২০২৩ সালটি ছিল ভারতের বিদেশনীতির জন্য একটি ভাল বছর। দেশটি গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসাবে নিজের অবস্থান সশক্ত করতে তার জি২০ সভাপতিত্ব ব্যবহার করেছে। জি২০-তে আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করা ছিল ভারতের সভাপতিত্বের বৈশিষ্ট্য। এত দিন পর্যন্ত জি২০-র মতো মঞ্চটিতে ঐতিহ্যগত ভাবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলিরই আধিপত্য ছিল। এ বার উচ্চ আসনে এইউ-এর অন্তর্ভুক্তির অর্থ হল এই যে, এত দিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহে প্রান্তিক থাকা আফ্রিকা মহাদেশটি এ বার আন্তর্জাতিক বিষয়ে অবদান রাখতে এবং তাকে আকার দিতে সক্ষম হবে। জি২০ নেতাদের ফোন কলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মোদীর অত্যন্ত প্রশংসিত ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ প্রত্যাশিত ছিল। কারণ তিনি মহাদেশটিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
এ বার উচ্চ আসনে এইউ-এর অন্তর্ভুক্তির অর্থ হল এই যে, এত দিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহে প্রান্তিক থাকা আফ্রিকা মহাদেশটি এ বার আন্তর্জাতিক বিষয়ে অবদান রাখতে এবং তাকে আকার দিতে সক্ষম হবে।
ভারত ও আফ্রিকার অভিন্ন সাধারণ মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি সময়োচিত অংশীদারিত্ব রয়েছে এবং আফ্রিকার মধ্যে ভারতের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। আফ্রিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ২০১১-১২ সালে ৬৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ সালে ৯০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পরিণত হয়েছে এবং ভারতীয় বিনিয়োগকারীরাও আফ্রিকাতে নিজেদের উপস্থিতি প্রসারিত করেছেন। ১৯৯৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৭৩.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমন্বিত বিনিয়োগের সঙ্গে ভারত বর্তমানে আফ্রিকার শীর্ষ পাঁচটি বিনিয়োগকারীর অন্যতম হয়ে উঠেছে। ভারত ও আফ্রিকা একসঙ্গে আন্তর্জাতিক মঞ্চে, বিশেষ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর অবদান রেখেছে। এগ্রিকালচারাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রোপোজালের মতো যৌথ প্রস্তাবের পাশাপাশি সম্প্রতি ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ডব্লিউটিও-তে কোভিড-১৯ টিকার জন্য একটি বুদ্ধিবৃত্তিগত সম্পত্তি অধিকার মকুবের প্রস্তাব করেছে।
যাই হোক, ২০০৮ (নয়াদিল্লি), ২০১১ (আদ্দিস আবাবা) এবং ২০১৫-য় (নয়াদিল্লি) পরপর তিনটি শীর্ষ সম্মেলনের পর চতুর্থ ভারত-আফ্রিকা ফোরাম শীর্ষ সম্মেলনের মাঝে নয় বছরের ব্যবধানের এক অযৌক্তিক বিলম্ব অংশীদারিত্বের জন্য ভাল নয়। অতিমারি এই বিলম্বের নেপথ্যে অন্যতম কারণ হলেও এইউ অতিমারি পরবর্তী বছরগুলিতে অন্যান্য অংশীদারের সঙ্গে বেশ কয়েকটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফোরাম অন চায়না-আফ্রিকা কোঅপারেশন (২০২১), ইউএস-আফ্রিকা লিডারস সামিট (২০২২), ইইউ-এইউ সামিট (২০২২), টোকিও ইন্টারন্যাশনাল সামিট অন আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট (২০২২) এবং রাশিয়া-আফ্রিকা সামিট (২০২৩)। তৃতীয় ভারত-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনের পর – যেটিতে আফ্রিকার ৫৪টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল – এখন এইউ-এর ভারত-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করার পালা। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারত-আফ্রিকা ফোরাম শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের জন্য ভারতের উচিত এইউ-এর সঙ্গে সক্রিয় ভাবে সম্পৃক্ত হওয়া।
তদুপরি, চতুর্থ ভারত-আফ্রিকা ফোরাম শীর্ষ সম্মেলনটি জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে অর্জনের উপর ভিত্তি করে আয়োজন করা উচিত এবং ভবিষ্যতের জন্য আলোচ্যসূচির উল্লেখ করা জরুরি। সর্বোপরি, গত ভারত-আফ্রিকা ফোরাম শীর্ষ সম্মেলনের পর থেকে অনেক কিছু বদলে গেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল আফ্রিকা মহাদেশের ভাগ্যের পরিবর্তন। নতুন সহস্রাব্দে একটি প্রতিশ্রুতিশীল সূচনার পরে মহাদেশ জুড়ে বৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে।
সাম্প্রতিক ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন বা খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অনুমান অনুসারে, ২০২২ সালে আফ্রিকার জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ (প্রায় ২৮২ মিলিয়ন মানুষ) অপুষ্টিতে ভুগছিলেন, যা অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৫৭ মিলিয়ন মানুষের সংখ্যার বৃদ্ধিকেই দর্শায়।
কোভিড-১৯ অতিমারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া দ্বন্দ্বের জোড়া ধাক্কা আফ্রিকার অর্থনীতিকে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং মহাদেশের বেশির ভাগ অংশই বর্তমানে ঋণের জ্বালা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি গবেষণা অনুসারে, ডিএসএফ (ডেট সাসটেনেবিলিটি ফ্রেমওয়ার্ক) রেটিং-সহ ৩৫টি সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশের অর্ধেকেরও বেশি ঋণ সঙ্কটের উচ্চ ঝুঁকির মুখে পড়বে বা ইতিমধ্যেই ঋণ সঙ্কটে জর্জরিত; আফ্রিকার জিডিপি অনুপাতের নিরিখে ঋণ ২০১৩ সালের ৩০ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ৬০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং রাজস্ব ও সুদ প্রদানের অনুপাত ঋণ পরিষেবা ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকও ২০১০-এর প্রথম দিকে প্রায় ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ১১ শতাংশ হয়েছে। সাম্প্রতিক ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন বা খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অনুমান অনুসারে, ২০২২ সালে আফ্রিকার জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ (প্রায় ২৮২ মিলিয়ন মানুষ) অপুষ্টিতে ভুগছিলেন, যা অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৫৭ মিলিয়ন মানুষের সংখ্যার বৃদ্ধিকেই দর্শায়। তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঘটনা ২০১৯ সালের ৬১ মিলিয়ন থেকে ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩ সালে ১৪৯ মিলিয়ন হয়েছে। দ্বন্দ্ব খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার প্রধান চালক। কারণ সংঘাত-প্রবণ দেশগুলিতে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছেন। সর্বোপরি, সংঘাতের কারণে ৪০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা ২০১৬ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
মহাদেশটি ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মালি, চাদ, গিনি, সুদান, বুরকিনা ফাসো, গ্যাবন এবং নাইজারের মতো সাতটি দেশে ৯টি সামরিক দখলের সাক্ষী থাকার পাশাপাশি অভ্যুত্থানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে (দ্রষ্টব্য চিত্র ১)।
চিত্র ১: আফ্রিকায় ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সফল অভ্যুত্থানের সংখ্যা
সূত্র: https://projects.voanews.com/african-coups/
বর্তমান পরিস্থিতি ভারত-আফ্রিকা সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের আহ্বান জানিয়েছে। সংহতির মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও উগান্ডায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর ১০টি নির্দেশক নীতি ভারত-আফ্রিকা সম্পর্ককে নির্দেশনা দিলেও সেখানে সমসাময়িক চাহিদা, প্রধানত খাদ্য নিরাপত্তা এবং ঋণ স্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগ দেওয়ার আশু প্রয়োজন রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা ভারত-আফ্রিকা অংশীদারিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এবং বিগত তিনটি ভারত-আফ্রিকা ফোরাম শীর্ষ সম্মেলনে তা বিশেষ ভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। যাই হোক, আফ্রিকার বর্তমান দুর্বলতা ও খাদ্য আমদানির উপর তার তীব্র নির্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য নিরাপত্তাই হয়ে উঠেছে মহাদেশের প্রধান উদ্বেগ। যেমন, আফ্রিকার খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি রূপান্তর আগামী বছরগুলিতে ভারত-আফ্রিকা সম্পৃক্ততার শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলির মধ্যে অন্যতম হওয়া উচিত। এ ছাড়াও, ওআরএফ বিশেষজ্ঞ সৌম্য ভৌমিক এবং নীলাঞ্জন ঘোষ যেমনটা উল্লেখ করেছেন, আফ্রিকার দেশগুলি বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত পক্ষপাতের কারণে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উচ্চতর ঋণ গ্রহণের ব্যয়ভারের সম্মুখীন হয়। অতএব, আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার এবং আফ্রিকার ঋণের বোঝা মোকাবিলা করা সেই প্রধান লক্ষ্য, যে প্রেক্ষিতে ভারত ও আফ্রিকা উভয়েরই কাজ করা উচিত। ভারত ও আফ্রিকার উচিত ভবিষ্যতের জন্য একটি কর্মসূচি তৈরি করতে ভারত-আফ্রিকা ফোরাম সামিটের মঞ্চটিকে ব্যবহার করা। ২০২৪ সালটি ভারতের জন্য নির্বাচনী বছর হওয়ার দরুন এমনিতেই সময় কম পড়বে। কিন্তু কেউ কি আদৌ শুনছেন?
মালঞ্চ চক্রবর্তী অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর (রিসার্চ) এবং সিনিয়র ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.