২০২৪ সালটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাইজেরিয়ায় ঐতিহাসিক সফরের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে, যা একাধিক কারণে ভারত-আফ্রিকা সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক চিহ্নিত করেছে। গত ১৭ বছরের মধ্যে এটিই ছিল কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম নাইজেরিয়া সফর এবং সর্বোপরি ২০২৪ সালের মে মাসে মোদী পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর এটিই ছিল তাঁর প্রথম আফ্রিকা সফর। প্রথম দুই মেয়াদে মোদী উগান্ডা-সহ আফ্রিকার ১০টি দেশে ভ্রমণ করেছিলেন, যেখানে তিনি আফ্রিকা সম্পর্কে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির রূপরেখা দিয়ে যুগান্তকারী বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। নাইজেরিয়া সফরের সময় তাঁকে নাইজেরিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার অর্থাৎ ‘গ্র্যান্ড কম্যান্ডার অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য নাইজার’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার পরে (১৯৬৯ সালে) মোদীই সেই দ্বিতীয় বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, যিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
মোদীর সফরটি গত বছরের শুরুর দিকে একটি ভারতীয় প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিনিধিদলের লাগোস সফরের পরপরই ঘটেছে। ওই প্রতিরক্ষা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার সময়ে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ টিনুবু ভারত থেকে অস্ত্র কেনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের ঐতিহাসিক জি২০ প্রেসিডেন্সির সময় গ্রুপ অফ টোয়েন্টি (জি২০) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য মোদী নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্টকে বিশেষ ভাবে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। টিনুবু ঘোষণা করেছিলেন যে, নাইজেরিয়া ভারতের সঙ্গে একটি নতুন ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের প্রতিরক্ষা চুক্তি চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ভারতীয় লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট বা হালকা যুদ্ধ বিমান (এলসিএ) তেজস, ড্রোন ও সাঁজোয়া কর্মী বাহক কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
মোদীর সফরটি গত বছরের শুরুর দিকে একটি ভারতীয় প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিনিধিদলের লাগোস সফরের পরপরই ঘটেছে।
ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) ইতিমধ্যেই নাইজেরিয়ার ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যুরোর (ডিআরডিবি) সঙ্গে প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার জন্য একটি সমঝোতাপত্র (মউ) স্বাক্ষর করেছে। শীর্ষ সম্মেলনের সময় ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ডিফেন্স কর্পোরেশন অফ নাইজেরিয়ার (ডিআইসিওএন) সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই সহযোগিতাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এর দরুন ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ডিআইসিওএন-কে ২০২৭ সালের মধ্যে সামরিক হার্ডওয়্যার উত্পাদনে ৪০% স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সহায়তা করবে। আগামিদিনে গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকা থেকে নানা দেশ নাইজেরিয়ার পথ অনুসরণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব
মিশর, আলজেরিয়া, মরক্কো, তানজানিয়া ও মোজাম্বিকের কাছে অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে ভারত আফ্রিকার একটি প্রধান প্রতিরক্ষা সরবরাহকারী হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। এই ক্ষেত্রটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ভারত ডেফএক্সপো সামরিক প্রদর্শনীর পাশাপাশি ভারত-আফ্রিকা প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলন বা ইন্ডিয়া-আফ্রিকা ডিফেন্স মিনিস্টারস কনফারেন্সের (আইএডিএমসি) আয়োজন করছে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকও ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের প্রতিরক্ষা রফতানির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং আফ্রিকাতে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি না করলে এই লক্ষ্য পূরণ করা অসম্ভব। ভারত সবসময় আফ্রিকার নিরাপত্তায় একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছে এবং শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী দেশ হয়ে উঠেছে। ভারতই প্রথম জিবুতি, ইথিওপিয়া, আইভরি কোস্ট, মোজাম্বিক ও তানজানিয়া-সহ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে প্রতিরক্ষা সংযুক্তি মোতায়েন করতে প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রীর সফর আফ্রিকার সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
গত বছর, জনকূটনীতির ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল, যখন জানুয়ারি মাসে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর উগান্ডায় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা নন-অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট (এনএএম) সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ভারত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনএএম-কে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ দ্বারা চালিত একাধিক দেশ গ্লোবাল সাউথ নেতৃত্বের জন্য মুখিয়ে থাকলেও আফ্রিকার প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তৃণমূল স্তরে ভারতের হস্তক্ষেপ দেশটিকে অন্যদের চাইতে অনেকাংশে আলাদা করে তুলেছে।
ভারতই প্রথম জিবুতি, ইথিওপিয়া, আইভরি কোস্ট, মোজাম্বিক ও তানজানিয়া-সহ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে প্রতিরক্ষা সংযুক্তি মোতায়েন করতে প্রস্তুত।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মোদী এবং মরিশাসের প্রাইম মিনিস্টার প্রবিন্দ জুগনাউথ আগালেগার মরিশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে যৌথ ভাবে একটি এয়ারস্ট্রিপ ও জেটির উদ্বোধন করেছিলেন। এটি এবং মরিশাসে আরও ছ’টি ভারত-সহায়ক উন্নয়ন প্রকল্প ভারতের সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল (সাগর) নীতির অংশ। এই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সামুদ্রিক সম্পর্ক বাড়ানোর পাশাপাশি পরিকাঠামোর প্রতি মনোযোগও পশ্চিম ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নিরাপত্তা শক্তি হিসেবে ভারতের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকেও দর্শায়।
২০২৪ সালে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে নির্বাচন হয়েছে। বছরটিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ ও হিংসার ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। আফ্রিকায় সুদানের দুই সামরিক জেনারেল ক্ষমতার জন্য লড়াই করেছেন এবং এর দরুন দু’লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় ও কুড়ি লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ হেন বাধা সত্ত্বেও, ভারত এবং আফ্রিকা তাদের সম্পৃক্ততাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। ২০২৫ সালটি ভারত-আফ্রিকা সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। বৈশ্বিক অশান্তি অব্যাহত থাকায় গ্লোবাল সাউথের সমস্যাগুলি উত্থাপনের জন্য একটি শক্তিশালী ভারত-আফ্রিকা অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ হবে। ভারতের জি২০ সভাপতিত্বের সময় ও পরে ভারত ভয়েস অফ দ্য গ্লোবাল সাউথ সামিট-এর (ভিওজিএসএস) তিনটি সংস্করণের আয়োজন করেছিল, যে সম্মেলনে আফ্রিকার সমস্ত দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। যাই হোক, ভিওজিএসএস ছিল ভার্চুয়াল সংস্করণ। সর্বোপরি, এটি সমস্ত গ্লোবাল সাউথ দেশগুলিকেই অন্তর্ভুক্ত করে, যার ফলে আফ্রিকার গুরুত্ব খানিকটা হলেও হ্রাস পেয়েছিল। যেহেতু সারা বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকা অশান্তির ঝড় এ বার ধীরে ধীরে শান্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে, তাই ভারত-আফ্রিকা ফোরাম সামিটের (আইএএফএস) বহু প্রতীক্ষিত চতুর্থ সম্মেলনের আয়োজন করে ভারত-আফ্রিকা সম্পর্ক ফের পুনরুজ্জীবিত করার সময় এসেছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ডেকান হেরাল্ড-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.