Originally Published The New Indian Express Published on Feb 19, 2022 Commentaries 28 Days ago

ইউক্রেন-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অ্যাংলো-আমেরিকান হস্তক্ষেপের প্রধান এবং চিরাচরিত পন্থাটি হল সরকার পরিবর্তনের নীতি।

ইউক্রেনের অচলাবস্থা সংশ্লিষ্ট কোনও পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়

Source Image: Bohan_伯韩 Shen_沈 — Flickr/CC BY-NC-ND 2.0

ইউক্রেনের অচলাবস্থা সংশ্লিষ্ট কোনও পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়

ইউক্রেনের অচলাবস্থা দূরীকরণে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আর এক প্রস্ত অমীমাংসিত আলোচনার মাধ্যমে সাম্প্রতিকতম জেনেভা সম্মেলনটি সমাপ্ত হয়। গত ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন এবং দুই পক্ষের মধ্যে চাপানউতোর কমানোর আশা জাগান। ইতিপূর্বে জুন মাসে দুই শীর্ষ নেতাই মুখোমুখি উপস্থিত হয়ে কথাবার্তা চালিয়েছেন। শীর্ষ সম্মেলনের আগে পারস্পরিক হুমকির বাতাবরণ থাকা সত্ত্বেও উভয় পক্ষের গোয়েন্দাপ্রধানদের মধ্যে ছাড়াও একাধিক স্তরে দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তা হয়েছে এবং সব ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকার নাছোড় মনোভাব দেখিয়েছে।

ইউক্রেন সীমান্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এক লক্ষ কুড়ি হাজার সৈন্য মোতায়েন করলেও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণে রাশিয়া তার আগ্রহের কথা অস্বীকার করেছে। রাশিয়া ইউক্রেন অধিগ্রহণের চেষ্টা চালালে আমেরিকার তরফে আরও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ এবং তাঁর সরকারের পতনের পর থেকেই ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দোনবাস অঞ্চলে বসবাসকারী রাশিয়ান জনগোষ্ঠী সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হওয়ার দরুণ এই অস্থিরতাকে প্ররোচনা দেওয়ার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করা হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে কাজাখস্তানের অশান্ত অবস্থা নিয়ন্ত্রণে এবং সে দেশের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট কাসসিম-জোমার্ট তোকায়েভের সরকারকে রক্ষা করতে রাশিয়ার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

আমেরিকা এবং ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত তার সহযোগী দেশগুলি বরাবরই বলে এসেছে যে গোষ্ঠীটিতে যোগদান করা যে কোনও স্বাধীন দেশের জন্যই এক সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। যদিও এমনটা বলার মাধ্যমে রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত ন্যাটোর প্রসারণ এবং সে কাজে ন্যাটোকে প্ররোচিত করতে তাদের ক্রমাগত প্রচেষ্টার কথা তারা পাশ কাটিয়ে গেছে।

ঠান্ডা লড়াই পরবর্তী যুগে উদ্ভূত নিরাপত্তা-সম্পর্ক ও জোটগুলির কাঠামোর সঙ্গে অঞ্চলটির ভূ-রাজনীতি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। রাশিয়া এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে সে ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদান করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সেই সঙ্গে রাশিয়ার দাবি, ১৯৯৭ সালে, অর্থাৎপূর্বতন ওয়ারশ চুক্তির অধীন পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলি ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আগে ন্যাটোর সেনাবাহিনী যেখানে ছিল, তাদের সেই অবস্থানে ফিরে যেতে হবে। রাশিয়ার দাবির প্রত্যুত্তরে আমেরিকা একটি লিখিত জবাব দিতে সম্মত হয়েছে। আমেরিকা এবং ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত তার সহযোগী দেশগুলি বরাবরই বলে এসেছে যে গোষ্ঠীটিতে যোগদান করা যে কোনও স্বাধীন দেশের জন্যই এক সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। যদিও এমনটা বলার মাধ্যমে রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত ন্যাটোর প্রসারণ এবং সে কাজে ন্যাটোকে প্ররোচিত করতে তাদের ক্রমাগত প্রচেষ্টার কথা তারা পাশ কাটিয়ে গেছে।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার মার্কিন হুমকি রাশিয়াকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি এবং রাশিয়া তার নিরাপত্তার বিষয়টিকে এই সব হুমকির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমেরিকা ইউক্রেনকে আকাশপথে সামরিক সহায়তা পাঠিয়েছে এবং পোল্যান্ড ও অন্য বাল্টিক দেশগুলিতে ন্যাটো সেনা এবং অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি কৃষ্ণ সাগরে নৌ অভিযানের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এ ছাড়াও কিয়েভ থেকে দূতাবাসের কর্মীদের পরিবারগুলিকে দেশে ফিরিয়ে আনা, রাশিয়ায় নিজেদের কূটনৈতিক উপস্থিতি হ্রাস করা এবং দেশের নাগরিকদের রাশিয়া ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার মাধ্যমে আমেরিকা সংঘাতের পথে অগ্রসর হয়েছে।

২০১৪ সালে নাটকীয় ভাবে ক্রিমিয়া দখল করার পর থেকেই রাশিয়া পশ্চিমী দেশগুলির জারি করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে। রাশিয়ার এই বলপূর্বক দখল ইউরোপে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পরিবর্তনের প্রথম ঘটনা যা এক ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের সূচনা করে। এর ফলে রাশিয়া পশ্চিমী দেশগুলির তরফে নিন্দা এবং নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়। রাশিয়া একটি গণভোটের ব্যবস্থা করেছিল যাতে ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ সমর্থিত হয়েছে। রাশিয়ার এ হেন আগ্রাসী কৌশলের নেপথ্যের প্রধান কারণটি হল সেবাস্তোপোলে তার নৌঘাঁটিটি সুরক্ষিত করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়া এই অঞ্চলটি ইউক্রেনের কাছ থেকে লিজ নেয়। রাশিয়ার আশঙ্কা ছিল, এই লিজ নবীকরণ নাও হতে পারে। ভূমধ্যসাগর এবং তার বাইরে রাশিয়ার নৌ অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে সেবাস্তোপোল ঘাঁটিটির গুরুত্ব অপরিসীম।

জার্মান নৌ প্রধান প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমর্থনে মন্তব্য করেছিলেন। ই ইউ-এর অন্তর্গত বেশ কয়েকটি দেশের তরফে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা জোগানোরও বিরোধিতা করেছে জার্মানি।

রাশিয়ার উপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ই ইউ (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) সহমত নয়। ভারত সফরের অব্যবহিত পরেই জার্মান নৌ প্রধানের ইস্তফা জার্মানির অভ্যন্তরে — যা ই ইউ-এর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি — বিভাজনকে স্পষ্ট করে তোলে। জার্মান নৌ প্রধান প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমর্থনে মন্তব্য করেছিলেন। ই ইউ-এর অন্তর্গত বেশ কয়েকটি দেশের তরফে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা জোগানোরও বিরোধিতা করেছে জার্মানি। ইউরোপের দেশগুলি ইউক্রেনের সমর্থনে ন্যাটোর সেনা পাঠানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছে এবং সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখিয়েছে। ইতিমধ্যেই ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের জোগান দিয়েছে এবং কিয়েভে সরকার বদলের প্রচেষ্টার জন্য পুতিনকে দায়ী করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অ্যাংলো-আমেরিকান হস্তক্ষেপের প্রধান এবং চিরাচরিত পন্থাটি হল সরকার পরিবর্তন কর্মসূচি। ইউক্রেনে ইয়ানুকোভিচের রুশপন্থী সরকারকে উৎখাত করার জন্য পশ্চিমী শক্তিগুলি অস্থিরতা সৃষ্টিতে প্ররোচনা জুগিয়েছিল। হাস্যকর ভাবে এই শক্তিগুলি বর্তমানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে সরকার বদলের প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলেছে।

মস্কোর সীমান্ত পর্যন্ত ন্যাটোকে প্রসারিত করে রাশিয়াকে প্ররোচিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ই ইউ এবং ন্যাটোই দায়ী। এমনকি সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মতো ই ইউ সদস্য দেশও ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত নয়। সে ক্ষেত্রে ইউক্রেনকেই বা জোর করা হবে কেন? একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান কৌশলগত বিশেষজ্ঞ ন্যাটোর পূর্বমুখী প্রসারণের বিরোধিতা করেছেন। স্পষ্টতই পুরনো ঠান্ডা লড়াইয়ের যোদ্ধারা এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয়। পুতিনের রাশিয়াকে স্বৈরাচারী রূপে দেখা হয় এবং তাঁর প্রশাসনকে ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় পশ্চিমী স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করা হয়। রাশিয়াকে ই ইউ-এর নতুন কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত না করে পশ্চিমী দেশগুলি তাকে প্ররোচনা দিচ্ছে। তবে রাশিয়ার জি ডি পি স্পেনের সমতুল্য, সে কোনও ভাবেই ইউরোপ বা আমেরিকার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে না।

রাশিয়া ই ইউ দেশগুলিতে তেল এবং গ্যাসের জোগান দেওয়া ব্যতীত অর্থনৈতিক ভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যা ইউরোপের তরফে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর ব্যাপারে গড়িমসিকে ব্যাখ্যা করে।

ঠান্ডা লড়াই পরবর্তী গণতন্ত্র প্রচারের কর্মসূচি এবং একটি উদারপন্থী বিশ্বব্যবস্থা বজায় রাখার প্রচেষ্টা — যা তৎকালীন আমেরিকার বিদেশনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল — মস্কোর উপরে আর এক ধরনের দমন চালায়। এক দিকে পাশ্চাত্য ও অন্য দিকে এক শক্তিশালী এবং বর্ধিষ্ণু চিনের মাঝে রাশিয়া পিষে যেতে থাকে। রাশিয়ার প্রতি এ হেন আচরণ আমেরিকার সর্বজনবিদিত ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অনেক বেশি আগ্রাসী চিনের বিরুদ্ধে তার আচরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। এর কারণটিও স্পষ্ট। এবং তা হল ওয়াল স্ট্রিট এবং আমেরিকান বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির চিনে ব্যাপক বিনিয়োগ। এর বিপরীতে রাশিয়া ই ইউ দেশগুলিতে তেল এবং গ্যাসের জোগান দেওয়া ব্যতীত অর্থনৈতিক ভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যা ইউরোপের তরফে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর ব্যাপারে গড়িমসিকে ব্যাখ্যা করে। আমেরিকা এখনও আফগানিস্তান থেকে তার অপমানজনক সেনা প্রত্যাহারের কথা ভুলতে পারেনি এবং হয়তো সেই কারণেই সে রাশিয়ার সামনে তার আগ্রাসী দিকটি তুলে ধরতে চায়। ন্যাটো প্রত্যাহার করে নেওয়ার রাশিয়ার দাবি মেনে নিলে তা বাইডেনের বিদেশনীতির আর একটি পরাজয় সূচিত করবে এবং ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের অবমূল্যায়ন ঘটাবে।

যদি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়, তা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্যই লোকসানের কারণ হবে। এর প্রভাব পড়বে ভারতের উপরেও, যে হেতু সে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে যার প্রথাগত ভাবে সুসম্পর্ক বিদ্যমান। ফলে ভারতের তরফে কোনও পক্ষকেই সমর্থন করা সম্ভব হবে না। এবং হয়তো সেই কারণেই ভারত সরকারের তরফে এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। এই সংকটের চাপে যদি রাশিয়া চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়, তা ভারতের জন্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে যে হেতু সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের জন্য ভারত রাশিয়ার উপরে নির্ভরশীল। রাশিয়া এবং চিন ইতিমধ্যেই ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের একটি শক্তি সমন্বয়ের অংশীদার। রাশিয়ার মোট রফতানির ৮০% জুড়ে রয়েছে তেল এবং গ্যাস রফতানি। কাজাখস্তান এবং মধ্য এশিয়ার অন্য দেশগুলিতে অস্থিরতা তৈরি হলে তা চিনে গ্যাস সরবরাহকারী পাইপলাইনগুলিকে তছনছ করে দেবে। চিনের সীমান্ত পর্যন্ত ন্যাটোর এগিয়ে আসা বেজিংয়ের জন্য মোটেই স্বস্তির ব্যাপার নয়। পূর্ববর্তী সোভিয়েত রিপাবলিক দেশগুলির মধ্যে মস্কোর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব পুনরায় জাহির করার চেষ্টা এবং ইউরেশিয়ান প্রেক্ষাপটে বর্তমান ভূ-রাজনীতি প্রভাব ফেলবে চিন-রাশিয়া সম্পর্কে। ইউক্রেনে সামরিক সংঘাত শুরু হলে সেটি অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের পথে টলমল পদক্ষেপ গ্রহণকারী বিশ্বের অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে। অতিমারি জর্জরিত বিশ্ব এমনটা কোনও মতেই চাইবে না।


এই প্রতিবেদনটি সর্ব প্রথম দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত হয়।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.