ইউনাইটেড স্টেটস (ইউএস) নির্বাচনী পর্যায়ে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব আরও এক বিচ্যুতি বিন্দুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বাস্তবায়নের দাবিতে মার্কিন সেনেটে বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টি ইউক্রেন এবং ইজরায়েল ত্রাণ বিলকে খারিজ করেছে। বিলটিতে ইউক্রেন এবং ইজরায়েলকে ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা প্রদান করার কথা ছিল।
ইতিমধ্যে ৫০ বিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাবিত ইইউ ত্রাণটি কী ভাবে অর্থায়িত হবে, তা নিয়ে গোষ্ঠীর মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে তা এখনও পাস করা হয়নি। তবে অর্থ আসার সম্ভাবনা ঘুচে যায়নি। কিন্তু এ হেন অনিশ্চয়তা ও অনিচ্ছা কখনওই ভবিষ্যতের জন্য ভাল হতে পারে না। এটি এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন ইউক্রেন মারাত্মক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। ইউক্রেনের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধনে ব্যর্থ হওয়ায়, দেশটি এখন পুনরুজ্জীবিত রুশ যুদ্ধশক্তির সম্মুখীন হয়ে চলেছে। রাশিয়া বিপুল হতাহতের সংখ্যাকে গুরুত্ব না দিয়েই ইউক্রেনের উপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।
এখনও পর্যন্ত ইউক্রেনের দু’টি মূল সমর্থক দেশ সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও নিজেদের সমর্থন পরিবর্তন করেছে এবং বিদ্যমান যুদ্ধকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম সরঞ্জাম এবং উপকরণ সরবরাহ করছে। এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আবার দুই পক্ষের সমর্থক দেশের কাছেই ত্রাণের পরিমাণ অপ্রতুল। তবে তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি হল এই যে, আটলান্টিক মহাসাগরের উভয় পাশে এক সময়ে বাড়তে থাকা ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন বর্তমানে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং পুরো পরিস্থিতিই রাজনৈতিক ফুটবলে পর্যবসিত হয়েছে। পিউ রিসার্চ অনুসারে, ৫০ শতাংশ রিপাবলিকান বলছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে খুব বেশি পরিমাণে সহায়তা জোগাচ্ছে। পোল্যান্ড এবং স্লোভাকিয়ায় অবরোধের ফলে ইউক্রেনীয় ট্রাকগুলি নিজেদের দেশে প্রয়োজনীয় সরবরাহ আনতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। অভিযোগ হল যে, ইউক্রেনীয় ট্রাকচালকরাই ত্রাণ নিয়ে আসতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বাস্তবায়নের দাবিতে মার্কিন সেনেটে বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টি ইউক্রেন এবং ইজরায়েল ত্রাণ বিলকে খারিজ করেছে। বিলটিতে ইউক্রেন এবং ইজরায়েলকে ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা প্রদান করার কথা ছিল।
ইউক্রেনে যা ঘটছে, তা বিশ্বের অন্য প্রান্তে তাইওয়ানের উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। চিন বলপূর্বক তাইওয়ানকে সংযুক্ত করতে পারে… এ হেন ঘোষণা আবার ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনে পশ্চিমী জোটের অনিশ্চয়তা পূর্ব এশিয়াতেও প্রতিধ্বনিত হতে পারে এবং তা পরোক্ষ ভাবে চিনকে বলপূর্বক তাইওয়ানকে সংযুক্তিকরণের বিষয়ে উৎসাহ জোগাবে।
জানুয়ারি মাসে তাইওয়ানের স্বশাসিত প্রজাতন্ত্র একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্মুখীন হয়েছে। স্বাধীনতাপন্থী ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টির লাই চিং-তে ওরফে উইলিয়াম লাই নির্বাচনে জয়লাভ করেন। কুওমিংতাং-এর (কেএমটি) হুও ইউ-ইহ পরাজিত হলেও, তাঁর বক্তব্য ছিল যে, তিনি চিনের সঙ্গে আলোচনা ও আপসনীতির পক্ষে।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট লাই – যিনি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের ডেপুটি ছিলেন - তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে এবং চিনকে প্রতিহত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছুক অংশীদার হওয়া সংক্রান্ত নিজের পূর্বসূরির নীতিই অনুসরণ করতে চান। এটি এমন একটি নীতি, যা চিন ও তাইওয়ানের পাশাপাশি চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব উস্কে দিয়েছে।
শি এবং বাইডেনের মধ্যে হওয়া নভেম্বর মাসের বৈঠকে চিনা নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাইওয়ানকে অস্ত্র জোগানো বন্ধ করা এবং ‘চিনের শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলনকে সমর্থন করা’র আহ্বান জানান। তাইওয়ানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও প্রতিরক্ষা চুক্তি না থাকলেও বাইডেন বেশ কয়েকবার বলেছেন যে, তাইওয়ানের উপর হামলা হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে রক্ষা করবে। ইউক্রেনের ভুল পদক্ষেপ তাইওয়ানবাসীকে এ বিষয়ে রাজি করাতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থানের একটি অবিশ্বস্ত গ্যারান্টার এবং চিনের সঙ্গে আপস অন্যতম ভাল বিকল্প।
ইউক্রেনে পশ্চিমী জোটের অনিশ্চয়তা পূর্ব এশিয়াতেও প্রতিধ্বনিত হতে পারে এবং তা পরোক্ষ ভাবে চিনকে বলপূর্বক তাইওয়ানকে সংযুক্তিকরণের বিষয়ে উৎসাহ জোগাবে।
তবে বিশ্বব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন। এখনও পর্যন্ত, এ কথা প্রায় নিশ্চিত যে, ট্রাম্প আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রার্থী হবেন। এটি সম্ভবত এমন পরিস্থিতির দিকে চালিত করতে পারে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই তার প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের দ্বারা নির্ধারিত দিকনির্দেশনা বদলে দিতে পারে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম দিনেই ট্রাম্প ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন এবং তাঁর কার্যকালের মধ্যে তিনি বিশ্বব্যবস্থার আন্তর্জাতিকীকরণ-পন্থী মডেলকে প্রত্যাখ্যান ও অবমূল্যায়ন করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, চিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। ট্রাম্প নিজের মেয়াদের শেষ দিকে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টাও চালিয়েছেন। ট্রাম্পের সব নীতিই খারাপ ছিল না; সেগুলি ইউরোপ ও জাপানকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি করতে রাজি করাতে এবং মার্কিন সামরিক-মানের প্রযুক্তিতে চিনের প্রবেশাধিকার কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ভাল বা খারাপ… যা-ই হোক না কেন, ট্রাম্প বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে এতটাই পরিবর্তন আনেন যে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সেই নীতিগুচ্ছের অনেকগুলিই গ্রহণ করেন ও তার উপর ভিত্তি করে কাজ করেন।
সমস্ত সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক সঙ্কট আসন্ন মার্কিন নির্বাচনী প্রচারে প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্প বাইডেনকে দুর্বল প্রতিপক্ষ বলে অভিযুক্ত করেছেন এবং বলেছেন যে, বাইডেন আফগানিস্তান, ইউক্রেন, গাজা ও তাইওয়ান থেকে শুরু করে সার্বিক ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিদ্যমান সঙ্কটের বিষয়ে ট্রাম্পের নিজস্ব পন্থা বিশৃঙ্খল এবং পরস্পরবিরোধী হতে পারে, যা আমেরিকার পতন ও বৃহৎ শক্তিটির দুর্বল হয়ে পড়া্র আশঙ্কা গভীরতর করছে।
দ্বিতীয় বারের মতো ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্ব বিশ্বের জন্য একাধিক কারণে অর্থবহ হলেও তা নিশ্চিত ভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অবশিষ্ট বিশ্বের জন্য ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের তুলনায় খারাপই হবে। অভ্যন্তরীণ ভাবে ট্রাম্প নিজেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, আগামিদিনে দেশটির ভবিষ্যৎ একনায়কতান্ত্রিকতার পথেই হাঁটতে পারে। ট্রাম্পের ক্ষমতাচ্যুত থাকাকালীন অবস্থাতেই যদি আদালত এবং গণমাধ্যম ট্রাম্পের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম না হয়, তা হলে তিনি পুনরায় প্রেসিডেন্ট হলে পরিস্থিতি কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। বাইডেন প্রশাসনের সময়কালে কিছু অগ্রগতি ঘটে থাকলেও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং সর্বব্যাপী হতাশা সংক্রান্ত জাতীয় অখুশির আবহ স্পষ্ট।
সবচেয়ে খারাপ হতে পারে যদি ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে সরিয়ে নেয় এবং ইউক্রেনকে তার নিজের ভরসায় ছেড়ে দেয় ও তাইওয়ানকে চিনের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনও ভূমিকা না নেয়। বিশ্ব জুড়ে মিত্র এবং বন্ধুদেশগুলি এমন এক বিশ্বের সম্মুখীন হবে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে না। সমস্ত আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক বসানোর ট্রাম্পের পরিকল্পনা বিশ্বের অভ্যস্ত খোলা বাজারের বাণিজ্য ব্যবস্থাকে প্রায় নির্মূল করে দেবে।
যে সব দেশ নিরাপত্তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল, তাদের অবস্থা হবে শোচনীয়। এই পরিস্থিতি জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার উপর পারমাণবিক সীমা অতিক্রম করার জন্য চাপ তৈরি করবে। ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন থাকে, তা রিয়াধের পথনির্দেশ করবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সাফল্য ইউরোপীয় ব্যবস্থাকে সমূলে নাড়িয়ে দিতে পারে। বার্লিন সীমা অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নেয় কি না, তা অবশ্য ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের উপর নির্ভর করবে।
ভারতের জন্য এই পরিস্থিতি সম্ভবত সেই মিত্রদের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ হবে, যারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই পরিস্থিতি অবশ্যই নয়াদিল্লিকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে। কারণ নয়াদিল্লি সতর্কতা ও পরিশ্রমের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এর উপরই ভারতের বৃহত্তর বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা নির্ভর করে।
মনোজ জোশি অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.