Published on Sep 12, 2024 Updated 0 Hours ago

চিন এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দক্ষিণ চিন সাগরে বিদ্যমান সংঘর্ষ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য আর কটি গুরুতর এমন হুমকিকে দর্শায়, যা সরাসরি আফ্রিকাকে প্রভাবিত করে।

দক্ষিণ চিন সাগর বিরোধে আফ্রিকার সূক্ষ্ম কূটনীতি

চিন যখন বিশ্বব্যাপী আধিপত্য এবং প্রভাবের প্রতিযোগিতায় ক্রমআক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে চিনের উত্থান ঠেকানোর যুদ্ধে নিমজ্জিত হচ্ছে, বিশ্ব বেশ অস্বস্তি নিয়েই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদ্ঘাটনের সাক্ষী হচ্ছে। কয়েকটি জায়গায় এই উদ্বেগজনক প্রতিযোগিতা থেকে তীব্র চাপ অনুভূত হলেও দক্ষিণ চিন সাগর (এসসিএস) অঞ্চলে হিংসা ক্রমশ বড় আকার ধারণ করছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে। ইউক্রেন বা গাজার যুদ্ধের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন এসসিএস-এ সরাসরি যুদ্ধ শুরু করতে পারে। এবং এই বহুমুখী নতুন ঠান্ডা লড়াই ২.০-এর মাঝে আফ্রিকা সতর্ক থাকছে।

 

ইউক্রেন বা গাজার যুদ্ধের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন এসসিএস-এ সরাসরি যুদ্ধ শুরু করতে পারে।

 

দক্ষিণ চি সাগর যেন বারুদের বাক্স

২৩ এপ্রিল চিন এবং ফিলিপিন্সের মধ্যে আর কটি সংঘর্ষ ঘটে, যখন দুটি ফিলিপিনো টহলদার নৌকা ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জ প্রদেশ পালাওয়ানের প্রায় ১৯৪ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি বিতর্কিত শোলের অগভীর ফিরোজারঙা জলের কাছে চলে আসে। চিন এবং ফিলিপিন্স উভয়ের দাবিকৃত বিতর্কিত শোলের কাছে জলের নীচে সমীক্ষার জন্য টহলদার নৌকা রাখা ছিল। ফলে ফিলিপিনো নৌকার আগমন চিনের তরফে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। এক চিনা উপকূলরক্ষী রেডিয়োর মাধ্যমে ফিলিপিনো নৌকাটিকে তাদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় এবং না চলে গেলে শত্রুতামূলক ব্যবস্থার হুমকি দেয়। বেশ কয়েকটি রেডিয়ো বার্তা বিনিময়ের পরে চিনা উপকূলরক্ষীরা ফিলিপিন্সের দুই নৌকাকেই তীব্র গতিসম্পন্ন জল কামান দিয়ে জল ছুড়ে নষ্ট করে দেয়।

যাই হোক, এই অঞ্চলে চিনের দাবি নিয়ে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া-সহ অন্য এসসিএস প্রতিবেশীদের সঙ্গে সংঘর্ষ এই প্রথম নয়। চিন এই অঞ্চলে তার দাবি প্রদর্শন করতে ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনামের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ইইজেড অতিক্রম করে একটি অপ্রত্যাশিত ইউ আকৃতির নাইন-ড্যাশ লাইন ব্যবহার করেছে। তাদের কম অভ্যন্তরীণ মূল্য থাকা সত্ত্বেও অঞ্চলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য এবং সরবরাহ করিডোর বরাবর অবস্থিত, যা বার্ষিক জাহাজবাহিত বাণিজ্যে ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সমর্থন জোগায়। এই অঞ্চলে তেল, গ্যাস এবং মাছ ধরার উৎস বিপুল

বেজিং পার্মানেন্ট কোর্ট অফ আরবিট্রেশনের ২০১৬ সালের একটি সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিতে অসম্মত হয়েছে। এই আদালত বেজিংয়ের বিস্তৃত দাবিগুলিকে চিরাচরিত ভিত্তির অবৈধ বলে রায় দিয়েছে। সেকেন্ড টমাস শোল এবং বাশি চ্যানেল নিয়ে চিন ও ফিলিপিন্স এরই মধ্যে বহু বার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। চিন গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলে ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে উঠেছে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এখনও অবধি এই সংঘর্ষগুলি সম্ভবত কোনও পূর্ণ দৈর্ঘ্যের যুদ্ধে পরিণত না হয়ে আঞ্চলিকই হয়ে থেকেছে। তবে, এ হেন যুদ্ধে হতাহত হওয়ার বা এমনকি জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিকে কোনও মতেই অস্বীকার করা যায় না।

 

এসসিএস-কে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াই ২.০-এর নির্মাণ

আসন্ন সঙ্কটের বিষয়ে ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া এখনও যথেষ্ট বিনয়ী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এসসিএস-চিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে ফিলিপিন্সকে বিতর্কিত সেকেন্ড টমাস শোল-এ তার বাহিনী পুনঃসঞ্চালনে বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টাও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার চিনকে সতর্ক করেছে যে, ফিলিপিনো বাহিনীর কোনও জাহাজ বা বিমান যদি সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হয়, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় তার প্রাচীনতম চুক্তি অনুযায়ী মিত্রদেশ ফিলিপিন্সকে রক্ষা করতে বাধ্য হবে

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৬০০০-এরও বেশি মার্কিন ও ফিলিপিনো সামরিক কর্মী নিয়ে ফিলিপিন্সের সঙ্গে বালিকাতামহড়া (তাগালগ ভাষায় যার অর্থ হল কাঁধে কাঁধ’ মিলিয়ে) পরিচালনা করেছে। প্রকৃতপক্ষে এর সংস্থানগুলি তেমন মজবুত নয় এবং বেজিং এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৬০০০-এরও বেশি মার্কিন ও ফিলিপিনো সামরিক কর্মী নিয়ে ফিলিপিন্সের সঙ্গে বালিকাতামহড়া (তাগালগ ভাষায় যার অর্থ হল কাঁধে কাঁধ’ মিলিয়ে) পরিচালনা করেছে। প্রকৃতপক্ষে এর সংস্থানগুলি তেমন মজবুত নয় এবং বেজিং এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা কূটনীতি বৃদ্ধি করে চিনকে নিরস্ত করার জন্য ওয়াশিংটন জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ফিলিপিন্সের সঙ্গে একটি নিরাপত্তা জোটের সম্ভাবনা অন্বেষণ করছে, যাকে অস্থায়ী ভাবে স্কোয়াড বলা হয়। এটি এই অঞ্চলে বিদ্যমান দুটি গোষ্ঠী অর্থাৎ কোয়াড এবং অউকাস ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্থাপন করেছে। যদিও অউকাস একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং কোয়াড কেবল আলোচনার উদ্দেশ্যে তৈরি করা একটি মঞ্চ মাত্র।

 

আফ্রিকার ভারসাম্য বজায় রাখার কঠিন খেলা

এমনকি যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়া আফ্রিকা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তখন তারই মাঝে এসসিএস-এ বিদ্যমান সংঘর্ষ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য আর কটি গুরুতর হুমকির প্রতিনিধিত্ব করে, যা সরাসরি আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশকে প্রভাবিত করে। ভৌগোলিক ভাবে অনেক দূরে থাকা সত্ত্বেও কিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা এবং মূল্য উভয়ের ক্ষেত্রেই এই বিরোধ মহাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করবে।

উপরন্তু, এসসিএস অঞ্চলটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উৎস হিসেবে আফ্রিকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক পরিসরের প্রতিনিধিত্ব করে যা অনেক আফ্রিকান অর্থনীতির জন্য প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে সহায়ক। বিশেষ করে তেল আমদানিকারক দেশগুলির জন্য এই সঙ্কট জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে। অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের ফলপ্রসূ মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশির ভাগ আফ্রিকান দেশে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার উপর বিরাট প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া, অনেক আফ্রিকান অর্থনীতি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সাহায্যের উপর ব্যাপক ভাবে নির্ভর করেএই সঙ্কট মহাদেশের উন্নয়ন এবং বৃদ্ধিকে উল্লেখযোগ্য ভাবে ব্যাহত করবে।

আফ্রিকার এই সংঘাত থেকে শেখার জন্য কৌশলগত পাঠও রয়েছে। আফ্রিকায় চিনের প্রধান স্বার্থ হল তার বিআরআই বিনিয়োগ রক্ষা করা এবং স্থির বাণিজ্য প্রবাহ সুনিশ্চিত করা। চিনের সম্পদের চাহিদা পূরণ, শিল্প প্রবৃদ্ধি ও জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য আফ্রিকাও অপরিহার্য। অতএব, চিন যে সব দেশে বিনিয়োগ করেছে সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যেমন চিনের স্বার্থ, তেমনই আবার চিনের সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক রাখা সেই সব বিনিয়োগের অভাবে ধুঁকতে থাকা দেশগুলির জন্যও অপরিহার্য।

 

চিনের সম্পদের চাহিদা পূরণ, শিল্প প্রবৃদ্ধি ও জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য আফ্রিকাও অপরিহার্য। অতএব, চিন যে সব দেশে বিনিয়োগ করেছে সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যেমন চিনের স্বার্থ, তেমনই আবার চিনের সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক রাখা সেই সব বিনিয়োগের অভাবে ধুঁকতে থাকা দেশগুলির জন্যও অপরিহার্য।

 

এর পাশাপাশি যেহেতু চিনের অনেক বিনিয়োগ প্রকল্প আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অবস্থিত, তাই এই দেশগুলি সতর্ক হওয়া উচিত। চিন আক্রমণাত্মক ভাবে আফ্রিকাতেও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে বর্তমানে চিন জিবুতিতে একটি নৌ ঘাঁটি এবং ডারবানের উপকূলে একটি ব্যালিস্টিক মিসাইল ট্র্যাকার ইউয়ান ওয়াং ৫-এর মালিক। চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) জন্য আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের দেশগুলিতে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। পশ্চিম উপকূলে চিনের অনেক সমুদ্রবন্দর রয়েছে, যা চিনা সংস্থার অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে।

যদি এই দেশগুলির জাতীয় সরকারগুলি অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হয়, তবে চিসানন্দে এই বন্দরগুলিকে লিজের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করবে যেমনটা তারা শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটার ক্ষেত্রে করেছিল। শ্রীলঙ্কা ছাড়াও, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের মতো অন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিও তাদের বিআরআই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিল, যার ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং কখনও কখনও রাজনৈতিক সঙ্কটও দেখা দিয়েছে। অতএব, এই আফ্রিকান সরকারগুলির কাছ থেকে সতর্কতা আশা করা যেতে পারে।

 

উপসংহার

এসসিএস-কে ঘিরে চিনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী ভঙ্গি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি করেছে। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের মধ্যে বর্তমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ঠান্ডা লড়াইয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, তাই একটি নতুন ঠান্ডা লড়াই ২.০-এর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই অঞ্চলে চিনের আগ্রাসনের পাশাপাশি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

নিঃসন্দেহে, চিন এবং ফিলিপিন্সের মধ্যে যে কোনও গুরুতর সংঘর্ষ বিপজ্জনক হবে। এই ঘন ঘন সংঘর্ষগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে চালিত করতে পারে না। তা সত্ত্বেও জাহাজ ডুবে যাওয়া এবং হতাহতের ঝুঁকিও বেশ উচ্চ। এ ধরনের যে কোন ঘটনা আফ্রিকায় শেষ পর্যন্ত সঙ্কটেরই জন্ম দেবে। এখনও অবধি আফ্রিকা সতর্ক রয়েছে এবং তার বৃহৎ শক্তি সমীকরণের ভারসাম্য বজায় রেখেছে। নিঃসন্দেহে, আফ্রিকা এই অঞ্চলে চিনাদের আগ্রাসী ভঙ্গি নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন। অন্য দিকে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে আফ্রিকার আবার চিনকে প্রয়োজনও। অতএব, আফ্রিকা দৃঢ় ভাবে এমন ভারসাম্যই বজায় রাখতে চাইবে, যেখানে তারা চিনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না গিয়েও সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে।

 


সমীর ভট্টাচার্য অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.