যাওয়ার আর কোনও জায়গা নেই: আফগানদের দুরবস্থা
সিরিয়ান এবং ভেনিজুয়েলানদের ঠিক পরেই আফগানরা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শরণার্থী গোষ্ঠী হিসেবে উঠে এসেছেন। বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ২৬ লক্ষ নিবন্ধিত আফগান শরণার্থী রয়েছেন, যার মধ্যে ২২ লক্ষ জন শুধু মাত্র ইরান এবং পাকিস্তানেই বসবাস করেন। আফগানিস্তান তার ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার সময়ের মুখোমুখি হয়েছে।
তালিবান প্রশাসকরা এখনও পর্যন্ত আফগানিস্তানের পুনর্নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রশাসন চালানো কঠিন হয়ে উঠেছে। কন্যাশিশু এবং নারীদের শিক্ষা ও কাজের অধিকার প্রদানের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের অক্ষমতা এবং জনগণের চলাফেরার উপরে বিধিনিষেধ আরোপ করার চেষ্টা এক নতুন আফগান শরণার্থী সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। আফগানিস্তানে বিদ্যমান ভয়ঙ্কর খরার সঙ্গে এই শরণার্থী সমস্যা মানবিক সঙ্কটকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে বিশেষত প্রতিবেশী দেশগুলিতে পালাতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইরান সীমান্তের কাছে তালিবানদের একটি রাস্তা তৈরি করা নিয়ে মতানৈক্যের কারণে বিরোধের সূচনা হয় এবং এর ফল স্বরূপ সাময়িক ভাবে সীমান্তের পথ বন্ধ করা হয় এবং একটি ইরানি সামরিক যান আটক করা হয়।
ইরানি ও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তালিবানের সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষ শরণার্থী আফগানদের সমস্যা বাড়িয়ে তুলেছে। উভয় প্রতিবেশী দেশই বিশাল সংখ্যক শরণার্থীর অন্তঃপ্রবাহ এবং একই সঙ্গে চরমপন্থার অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছে। নতুন আফগান প্রশাসকরা তাঁদের উদ্বেগগুলির সমাধান করতে অক্ষম। ফলে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইরানের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা তীব্রতর হওয়া
তেহরান তালিবানের আফগানিস্তান দখলের বাস্তবতাকে দ্রুত মেনে নেয় এবং আফগানিস্তানের নতুন প্রশাসকদের প্রতি বরং একটি বাস্তববাদী পন্থা গ্রহণ করে। সীমান্তে সাম্প্রতিক সংঘর্ষগুলি কিন্তু ইরান এবং তালিবানদের মধ্যে শত্রুতা নতুন করে উস্কে দিয়েছে। ইরান সীমান্তের কাছে তালিবানদের একটি রাস্তা তৈরি করা নিয়ে মতানৈক্যের কারণে বিরোধের সূচনা হয় এবং এর ফল স্বরূপ সাময়িক ভাবে সীমান্তের পথ বন্ধ করা হয় এবং একটি ইরানি সামরিক যান আটক করা হয়। গত আগস্ট মাসে তালিবানের কাবুল দখলের পর থেকে দুই পক্ষ এই নিয়ে দ্বিতীয় বার সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে।
আফগানিস্তানের সঙ্গে ইরানের ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত বরাবরই
শরণার্থী অন্তঃপ্রবাহ, চোরাচালান এবং মাদক পাচারের উদ্বেগের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকেছে। ইরান সরকারের অনুমান অনুযায়ী, ২০২১ সালে আনুমানিক ৫ লক্ষ আফগান ইরানে আশ্রয় নিয়েছেন। কাবুল দখলের পরে প্রতি দিন প্রায় ৫০০০ মানুষ ইরানে আসতে শুরু করেছেন, যেখানে আগে দৈনিক গড় সংখ্যা ছিল ১৪০০-২৫০০। তেহরান আফগান শরণার্থীদের পর্যাপ্ত ত্রাণ জোগাতে ব্যর্থ হচ্ছে, যে হেতু সে নিজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্ধারিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ভারে ন্যুব্জ।
ইরানে আফগান শরণার্থীদের প্রতি দুর্ব্যবহার ও তাদের শোষণ এক অন্যতম উদ্বেগের কারণ। গত মাসে কাবুল এবং হেরাতে ইরানের কূটনৈতিক মিশনের উপরে একদল আফগান বিক্ষোভকারীর পাথর ছোঁড়ার প্রতিবাদে সব পরিষেবা স্থগিত করা হয়। ইরানিদের দ্বারা কমবয়সি শরণার্থীদের হেনস্থা ও অপদস্থ করার কতগুলি ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ার পরেই এই বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। এটি প্রমাণ করে যে, তালিবান এবং ইরানের মধ্যে সম্পর্ক কতটা সংবেদনশীল এবং আনুষ্ঠানিক আদান-প্রদানের ফলে বিশেষ লাভ হয়নি। তেহরান বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতৃত্বকে ক্ষমা করে দিলেও সংগঠনটিতে কট্টরপন্থীদের উপস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট শঙ্কিত। বিশেষ করে গত কয়েক মাস ধরে সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রভিন্সের (আই এস কে-পি) আক্রমণ প্রতিরোধে তালিবানের ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে এই আশংকা জোরালো হয়েছে।
গত মাসে কাবুল এবং হেরাতে ইরানের কূটনৈতিক মিশনের উপরে একদল আফগান বিক্ষোভকারীর পাথর ছোঁড়ার প্রতিবাদে সব পরিষেবা স্থগিত করা হয়।
ইরান দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল আফগানদের উপরে শোষণ চালিয়েছে। চোরাচালানের পথ ধরে ইরানে পৌঁছতে পারা আফগানরা সে দেশে বৈষম্য এবং সীমিত কাজের সুযোগের সম্মুখীন হয়েছেন। এর পাশাপাশি ইরান আফগান শরণার্থীদের সিরিয়ায় যুদ্ধের কাজে পাঠায়, যার ফলে বহু সংখ্যক আফগান শরণার্থী শহিদ হন। অর্থ অথবা/এবং বাসস্থানের অনুমতির মরিয়া চাহিদার মুখে পড়ে বহু সংখ্যক যোগ্য আফগান পুরুষই সিরিয়ায় যুদ্ধের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হন, যার বিনিময়ে তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং তাদের পরিবারের জন্য উন্নত জীবনযাপন-সহ ৫০০ মার্কিন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বেশির ভাগ আফগানকেই ইরানের বাইরে বিশেষ অভিযানের জন্য নিয়োগ করা হয়। ফাতেমিয়ন বিভাগটি সেই সব আফগান যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত, যাঁরা ইরানিয়ান রেভোলিউশনারি গার্ডের অভিজাত বিভাগ ইরানি কুদস ফোর্সের অন্তর্গত।
অনথিভুক্ত আফগানদের অবস্থা নিবন্ধিত শরণার্থীদের তুলনায় সম্পূর্ণ বিপরীত। জীবিকা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর চরম নিষেধাজ্ঞা জারি থাকার পাশাপাশি এই আফগানরা ইরানীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা পুনরায় দেশে প্রেরণ এবং অবিরাম অত্যাচারের ভয়ের সম্মুখীন। জানুয়ারি মাস থেকে ইরানের সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতি দিন ২৫০০ থেকে ৩০০০ আফগানকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ইরান-আফগানিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির ফলে আগামী সপ্তাহগুলিতে এই সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। শরণার্থীদের প্রতি ব্যাপক অত্যাচারের ঘটনাও সামনে উঠে এসেছে, যেখানে ইরান থেকে কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গ বিহীন আফগানদের মৃতদেহ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
ইরান সরকার বিগত ৪০ বছর যাবৎ বিশেষ আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা ছাড়াই আফগান শরণার্থীদের এক বিশাল বোঝা বহন করে চলেছে, যেমনটা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ঘটেনি। তা সত্ত্বেও স্বল্প আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং ভঙ্গুর অর্থনীতি ইরানের আফগানদের উপর প্রকাশ্যে শোষণের কোনও অজুহাত হতে পারে না।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন
পাকিস্তান আফগানিস্তান থেকে ১৪ লক্ষেরও বেশি নিবন্ধিত শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। ২০২১ সালের ২৭ আগস্ট থেকে ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আনুমানিক ৫৫০০ আফগান সে দেশে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে ৬০ শতাংশ খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে বসবাস করছেন। পাকিস্তানের তরফে সীমান্তে বিধিনিষেধ এবং আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানোর কড়াকড়ি বাড়ানোর ফলে আফগানরা বর্ধিত চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। সম্প্রতি খাইবার পাখতুনখোয়ার পুলিশ বেশ কয়েকজন আফগান শিল্পীকে নির্বাসনের জন্য গ্রেফতার করেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে পেশোয়ারে এই মর্মে বিক্ষোভের সূচনা হয় যেখানে আফগানরা দাবি করেন, তালিবান শাসিত আফগানিস্তানে তাঁদের জীবন সুরক্ষিত নয়।
জীবিকা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর চরম নিষেধাজ্ঞা জারি থাকার পাশাপাশি এই আফগানরা ইরানীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা পুনরায় দেশে প্রেরণ এবং অবিরাম অত্যাচারের ভয়ের সম্মুখীন।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে পাকিস্তান সরকার আফগান শরণার্থীদের প্রায়ই বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করেছে। উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার অর্থনৈতিক বোঝা ছাড়াও ইসলামাবাদ তার জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় রয়েছে। পাকিস্তান সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ করতে চেয়েছে, যা পূর্ববর্তী আফগান সরকারগুলি কখনওই মেনে নেয়নি। এই বছরের গোড়ার দিকে সীমান্ত ঘিরে ফেলাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি ও তালিবান নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এই ধরনের সীমান্ত সংঘর্ষের ফলে সীমান্তের উভয় পার্শ্বের মানুষদের মধ্যে চলাচল উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এপ্রিল মাসে সীমান্তবর্তী প্রদেশ খোস্ত এবং কুনারে পাকিস্তানি বিমান হামলা আঞ্চলিক চাপ বৃদ্ধি করায় ইসলামাবাদ এবং তালিবানের মধ্যে অপ্রত্যাশিত অশান্তির সূত্রপাত হয়। তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টি টি পি) বিরুদ্ধে তালিবান ‘কঠোর পদক্ষেপ’ না নেওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়ে আফগান ভূখণ্ড থেকে চালানো ক্রমাগত আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইসলামাবাদ সামরিক অভিযান চালায় এবং এর ফলে ৪৭ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়। আফগানিস্তানে মার্কিন সমর্থিত প্রশাসনের পতনের পর থেকে টি টি পি পাকিস্তানে ৮২টি হামলা চালিয়েছে এবং ১৩৩ জনকে হত্যা করেছে। ইসলামাবাদের উপরে চাপ বজায় রাখতে এবং পাকিস্তানের প্রভাবের বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তালিবান স্পষ্টতই টি টি পি-র মতো পাকিস্তান-বিরোধী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
পারস্পরিক সম্পর্কের সাম্প্রতিক টানাপড়েনগুলি পাকিস্তানের ঐতিহাসিক কৌশলগত গভীরতা এবং আফগানিস্তানের উপর প্রভাবকে ক্ষুণ্ণ করেছে। তালিবানের শীর্ষ নেতা আনাস হাক্কানি সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, ‘ভারতের জন্য আফগানিস্তানের দরজা খোলা।’ এটি বিশেষ ভাবে উৎসাহব্যঞ্জক। কারণ ভারত দীর্ঘ দিন ধরে একটি সক্রিয় আঞ্চলিক শক্তির ভূমিকা পালন করেছে।
তালিবানের অধীনে আফগানিস্তান সে দেশের চরমতম মানবিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে যেখানে আগামী মাসের মধ্যে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ বৈশ্বিক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে চলেছেন।
উপসংহার
বর্তমানে পাকিস্তান ব্যাপক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্মুখীন এবং ইরানের অর্থনীতিও পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞার কারণে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। তালিবানের অধীনে আফগানিস্তান সে দেশের চরমতম মানবিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে যেখানে আগামী মাসের মধ্যে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ বৈশ্বিক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে চলেছেন। আফগানিস্তানের সাধারণ নাগরিকরা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী নন এবং উত্তরণের জন্য যা প্রয়োজন, তালিবান তা জোগাতে অক্ষম। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট কাবুল বিমানবন্দরে আতঙ্কিত জনতার বিশৃঙ্খল চিত্রগুলি তালিবান শাসনের প্রতি আস্থার অভাবকেই প্রতিফলিত করেছে।
আফগানদের সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলির উপর গুরুতর দায়িত্ব বর্তালেও ইউক্রেনের উপরে রুশ হামলার ফলে আফগানদের দুর্দশার কথা সকলেই ভুলে গিয়েছে। তাই এই মুহূর্তে প্রয়োজন ভারত এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলির মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলির সক্রিয় হয়ে ওঠা ও স্থিতিশীল, সুসমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আফগান শরণার্থী সঙ্কটের সমাধানের চেষ্টা করা যা অরক্ষিত মানুষদের পুনর্বাসনকে সুনিশ্চিত করার এক মাত্র পথ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.