ভারতে বৃদ্ধি এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যয়ে উৎসাহ
ভারতীয় অর্থনীতি আবারও এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় তরঙ্গ দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে, এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানকেও প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। পরিসংখ্যান থেকে এখন বোঝা যাচ্ছে যে এই ধরনের বৈষম্য অর্থনীতির মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করছে।
বৃদ্ধির হার ২০২০-২১ সালে -৭.৩ শতাংশ হওয়ার পর অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের লক্ষণ দেখা গেল যখন ২০২১-২২ এর প্রথম দুই ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার হল ২০.১ শতাংশ ও ৮.৪ শতাংশ। যদিও এই পুনরুজ্জীবনের একটা বড় কারণ হল অর্থনীতির লকডাউনের ফলে তৈরি হওয়া জিডিপি–র নিম্নতর ভিত্তি। এখানে মনে রাখার, বৃদ্ধির চালিকাশক্তিগুলি কিন্তু ছিল মূলত শিল্পের পুনরুজ্জীবন, যার মধ্যে মাইনিং ও মেটালিক মিনারেলের বৃদ্ধির হার ছিল দু’সংখ্যার।
অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর থেকে গত তিন দশক ধরে ভারতীয় বৃদ্ধির আখ্যান ছিল মূলত উপভোগ-চালিত। সরবরাহ-সীমাবদ্ধ অর্থনীতি থেকে চাহিদা-সীমাবদ্ধ অর্থনীতিতে এই রূপান্তর এক নতুন ভারতীয় অর্থনীতির উত্থানের পরিচায়ক।
২০২০ সালের দেশব্যাপী লকডাউন, একদিকে যেমন কার্যত বাজারের ক্ষমতাকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, আন্যদিকে এর ফলে তা পরিযায়ী শ্রমিক, অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ, এবং দরিদ্রদের যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এ থেকে বোঝা যায় ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক নিরাপত্তার অনুপস্থিতিতে বাজারের শক্তিই সামাজিক ক্ষেত্রে সামাল দিয়ে থাকে। এই পরিস্থিতি কিন্তু স্পষ্টতই নীতিগত ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ইঙ্গিতবাহী। আর বিশেষ ভাবে যা স্পষ্ট ছিল তা হল বণ্টন ও ন্যায্যতার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা।
অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর থেকে গত তিন দশক ধরে ভারতীয় বৃদ্ধির আখ্যান ছিল মূলত উপভোগ-চালিত। সরবরাহ-সীমাবদ্ধ অর্থনীতি থেকে চাহিদা-সীমাবদ্ধ অর্থনীতিতে এই রূপান্তর এক নতুন ভারতীয় অর্থনীতির উত্থানের পরিচায়ক। জিডিপি ও তার উপাদানগুলির—অর্থাৎ গত তিন অর্থবর্ষে ব্যক্তিগত চূড়ান্ত উপভোগ ব্যয় ও মোট স্থায়ী মূলধন গঠনের—বৃদ্ধির হারের তুলনা করলে একটি ব্যবস্থাগত নিম্নগামিতার প্রবণতা স্পষ্ট হয়৷
এমনকি সরকার গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি আর্থিক উদ্দীপক প্যাকেজ ঘোষণা করলেও প্রকৃত অর্থে সরকারি চূড়ান্ত উপভোগ ব্যয়ের বৃদ্ধির হারে বাস্তবিক পতন ঘটেছে, এবং তা ২০১৯-২০–র ৭.৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২০–২১ সালে হয়েছে ২.৯ শতাংশ।
২০২১-২২ সালের প্রথম দুই ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি ছিল ব্যক্তিগত উপভোগ, যা জিডিপি–র ৫৫ শতাংশের বেশি। একই ভাবে ২০২০-২১ সালে নেতিবাচক বৃদ্ধির হারের সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্যক্তিগত চূড়ান্ত উপভোগের হ্রাস। ২০২০-২১ সালের প্রথম দুই ত্রৈমাসিকে ব্যক্তিগত খরচের ক্ষেত্রে যথাক্রমে -২৪.৭ শতাংশ ও -৮.২৪ শতাংশ পরিবর্তন হয়েছিল, আর ২০২১-২২ এর প্রথম দুই ত্রৈমাসিকে উপভোগ বেড়েছে যথাক্রমে ২৯.২ শতাংশ ও ১৬.৯ শতাংশ ৷ এমনকি সরকারি উপভোগ ব্যয় ও মোট স্থায়ী মূলধন গঠন ২০২১-২২ সালে প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে জিডিপিতে এর আনুপাতিক অবদান কম।
ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এর কেন্দ্রীয় বাজেট প্রত্যক্ষ কর হ্রাস করে ভোগের চাহিদাকে উৎসাহ না–দিয়ে সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যাগুলি দূর করতে কতগুলি ছোট ও মাঝারি আকারের প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল।
এ থেকে একটি ঘটনার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতীয় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নেওয়া প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলির উদ্দেশ্য এযাবৎ ছিল সরবরাহ বাড়াতে হস্তক্ষেপ; তার পরিবর্তে এবার দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ চাহিদার উপর—বিশেষ করে ব্যক্তিগত উপভোগ চাহিদার উপাদানগুলির দিকে। ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এর কেন্দ্রীয় বাজেট প্রত্যক্ষ কর হ্রাস করে ভোগের চাহিদাকে উৎসাহ না দিয়ে সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যাগুলি দূর করতে কতগুলি ছোট ও মাঝারি আকারের প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। এখনকার উপভোগ–চালিত বৃদ্ধি, যা মূলত দেশীয় অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে চালিত করবে, তাকে দেখা যেতে পারে ‘সুপ্ত চাহিদা’ হিসেবে, যা ২০২০ সালের অতিমারি-চালিত লকডাউনের সময় দেখা যায় নি।
ভারতীয় অর্থনীতির উপভোগের ভিত্তিকে সমর্থন জোগানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য আছে। ভারতে আয়ের বৈষম্য বছরের পর বছর ধরে বেড়েছে, এবং অতিমারির সময় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফলে অ–রক্ষিত গোষ্ঠীগুলি ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে। অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলি অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীগুলির উপভোগের প্রবণতা বেশি হয়, আর উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীগুলির সঞ্চয় করার বা সম্পদ তৈরি করার জন্য টাকা সরিয়ে রাখার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এর অর্থ উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীগুলির আয় বৃদ্ধির তুলনায় নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীগুলির আয় বৃদ্ধিতে অর্থনীতিতে উপভোগের বিভিন্ন পথ বেশি করে খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এর অর্থ ভারতে ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য কিন্তু সম্পদ বৈষম্যকেও দ্রুত বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ওয়র্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডেটাবেস–এর তথ্য অনুসারে ভারতের শীর্ষ ১ শতাংশের সম্পদ যেখানে ১৯৯১ সালে ছিল ১৬.১ শতাংশ, সেখানে ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩১.৭ শতাংশ৷ অন্যদিকে, নীচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের অনুপাত ১৯৯১ সালের ৮.৮ শতাংশ থেকে কমে ২০২০ সালে হয়েছে ৬ শতাংশ।
ওয়র্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেস–এর তথ্য অনুসারে ভারতের শীর্ষ ১ শতাংশের সম্পদ যেখানে ১৯৯১ সালে ছিল ১৬.১ শতাংশ, সেখানে ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩১.৭ শতাংশ ৷
আয় এবং সম্পদের বৈষম্যের বিভিন্নতা অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, এবং পুনরুদ্ধারের সময়ে বৃদ্ধির সম্ভাবনার সরাসরি ক্ষতি করবে। এটি শুধু জনসংখ্যার একটি বড় অংশের দক্ষতা বৃদ্ধির পথে বাধাই তৈরি করে না, সম্পদের অনুপলব্ধতার কারণে শ্রমশক্তিকে নিম্ন উৎপাদনশীলতা ও ‘নিম্ন আয়ের পেশার’ গন্ডিতে বেঁধে রাখে।
অর্থনীতিতে বৃদ্ধি যদি মূলত উপভোগ-চালিত হয়, তবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের গোষ্ঠীর হাতে উপার্জনের টাকা পৌঁছনো গুরুত্বপূর্ণ। নিম্ন ও মধ্য আয়ের গোষ্ঠীর হাতে পৌঁছনো এই অতিরিক্ত অর্থ চলে যাবে উপভোগের পথে, এবং পরিণামে তা উপভোগ-চালিত বৃদ্ধির পথ খুলে দেবে। ভারতের নীতিগত প্রতিক্রিয়া হতে হবে ‘কেইনসিয়ান’: সামাজিক লক্ষ্যগুলি অর্জনের জন্য সম্পদের জোগান দিতে বৃহত্তর সম্পদ কর। এর পরিপূরক হিসেবে প্রয়োজন নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে মদত জোগানোর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.