গণতন্ত্র ইউক্রেন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জে অন্তত চার বার গুরুত্বপূর্ণ ভোট হয়েছে, এবং সেগুলোর সবই হয়েছে হয় মস্কোর সমালোচনা করে বা তার সামরিক পদক্ষেপের নিন্দা করে, অথবা একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়ে। প্রত্যেক বার প্রস্তাবগুলো ভোটে অংশ নেওয়া দেশগুলির মধ্যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে জিতেছে (যদিও কয়েকটি প্রস্তাবে রাশিয়া ভিটো দিয়েছে)। তবে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র কিন্তু সব ক্ষেত্রেই ভোটদানে বিরত ছিল।
অনেক পাঠকের পক্ষে এই ঘটনাটির তাৎপর্য বোঝা সম্ভব হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যার মৈত্রী এখন ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে সেই ভারত, যে নিজেই একটি আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারণবাদী স্বৈরাচারী প্রতিবেশীর তরফে সীমান্তে সংঘর্ষের শিকার, সে ইউক্রেনকে সমর্থন করতে অস্বীকার করেছে, এবং তার বাকি অনেক মিত্রের (পশ্চিমী এবং অ-পশ্চিমী) মতো করে প্রকাশ্যে মস্কোর বিরুদ্ধে যেতে অস্বীকার করেছে।
ভারতীয়দের, এবং পাকা মাথার ভারত–পর্যবেক্ষকদের কাছে, এই অবস্থানটি কিন্তু বিস্ময়কর নয়। নয়াদিল্লি অবশ্যই এই সব ভোটে, এবং সেখানে পক্ষ নেওয়ার দাবির মুখোমুখি হয়ে, খুবই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু তার অবস্থান অটুট রয়েছে: ভারত রাশিয়াকে ত্যাগ করবে না। এর ঐতিহাসিক ও কৌশলগত কারণ রয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন ডিসি-র নীতিনির্ধারকদের জন্য যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই ঘটনা হোয়াইট হাউসের গণতন্ত্র-বনাম-স্বৈরাচারের কাঠামোয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ধরতে চাওয়ার সীমাবদ্ধতাকে চিত্রিত করেছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের ভোটগুলি নতুন দিল্লির ভারসাম্য রক্ষার কঠিন খেলা প্রদর্শন করে৷ প্রথম বার, রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করে নিরাপত্তা পরিষদের ভোটে ভারত ভোটদানে বিরত ছিল, কিন্তু পরে বলেছিল ‘সমসাময়িক বৈশ্বিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধার উপর নির্মিত’, এবং ‘সমস্ত সদস্য দেশগুলিকে এই নীতিগুলিকে সম্মান করতে হবে’। এই মন্তব্যগুলি থেকে স্পষ্ট, ভারত রাশিয়ার কাজকর্ম অনুমোদন করেনি। পরবর্তী ভোটগুলির সময়ও ভারত অনুরূপ পথ অনুসরণ করে: একটিতে নিরাপত্তা পরিষদ আক্রমণের বিষয়টি সাধারণ পরিষদে উল্লেখ করার পক্ষে ভোট দিয়েছে, তারপরে সাধারণ সভার ভোট হয়েছে, এবং তারপর ভোট হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কাউন্সিলে, সেখানে আক্রমণের বিষয়টি নিয়ে একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের আহ্বান জানানো হয়। ভারত সবগুলিতেই ভোটদানে বিরত ছিল, এবং প্রথম দুটি ক্ষেত্রে আবারও সেই ধরনের বিবৃতি জারি করেছিল, যা গভীর ভাবে পড়লে মস্কোর সমালোচনামূলক।
ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তা আমেরিকা-বিরোধিতায় রূপান্তরিত হয়, এবং ভারত আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্জোট আন্দোলনের নেতা হলেও ওয়াশিংটনের চেয়ে মস্কোর বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল।
ভারত ভোটদানে বিরত থাকায় ভারতের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে তার সমস্ত নতুন নিরাপত্তা অংশীদার, এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, যে দেশটি ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একত্রে চিন-বিরোধী ‘কোয়াড’ তৈরি করেছে। ভারত বাদে বাকি কোয়াড অংশীদাররা রাশিয়ার নিন্দা করেছে, এবং মস্কোর পাশাপাশি রুশ সংস্থাগুলির উপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
ভারতের অবশ্য কোনও সময়েই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, এবং অদূর ভবিষ্যতেও তা করার সম্ভাবনাও নেই।
রাশিয়ার প্রতি গভীর কৌশলগত সহানুভূতির কারণ ভারতের উত্তর-ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের মধ্যে নিহিত। এ হল এক শক্তিশালী ও বোধগম্য পশ্চিম–বিরোধী মনোভাব, যা মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পরিণতি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তা আমেরিকা-বিরোধিতায় রূপান্তরিত হয়, এবং ভারত আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্জোট আন্দোলনের নেতা হলেও ওয়াশিংটনের চেয়ে মস্কোর বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল। কয়েক দশক ধরে ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্র জুড়ে রাশিয়া যথেষ্ট সমর্থন উপভোগ করেছে। ভারতীয় জনসাধারণের মনোভাব থেকে বোঝা যাচ্ছে, বেশির ভাগ বিষয়ে যে দেশটির রাজনীতি তীব্র ভাবে বিভক্ত সেখানে ইউক্রেনীয় সঙ্কট নিয়ে বিরল ঐকমত্য রয়েছে। প্রধান সংবাদপত্রগুলির উত্তর–সম্পাদকীয়গুলিতে রুশ আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ইরাকে মার্কিন যুদ্ধের সঙ্গে, এবং ইউক্রেনের সমর্থনে ভারতের মধ্যে খুব কমই প্রতিবাদ হয়েছে। (উল্টোদিকে রুশ কর্তৃপক্ষ কিন্তু হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে রাশিয়ায় এই আক্রমণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোয়।)
ভারতীয়রা ১৯৬০ ও ৭০–এর দশকে তাদের বিদেশ ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে সোভিয়েত সহায়তার কথা মনে রেখেছে। মস্কো নিরাপত্তা পরিষদে একাধিক ভিটো দিয়েছিল, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ভারতকে সমর্থন করার জন্য। এই যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছিল। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেখা হত ভারতের প্রয়োজনের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশ হিসেবে, যার সমর্থনের সঙ্গে কোনও কড়া শর্ত সংযুক্ত ছিল না, তা সে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ হোক বা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সহায়তার আকারেই হোক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ধারণা ছিল ঠিক বিপরীত; ওয়াশিংটনের সহায়তা, যখন তা এসেছিল, তখন তাতে কড়া শর্ত সংযুক্ত ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখা হত অ–নির্ভরযোগ্য হিসেবে, যে তার কথিত মিত্রদেরও পরিত্যাগ করতে পারে।
বাস্তবতা অবশ্য অনেক বেশি জটিল ছিল। ভারতের প্রতি সোভিয়েত সমর্থন ধারাবাহিক বা নিঃশর্ত ছিল না। যেমন ১৯৬২ সালে চিন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময় মস্কো ভারতকে ত্যাগ করেছিল, কারণ কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময় চিনের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। একই ভাবে ৬০–এর দশকের শেষের দিকে তারা নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল, কারণ তারা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৎ মধ্যস্থের ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিল। এমনকি ১৯৭১ সালে সোভিয়েত সমর্থনের কাহিনিও এই সত্যকে উপেক্ষা করে যে মস্কো প্রথমে ভারতকে যুদ্ধে না–যাওয়ার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। একই ভাবে মস্কো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল পারমাণবিক অস্ত্র প্রসার রোধের ক্ষেত্রে, যার লক্ষ্য ছিল ভারত; তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো তারা এ সম্পর্কে খুব বেশি সোচ্চার ছিল না। ইতিহাসের এই বিভিন্নতার দিকে ভারতে খুব কম মনোযোগ দেওয়া হয়।
ভারতের অবস্থান ঐতিহাসিক বন্ধনের চেয়ে অনেক বেশি বস্তুগত অবস্থার উপর নির্ভরশীল: ভারত রাশিয়ার অস্ত্রের উপর গভীর ভাবে নির্ভরশীল। গত এক দশকে নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষা সরবরাহে বৈচিত্র্য আনার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্লেষকেরা হিসেব করেছেন যে দেশের সামরিক সরঞ্জামের ৮৫ শতাংশের উৎস রুশ বা সোভিয়েত। এমনকি এখনও ভারত রাশিয়া থেকে আরও তিনটি কিলো-শ্রেণির সাবমেরিন কিনছে; ভারতের ইতিমধ্যেই নৌবাহিনীতে এই ধরনের নয়টি জাহাজ আছে। সেই সঙ্গে কেনা হচ্ছে ৪০০টি রুশ টি-৯০ মেন ব্যাটল ট্যাঙ্ক, যা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে থাকা ১,০০০টিরও বেশি টি-৯০–র বহরে যোগ দেবে। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় ট্যাঙ্কের ক্ষেত্রে ১০০টির মতো ভারতে নির্মিত অর্জুন ট্যাঙ্ক বাদে বাকি সব পুরোপুরি রুশ। সামরিক সরঞ্জামের জন্য রাশিয়ার উপর এই নির্ভরতার একটি কারণ ভারত কয়েক দশক ধরে পশ্চিমী দেশগুলির সরবরাহ করা অস্ত্রের চেয়ে সস্তা অস্ত্র কিনতে চেয়েছিল। পরিণতিস্বরূপ, এখন নয়াদিল্লির পক্ষে রাশিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বা অবিলম্বে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা কঠিন। ভারতের একদিকের সীমান্তে আছে পাকিস্তান, যার সঙ্গে সে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করেছে; অন্যদিকে আছে চিন, যার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে তার ভূখণ্ডগত বিরোধ চলছে এবং তা সংঘর্ষের চেহারাও নিচ্ছে। কাজেই অদূর ভবিষ্যতেও ভারতের কাছে রাশিয়ার প্রয়োজন অব্যাহত থাকবে তার সরঞ্জামের যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও প্রতিস্থাপনের জন্য।
তারপরেও ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কে অনেক সমস্যা রয়েছে। রাশিয়ার আচরণ, সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে ইউক্রেনে, দেশটিকে ভারতের জন্য অংশীদারের চেয়ে বেশি জাতীয় নিরাপত্তা দায় করে তুলেছে। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, গত এক দশকে মস্কো ও বেজিংয়ের মধ্যে উন্নততর সম্পর্ক, যা অবশ্যই নয়াদিল্লির কাছে উদ্বেগের বিষয়। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার চিনের কাছে উন্নত অস্ত্রের প্ল্যাটফর্ম বিক্রি, যেমন তার সু-৩৫ যুদ্ধবিমান, ভারত ও চিনের মধ্যে সামরিক ভারসাম্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। সাম্প্রতিক ভ্লাদিমির পুতিন-শি জিনপিং শীর্ষ বৈঠকের মধ্যে দিয়ে রাশিয়া ও চিনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত মৈত্রীর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট নতুন দিল্লি ও মস্কোর মধ্যে মোটেই বিপদ–সম্পর্কিত ধারণার মিল নেই। ভবিষ্যতে এই বিষয়টিকে অতিক্রম করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
এই ঘটনাটি ধীরে ধীরে ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নিয়ে আসছে। নয়াদিল্লি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে শুরু করেছে, এবং জাপান-অস্ট্রেলিয়া-ভারত গোষ্ঠী ও ভারত-ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়া ব্লকের মতো ত্রিপক্ষীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি কোয়াডের মতো বেশ কয়েকটি ‘মিনিল্যাটার্যাল্স’-এ যুক্ত হতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে বিষয়টি হল চিনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও তার ওজন চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশগুলিকে একত্র করা।
তা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়াকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে চায় না। ঐতিহাসিক বন্ধন ও অস্ত্রশস্ত্রের জন্য নির্ভরতা ছাড়াও ভারতীয় বিদেশ নীতির একটি মূল নীতি হল কোনও একটি দেশকে আঁকড়ে না–থেকে রাশিয়া সহ সমস্ত বড় শক্তির সঙ্গে ভাল, স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখা। নয়াদিল্লিও মোটেই এমন দেখাতে চাইবে না যে সে পশ্চিমী, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, চাপে তার রাশিয়া নীতির পরিবর্তন করছে। মার্কিন জনপ্রিয় সংস্কৃতির ব্যাপকতা এবং শিক্ষা বা কাজের জন্য পশ্চিমে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের পরিবর্তনের পক্ষে খুব কম জনসমর্থন আছে। সরকার তেমন কিছু করছে বলে মনে হলে বিরোধীরাও নিশ্চিত ভাবে সরকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
সব মিলিয়ে ভারতে বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র-বনাম-স্বৈরাচার কাঠামোর খুব কম গ্রাহক আছে। নয়াদিল্লির রাশিয়া নীতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হবে, তবে মার্কিন বা পশ্চিমী চাপের কারণে নয়; বরং উভয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত অসঙ্গতির ফলে এটি পরিবর্তিত হবে। কারণ রাশিয়া ক্রমেই আরও বেশি করে চিনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, এবং সেই কারণেই রুশ অস্ত্রের উপর ভারতের বিপুল নির্ভরতা ও রাশিয়ার আচরণ তাকে কতটা দুর্বল করে দিচ্ছে তা নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.