ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তাঁর নিজের দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন, কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ ও আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে ভারতে তাঁর সফর ভারতীয় কৌশলগত সমীকরণে ফ্রান্সের সঙ্গে দেশটির বিশেষ সম্পর্ককেই চিহ্নিত করে। জয়পুরে ‘চায় পে চর্চা’ রোডশো এবং প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপনের জমকালো আয়োজন – যেখানে ম্যাক্রোঁ প্রধান অতিথি ছিলেন – আসলে দর্শায় যে, কী ভাবে কৌশলগত অভিজাত ও সাধারণ ভারতীয় নাগরিকরা ফ্রান্সকে একটি বিশ্বস্ত অংশীদার বলে মনে করেন। ফ্রান্স এমন একটি দেশ, যে সর্বদা ভারতের পাশে থেকেছে। আর এমনটা ঘটছে সেই বিশ্বে, যা প্রতিনিয়ত বিবর্তিত হয় এবং যেখানে স্থায়ী বন্ধু বলে কিছু হয় না।
ম্যাক্রোঁ হলেন প্রথম ফরাসি প্রেসিডেন্ট, যাঁকে দু-দু’বার প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে স্বাগত জানানো হয়েছে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী মোদী ম্যাক্রোঁ কর্তৃক আয়োজিত বাস্তিল দিবসের সামরিক কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথি ছিলেন, যেটিতে একটি ভারতীয় ট্রাই-সার্ভিসেস কন্টিনজেন্টও অংশগ্রহণ করেছিল। এবং এ বছর প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপনের সময়ে ফ্রান্স থেকে ৯৫ সদস্যের মার্চিং কন্টিনজেন্ট এবং ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট ব্যান্ড কন্টিনজেন্ট যোগদান করে।
ভারত ও ফ্রান্স ঘনিষ্ঠ অংশীদার হলেও প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং ম্যাক্রোঁর অধীনে এক স্থিতিশীল উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে, যা এই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্বকে একুশ শতকের বাস্তবতা এবং চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার যোগ্য করে তুলেছে।
এমনকি ফরাসি প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গাজার যুদ্ধ ও লোহিত সাগরের সঙ্কটের মতো আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সময় নিজেদের দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততাকে আরও জোরদার করার উপায়ও খুঁজে পেয়েছেন। এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিমান ও মহাকাশ, সামুদ্রিক প্রযুক্তি, সাইবার, রোবোটিক্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সহ-পরিকল্পনা, সহ-উন্নয়ন এবং সহ-উৎপাদনের সুযোগ বাড়ানোর জন্য প্রতিরক্ষা শিল্প সহযোগিতার একটি পথনির্দেশিকা গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি মানুষদের জন্য একটি ‘ইয়ং প্রফেশনাল’ স্কিম বা ‘যুব পেশাদারিত্ব’ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে, যার লক্ষ্য হল দুই দেশের সমাজকে আরও কাছাকাছি আনা।
ভারত ও ফ্রান্স ঘনিষ্ঠ অংশীদার হলেও প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং ম্যাক্রোঁর অধীনে এক স্থিতিশীল উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে, যা এই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্বকে একুশ শতকের বাস্তবতা এবং চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার যোগ্য করে তুলেছে। ইন্দো-ফরাসি কৌশলগত অংশীদারিত্বের এই ২৫তম বর্ষে শুধু মাত্র অতীতের অর্জন আঁকড়ে সন্তুষ্ট থাকা হচ্ছে না। কৌশলগত বাস্তবতাগুলি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে এবং যে কোনও অংশীদারিত্বকেই প্রাসঙ্গিক থাকতে গেলে বিবর্তিত হতে হবে। এই ধরনের বিবর্তন তুলনামূলক ভাবে সহজ হয়ে ওঠে, যখন সম্পৃক্ততার মধ্যে এক চিরাচরিত স্বাচ্ছন্দ্য বজায় থাকে।
ভারত ও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে এই উচ্চ মাত্রার স্বাচ্ছন্দ্যের স্তরটি এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপনে যোগ দিতে পারেননি, তখন ম্যাক্রোঁ বিনা দ্বিধায় নয়াদিল্লির আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিলেন। এই ঘটনা এমন এক বোঝাপড়াকে দর্শায়, যা আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে বিরল এবং যার ফলে নয়াদিল্লি ও প্যারিস উভয়ই পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক বাস্তবতার আলোকে তাদের সম্পর্ককে সুসংহত ভাবে পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়েছে।
ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় ফ্রান্স প্রথম পশ্চিমী দেশ হিসেবে তখন ভারতের উপরে বাজি ধরেছিল, যখন অধিকাংশ পশ্চিমী দেশই ভারতের প্রতি কোনও উৎসাহ প্রদর্শন করেনি। এ ছাড়াও ফ্রান্স অন্যদের তুলনায় অনেক ভাল ভাবে পারমাণবিক শক্তির নিরিখে নয়াদিল্লির সক্ষমতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝতে পেরেছিল। ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক শক্তি পরীক্ষার পর ভারতের পাশে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে পারমাণবিক সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে ভারতের সদস্যপদ এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ সমর্থন করা পর্যন্ত… ফ্রান্স বরাবর ভারতের পক্ষাবলম্বন করেছে। কারণ ভারত আন্তর্জাতিক সৌর জোটের মতো নতুন মঞ্চ তৈরি করতে চেয়েছিল। যখন বিশ্বের একটি বড় অংশ ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তখন সন্ত্রাসবাদ ও কাশ্মীরের মতো প্রসঙ্গে ফ্রান্সের সমর্থন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
নয়াদিল্লি ভারত মহাসাগরে আরও শক্তিশালী ফরাসি সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ ভারত সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে অংশীদারিত্ব স্থাপনে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বৃহত্তর সামুদ্রিক স্থিতিশীলতার প্রত্যাশী।
এবং ভারত যখন তার প্রতিরক্ষা মিত্রের তালিকায় বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা চালাচ্ছিল, তখন ফ্রান্স একটি অগ্রাধিকার দেশ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। নয়াদিল্লি ভারত মহাসাগরে আরও শক্তিশালী ফরাসি সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ ভারত সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে অংশীদারিত্ব স্থাপনে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বৃহত্তর সামুদ্রিক স্থিতিশীলতার প্রত্যাশী। কিছু দিন আগে ভারতীয় বিমানবাহিনী ফ্রেঞ্চ এয়ার অ্যান্ড স্পেস ফোর্স (এফএএসএফ) এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (ইউএই) এয়ার ফোর্সের সহযোগিতায় আরব সাগরে তিন বিমান বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় ও আন্তঃকার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এক্সারসাইজ ডেজার্ট নাইট পরিচালনা করেছিল।
উভয় দেশই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে অগ্রাধিকার দেয় এবং তাই তারা একে অপরের অগ্রাধিকারগুলি সম্পর্কে ভাল মতো অবগত। যখন ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপ দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কটের সম্মুখীন এবং ইন্দো-প্যাসিফিকে ক্ষমতার ভারসাম্য দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তখন উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান প্রদান করতে ও নেতৃত্ব দিতে প্যারিস এবং নয়াদিল্লিকে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করতে হবে। অন্য দিকে মার্কিন রাজনৈতিক পরিসরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছায়া ঘনিয়ে আসছে। তাই আরও বড় বাধার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং ম্যাক্রোঁ একটি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে সফল হয়েছেন, যা দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও সুসংহত করতে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব যখন একাধিক উত্স থেকে বাধার সম্মুখীন হয়েছে এবং মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আর একটি উল্লেখযোগ্য মন্থনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তাই নয়াদিল্লি এবং প্যারিসকে একটি আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা গঠনের জন্য সাধারণ দ্বিপাক্ষিকতার ঊর্ধ্বে উঠে গুরুতর মনোযোগের দাবি রাখে এ হেন বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে হবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.