প্রতিযোগিতামূলক শক্তিকে আরও স্পষ্টভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করতে পারে।
খরচ, সঞ্চয়, ও বিনিয়োগ
অন্তর্বর্তী বাজেট, যৌক্তিকভাবে, কর কাঠামোতে কোনও পরিবর্তন আনেনি। ২০২৪ সালের মার্চের শেষের দিকে যে কর সুবিধাগুলির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে তা মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে৷ এর মধ্যে স্টার্ট–আপ, সার্বভৌম সম্পদ বা পেনশন তহবিলের বিনিয়োগ এবং কিছু আইএফএসসি ইউনিটের নির্দিষ্ট আয়ের উপর ছাড় দেওয়ার সুবিধাগুলি অন্তর্ভুক্ত। আরও, ২০০৯–১০ আর্থিক বছর পর্যন্ত ২৫,০০০ ভারতীয় রুপি পর্যন্ত এবং ২০১০–১১ থেকে ২০১৪–১৫ আর্থিক বছরের জন্য ১০,০০০ ভারতীয় রুপি পর্যন্ত অমীমাংসিত বা বিতর্কিত প্রত্যক্ষ কর দাবি প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ এটি সৎ করদাতাদের অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা কমাতে সাহায্য করে এবং অনুবর্তিতা খরচ কমিয়ে আনে।
অর্থনীতির উদারীকরণের পর থেকে উপভোগ বৃদ্ধির একমাত্র চালিকা হওয়া কিন্তু অর্থনীতির পক্ষে ভাল নয়
যাই হোক, দীর্ঘমেয়াদে, এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে ভারতীয় অর্থনীতি এখনও পর্যন্ত ব্যাপকভাবে উপভোগচালিত বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু বিনিয়োগকে উন্নত করার জন্য ব্যক্তিগত সঞ্চয় সংগ্রহের অত্যন্ত প্রয়োজন। অর্থনীতির উদারীকরণের পর থেকে উপভোগ বৃদ্ধির একমাত্র চালিকা হওয়া কিন্তু অর্থনীতির পক্ষে ভাল নয়। ভোগের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য দেশীয় বেসরকারি বিনিয়োগ এবং এফডিআই–এর অত্যন্ত প্রয়োজন। অতএব, কর যৌক্তিককরণ এবং জিএসটি–র বাস্তবায়ন, গভীর এবং ব্যাপক–ভিত্তিক করা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, সঞ্চয়ের গুরুত্ব থেকেই যায়।। অতএব, যদিও পিএম জন–ধন দরিদ্রদের সঞ্চয় করতে সাহায্য করছে, এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে নিষ্পত্তিযোগ্য আয় এবং সঞ্চয়ের হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ভবিষ্যৎ ভারতের একটি বহুমুখী বৃদ্ধির কৌশল প্রয়োজন।
শেষ করার সময়…
এই অন্তর্বর্তী বাজেটের সারার্থ দুটি মূলবিন্দুর মাধ্যমে বিবৃত করা যেতে পারে। প্রথমত, এটি বছরের পর বছর ধরে যা ঘটেছে তারই ধারাবাহিকতা, কিন্তু আর্থিক সংহতিকরণের প্রচেষ্টার সঙ্গে। কোভিড–১৯–এর ধাক্কার কারণে আর্থিক ঘাটতির আকস্মিক বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সংহতিকরণ একটি বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ। এই বাজেটে ২০২৪–২৫ সালের ঘাটতিকে ৫.১ শতাংশ বলে মনে করা হয়েছে, যার থেকে এই সঙ্কেত স্পষ্ট যে ঘাটতি ৪.৫ শতাংশের নিচে নামাতে অর্থনীতি ঠিক পথে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী বাজেট ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতায় এলে ভবিষ্যতে কী করা হবে তার ইঙ্গিত দেয়। অমৃত কালের জন্য এর কিছু দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য রয়েছে, এবং সেইজন্য ছোট মাইলফলকগুলি অর্জন করতে হবে — এটি বিকশিত ভারতের জন্য উপ–রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের গুরুত্বও উপলব্ধি করে।
নিশ্চিন্ত থাকুন যে এই বাজেটের পিছনের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা সঠিক পথে রয়েছে — ভারত আগামীতে পুঁজিচালিত বৃদ্ধির পথে এগোবে। পুঁজি বলতে যা বোঝায় তার চারটি রূপ: মানব, প্রাকৃতিক, সামাজিক ও ভৌত, এবং এর কোনওটিই অন্য একটি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে না।
নীলাঞ্জন ঘোষ অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একজন ডিরেক্টর
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.