Author : Soumya Bhowmick

Originally Published East Asia Forum Published on Nov 09, 2022 Commentaries 12 Days ago

বি আর আই, ঋণ সঙ্কট, কূটনীতি, অর্থনৈতিক সঙ্কট, জি ডি পি, আই এম এফ, শ্রীলঙ্কা, আলাপ-আলোচনা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ, প্যাসিফিক, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

শ্রীলঙ্কার ঋণ সংক্রান্ত আলোচনার পুনর্বিন্যাস
শ্রীলঙ্কার ঋণ সংক্রান্ত আলোচনার পুনর্বিন্যাস

এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই এম এফ) দ্বারা প্রদত্ত ঋণ প্রায়শই এক ধরনের পূর্বনির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষ, যার বাস্তবায়ন অধিকাংশ দেশের পক্ষেই অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং ঋণদাতা দেশগুলির মধ্যে জটিল বহুপাক্ষিক ঋণ সংক্রান্ত আলোচনার নিরিখে শ্রীলঙ্কাও তার ব্যতিক্রম নয়।

আই এম এফ ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কাকে ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ এই শর্তেই প্রদান করেছিল যে, কলম্বো দেশের বাজেট ঘাটতি জি ডি পি-র প্রায় ৫ শতাংশে কমিয়ে আনবে। কিন্তু দ্বীপরাষ্ট্রটি তার রফতানি অথবা বৃদ্ধি উন্নত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৬ সালে আই এম এফ-এর কাছে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর একটি ঋণের জন্য অনুরোধ জানায়। কিন্তু এই ঋণও কৃষিজ উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহতকারী বৃষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল সাংবিধানিক সঙ্কট-সহ একাধিক অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে অকার্যকর হয়েছে।

মুদ্রাস্ফীতির চাপ, টাকার অস্থিতিশীলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারের দৈন্যের দরুন ২০২২ সালে জুন মাসে বাংলাদেশ আই এম এফ-এর কাছে আনুষ্ঠানিক ভাবে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের অনুরোধ জানায়।

২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে দেশের বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ থেকে ২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে এবং সরকারি রাজস্ব জি ডি পি-র ১৫.১ শতাংশ থেকে ১২.৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদনশীলতা এবং রাজস্ব হ্রাসের তিক্ত সমাপতন সত্ত্বেও ২০২২ সালের প্রাথমিক পর্যায়ে সার্বভৌম ঋণ সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আই এম এফ-এর দ্বারস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার অনীহা তার বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়ার বিকল্পগুলিকেও খর্ব করেছে৷

কোভিড-১৯ অতিমারি সমগ্র দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলটিকে কঠোর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এবং দেশগুলি বিপুল অর্থ সাহায্যের জন্য আই এম এফ-এর দ্বারস্থ হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ছাড়াও আই এম এফ বন্যা কবলিত পাকিস্তানের জন্য ১.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছে। মুদ্রাস্ফীতির চাপ, টাকার অস্থিতিশীলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারের দৈন্যের দরুন ২০২২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ আই এম এফ-এর কাছে আনুষ্ঠানিক ভাবে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের অনুরোধ জানায়।

বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খল এবং আঞ্চলিক অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কার  সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক দুর্দশাকে বিচ্ছিন্ন রূপে দেখা সম্ভব নয়।

২০২২ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে শ্রীলঙ্কা ঘোষণা করেছিল যে, দেশটি প্রায় ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড ও সিন্ডিকেট এবং দ্বিপাক্ষিক ঋণ সমন্বিত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম। এর পর দেশটি দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধ মকুবের প্রত্যাশায় ছিল।

পরবর্তী মাসগুলিতে শ্রীলঙ্কা এক মানবিক বিপর্যয় এবং ব্যাপক গণ-অসন্তোষের সম্মুখীন হয় যা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষ সহ মন্ত্রীদের পদত্যাগের ঘটনাকে উস্কে দেয়। শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আই এম এফ-এর সঙ্গে ২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সংক্রান্ত একটি প্রাথমিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে৷ তবে তার জন্য শ্রীলঙ্কাকে তার বৈদেশিক এবং ব্যক্তিগত ঋণদাতাদের কাছে থাকা সমস্ত ঋণকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে৷

জাপানের অর্থমন্ত্রী শুনিচি সুজুকি ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে কলম্বোর বর্তমান তীব্রতম অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার জন্য ভারত ও চিনের মতো দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতাদের ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিংহের অনুরোধে জাপান ঋণদাতা দেশগুলির সঙ্গে ঋণ পুনর্বিন্যাসের আলোচনায় নেতৃত্ব প্রদান করবে। জাপানের অর্থমন্ত্রী শুনিচি সুজুকি ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে কলম্বোর বর্তমান তীব্রতম অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার জন্য ভারত ও চিনের মতো দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতাদের ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন

ভারত ও চিনের হাতে থাকা শ্রীলঙ্কার ঋণের পুনর্বিন্যাস দ্বীপরাষ্ট্রটিকে আই এম এফ-এর সঙ্গে আলোচনায় নিশ্চিত ভাবে কিছুটা হলেও সুবিধা প্রদান করবে। লক্ষ করার ব্যাপার হল, এটি গত কয়েক বছরের আঞ্চলিক সমীকরণেরও পরিবর্তনশীলতারও প্রতিফলন ঘটায়। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বি আর আই) অংশ হিসেবে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে বাণিজ্য ও পরিকাঠামোগত সংযোগের নিরিখে চিনের কৌশলগত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে শ্রীলঙ্কা। ভারত বি আর আই-তে অংশগ্রহণ না করার কথা ঘোষণা করার দরুন শ্রীলঙ্কার অবস্থান আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

শ্রীলঙ্কাকে ঋণ-ফাঁদ কূটনীতিতে জর্জরিত করার জন্য চিনকে দায়ী করা হয়েছে। বিশেষ করে হাম্বানটোটা বন্দরের ঘটনার পরে, যেখানে ২০১৭ সালে চায়না মার্চেন্টস পোর্ট হোল্ডিংস কোম্পানি বন্দরটিকে ৯৯ বছরের লিজে নেওয়ার জন্য বন্দরের ৮৫ শতাংশ শেয়ারের বিনিময়ে ১.১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে। কিন্তু অতিমারি-পরবর্তী বিশ্বে বি আর আই-এর গতি শ্লথ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীলঙ্কার প্রতি চিনের আগ্রহও কমতে দেখা গিয়েছে।

সাম্প্রতিক অতীতে ভারত ও শ্রীলঙ্কার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন জোয়ার এসেছে, সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন-এর আওতাভুক্ত দেশ দু’টির মধ্যে এখন বৃহত্তম বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মতে, ‘প্রতিবেশ প্রথম’ বা ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভারত ২০২২ সালের প্রথমার্ধে শ্রীলঙ্কার দিকে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অভূতপূর্ব অর্থ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভারত ও চিনের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনার নিরিখে ইতিবাচক ফলাফল অর্জনের জন্য ঋণের পুনর্বিন্যাস আলোচনায় জাপানের নিরপেক্ষ নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উত্তেজনাগুলি লাদাখ এবং সিকিমের সীমান্ত সংঘর্ষ থেকে শুরু করে ‘(ভারতের) আর্থিক নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকারক’ অর্থনৈতিক দুর্নীতির নিরিখে সাম্প্রতিক কালে চিনা সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘটনা এই চাপানউতোরকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাকে এই বাহ্যিক ঋণ পরিকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

ভারত ২০২২ সালে চিনকে অতিক্রম করে শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতা হয়ে উঠেছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ঋণ ত্রাণ আলোচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ঋণ ত্রাণের খরচ সমস্ত ঋণদাতা দেশগুলির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া দরকার, যেখানে ভারত এখন এই প্রক্রিয়ায় একটি বৃহত্তর অংশীদার।

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে শ্রীলঙ্কা একটি নিম্ন উপার্জনকারী দেশ থেকে ক্রমশ নিম্ন-মধ্য উপার্জনকারী দেশ হয়ে উঠলে তার রেয়াতি ঋণ পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এর পরিবর্তে উচ্চ সুদের হার এবং স্বল্প পরিশোধের সময়কালের মতো প্রতিকূল শর্ত-সহ বাণিজ্যিক ঋণ মঞ্জুর করা হয়।

বাণিজ্যিক ঋণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইন্টারন্যাশনাল সভরিন বন্ড দ্বারা চিহ্নিত এবং প্রায়শই অর্থনীতির কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যবহার করা হয়, যা শ্রীলঙ্কার সামষ্টিক অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে বৃদ্ধি করেছে। শ্রীলঙ্কার পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাকে এই বাহ্যিক ঋণ পরিকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

বিশ্ব যখন অতিমারির সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রভাবগুলির সঙ্গে লড়াই করছে, তখন রুশ-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের ফলে উদ্ভূত জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা গ্লোবাল সাউথের সমস্যার তালিকাকে দীর্ঘতর করেছে। এই অস্থিরতা শ্রীলঙ্কার জন্য একটি সতর্ক এবং দ্রুত পুনরুদ্ধারের গুরুত্বকেই তুলে ধরে।


এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় ইস্ট এশিয়া ফোরাম-এ।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.