আব্রাহামের সমাধির পবিত্র স্থান হেব্রন – যা কিনা ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে পিতৃপুরুষদের গুহা বা মুসলমানদের কাছে আল খলিল নামেও পরিচিত – সমস্ত আব্রাহামিক ধর্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভাবে তাত্পর্যপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র হওয়ার দরুন প্যালেস্তাইনের সম্প্রদায়গুলি হেব্রনের পুরনো শহরটিকে উচ্চ আসনে বসিয়েছে।
এই তাত্পর্য অনিবার্য উত্তেজনা আকর্ষণ করে, যখন হেব্রনকে ক্রমবর্ধমান অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত করা হয় এবং পরবর্তী কালে ইজরায়েলি রাষ্ট্রের তরফে পুলিশের টহলদারি ও নজরদারি বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৭ সালে নির্মিত হেব্রনের ইতজিয়ন ব্লকটি পশ্চিম তীরের প্রথম অবৈধ বসতিগুলির অন্যতম। দুই সম্প্রদায়ের নৈকট্য, মতাদর্শগত এবং ধর্মীয় ঝোঁকের বিপরীতে প্রায়শই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং হিংসা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এ হেন আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ১৯৯৪ সালের ইব্রাহিমি মসজিদ গণহত্যা, যখন মার্কিন-ইজরায়েলি বসতি স্থাপনকারী বারুচ গোল্ডস্টেইন পবিত্র রমজান মাসে হারাম আল-ইব্রাহিমি মসজিদে প্রার্থনারত ২৯ জন প্যালেস্তাইনিকে গণহত্যা করেছিলেন। বেশির ভাগ ইজরায়েলি নাগরিক গণহত্যার নিন্দা করলেও গোল্ডস্টেইনকে কিছু ইজরায়েলি বসতি স্থাপনকারী, বিশেষ করে হেব্রনের নায়ক হিসেবে মনে করেন। গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্যালেস্তাইনিদের মধ্যে বিক্ষোভ ও দাঙ্গা শুরু হয়। ইজরায়েলি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তরফে আরও হিংসাত্মক প্রতিশোধ নেওয়ার ফলে ১১ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয় এবং বলপূর্বক প্যালেস্তাইনিদের দোকান ও ঘরবাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইব্রাহিমি মসজিদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পাশাপাশি শহরের একগুচ্ছ পবিত্র স্থানে বসতি স্থাপনকারী ও ইহুদি দর্শনার্থীদের জন্য একক প্রবেশাধিকারের নিয়ম চালু করা হয়। এই ঘটনাটি শহরে ইজরায়েলি সামরিক উপস্থিতিকে শক্তিশালী করেছে এবং নজরদারি কর্মসূচির সম্প্রসারণের সুযোগ উন্মুক্ত করেছে। রাষ্ট্র এ হেন অনুশীলন ও অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে।
দুই সম্প্রদায়ের নৈকট্য, মতাদর্শগত এবং ধর্মীয় ঝোঁকের বিপরীতে প্রায়শই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং হিংসা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ‘একটি সংঘর্ষহীন অধিগ্রহণ’ সুনিশ্চিতকারী নজরদারির শৃঙ্খল তৈরি করতে ইজরায়েলি রাষ্ট্রের সাফল্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক বা পশ্চিম তীরের এলাকায়, বিশেষ করে হেব্রনে নিযুক্ত গণ নজরদারি প্রযুক্তির উত্থানকে শুধু মাত্র অরওয়েলীয় কল্পনার ঊর্ধ্বে উঠে অত্যন্ত আক্রমণাত্মক বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। হেব্রন দু’টি অঞ্চলে বিভক্ত, একদিকে ইজরায়েলি সামরিক-সুরক্ষিত অবৈধ বসতি রয়েছে, যা এইচটু নামে পরিচিত এবং অন্য দিকে রয়েছে প্যালেস্তাইনি কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এইচওয়ান। ঐতিহাসিক শহর হেব্রনের ইজরায়েল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এইচটু অঞ্চলে বসবাসকারী ৩৩৭৫০ প্যালেস্তাইনি নাগরিকদের উপর সর্বক্ষণ নজরদারি চালানো হচ্ছে। অঞ্চলটিতে
নানাবিধ চেকপয়েন্ট রয়েছে, যা ৮০০ ইজরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের তথাকথিত সুরক্ষার জন্য চলাচলের স্বাধীনতাকে মারাত্মক ভাবে বাধা দেয়।
বিশেষ করে হেব্রনে নজরদারি শৃঙ্খল তিনটি উপাদান নিয়ে গঠিত। যথা রেড উলফ সফটওয়্যার; ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ব্লু উলফ অ্যাপ; এবং অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের জন্য হোয়াইট উলফ অ্যাপ। রেড উলফ সফটওয়্যারটি সমগ্র ব্যবস্থাটির মূল ভিত্তি, যেটি নাম, বয়স, বৈবাহিক অবস্থা, পারিবারিক তথ্য, চিকিৎসার ইতিহাস, পূর্বে গ্রেফতারি বা আটক ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত সেই সব প্যালেস্তাইনি বেসামরিক নাগরিকের একটি সম্পূর্ণ প্রোফাইল নির্মাণ করে, যাঁরা হেব্রন অঞ্চলের ২১টি চেকপয়েন্টের যে কোনও একটির মধ্য দিয়ে যাতায়াত করেন। ব্লু উলফ অ্যাপটি হেব্রনে বসবাসকারী প্যালেস্তাইনি নাগরিকদের উপরোক্ত তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করে এবং এটি ইজরায়েলি নজরদারি প্রযুক্তির একটি স্বল্প পরিচিত অংশ। তথ্যভাণ্ডারটিতে বেসামরিক নাগরিকদের অতীতের গ্রেফতারি বা ভিন্ন মত পোষণ অথবা তাঁদের আনুমানিক ‘হুমকির উপাদান’-এর তীব্রতার নিরিখে লাল, হলুদ ও সবুজ… এই তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা হয়। যখন মানুষ চেকপয়েন্টগুলি অতিক্রম করেন, তখন সেনাবাহিনীকে অতিক্রমকারী মানুষদের ব্যক্তিগত স্তর সম্পর্কে অবহিত করা হয়, যার ফলে প্রায়শই তাঁদের অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটক করা হয়। হোয়াইট উলফ অ্যাপটি আবার এইচটু-তে বসবাসকারী বসতি স্থাপনকারীদের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা তাঁদেরকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা সংগৃহীত একই তথ্যভাণ্ডার ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। এ ভাবে প্যালেস্তাইনি বেসামরিক নাগরিক সেই সব যাচাই-বাছাই পদ্ধতির আওতায় আসেন, যা ইতিমধ্যেই দুর্বল ভাবে নিয়ন্ত্রিত মূল ব্যবস্থা থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থান করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই অনুশীলনকে ‘স্বয়ংক্রিয় বর্ণবাদ’ বলে অভিহিত করলেও ইজরায়েলি রাষ্ট্র দাবি করেছে যে, এটি হেব্রনকে একটি ‘স্মার্ট সিটি’ তৈরির উদ্যোগের অংশ। হেব্রনে ইজরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপন প্রকল্পকে রক্ষা করার জন্য চেকপয়েন্টের নির্বিচার ব্যবহার এবং বেসামরিক নাগরিকদের পর্যবেক্ষণ অনুশীলন করা হয়। ইজরায়েলি সেনাবাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত থাকাকালীন প্যালেস্তাইনি বেসামরিকদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার পরে ইজরায়েলের প্রত্যাবর্তনের অধিকার নীতির অধীনে অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি ইজরায়েলি বসতি স্থাপনকারী পশ্চিম তীরে নিজেদের বসতি স্থাপন করেছেন।
যখন মানুষ চেকপয়েন্টগুলি অতিক্রম করেন, তখন সেনাবাহিনীকে অতিক্রমকারী মানুষদের ব্যক্তিগত স্তর সম্পর্কে অবহিত করা হয়, যার ফলে প্রায়শই তাঁদের অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটক করা হয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং অসংখ্য নাগরিক ও মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি ইজরায়েলিদের একটি বিশেষ অংশ এ হেন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে, যা আগুনে ঘৃতাহুতি প্রদানের কাজ করেছে। পশ্চিম তীর, বিশেষ করে হেব্রনের উচ্চ পুলিশি নজরদারি এলাকা ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা শিল্পকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তার অত্যাধুনিক ও আক্রমণাত্মক প্রযুক্তি রফতানির জন্য তাদের নিজেদেরই জমিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরীক্ষার পরিসর সরবরাহ করে। উলফ প্যাকের মতো নজরদারি প্রযুক্তির পাশাপাশি চেকপয়েন্টগুলি রিমোট-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, যা স্টান গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা সংস্থা স্মার্ট শুটার দ্বারা নির্মিত এই ব্যবস্থাটিকে উচ্চ বেসামরিক জনসংখ্যাসম্পন্ন চেকপয়েন্টগুলিতে নিযুক্ত করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণের এই ধরনের পদ্ধতির নিন্দা করেছেন। কারণ এটি ভূমিতে প্রকৃত যোদ্ধা বা সামরিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করার নিরিখে সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতি সাধনের প্রবণতাকে চিত্রিত করে।
বছরের পর বছর ধরে ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা বর্তমান প্রশাসনের প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। এমনকি ইজরায়েলের রাষ্ট্রযন্ত্র পশ্চিম তীর এবং গাজায় প্যালেস্তাইনি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে। ইজরায়েলি রাষ্ট্রের প্রতি হতাশার একটি প্রধান কারণ হল শক্তি প্রয়োগের কৌশল ও পশ্চিম তীরে প্যালেস্তাইনি বেসামরিক নাগরিকদের আক্রমণাত্মক বাস্তুচ্যুতির স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা। এ হেন অসম্মতিটি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অনুমোদনের রেটিংয়েও প্রতিফলিত হয়, যা ইজরায়েলে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবাদী হামলার পর তলানিতে এসে ঠেকেছে।
ইজরায়েলি রাষ্ট্রের প্রতি হতাশার একটি প্রধান কারণ হল শক্তি প্রয়োগের কৌশল ও পশ্চিম তীরে প্যালেস্তাইনি বেসামরিক নাগরিকদের আক্রমণাত্মক বাস্তুচ্যুতির স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা।
যখন উত্তেজনার পারদ আকাশ ছুঁয়েছে, এই আক্রমণটি অত্যন্ত পরিশীলিত ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য একটি বাস্তবতার পরীক্ষা হয়ে উঠেছে। তাদের উচ্চতর নজরদারি ও মনিটরিং যন্ত্রপাতি যুদ্ধের সূচনাকারী ধ্বংসাত্মক আক্রমণের পূর্বাভাস না হলেও হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। এ হেন আক্রমণগুলি রাষ্ট্রটির অগ্রাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিম তীরে তাদের গৃহীত কর্মসূচি দ্বারা প্রভাবিত কি না… তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পরিস্থিতির অভিমুখ বদলে দিতে ইজরায়েলি রাষ্ট্র তার অস্ত্রাগারে থাকা সমস্ত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাজার উপর আক্রমণাত্মক হামলা চালানো শুরু করেছে। তবে ভূমির বাস্তবতা অপরিবর্তিতই রয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নেতানিয়াহু প্রশাসনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং জবাবদিহি চেয়েছে। এই বিপর্যয় অনেকের বিবেককে নাড়া দিয়েছে এবং তা পশ্চিম এশিয়ায় গতিশীলতাকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে অথবা তা আরও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
দেবিকা অজিত পানিকর অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের রিসার্চ ইন্টার্ন।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.