রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধার, হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে নেপালের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ফেডারেলিজম বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে গত ২৩ নভেম্বর হাজার হাজার মানুষ কাঠমান্ডুর রাস্তায় নেমেছিলেন।
‘রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয়তা, ধর্ম, সংস্কৃতি রা নাগরিক বাচাউ’… অর্থাৎ তরজমা করলে দাঁড়ায় ‘জাতি, জাতীয়তা, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং নাগরিকদের বাঁচাও’… এ হেন দাবিতেই দুর্গা প্রসাইয়ের নেতৃত্বে প্রচারাভিযানে নেমেছিলেন নেপালের সাধারণ মানুষ। প্রসাই একজন নেপালি ব্যবসায়ী। প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল ‘প্রচণ্ড’ ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকলেও সে সম্পর্ক এখন বিচ্ছিন্নই বলা যায়।
নেপাল তার ২৪০ বছরের রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর থেকে রাজতন্ত্রপন্থী এবং হিন্দুপন্থী বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে। শুধু মাত্র ২০২৩ সালেই ধরন, নেপালগঞ্জ এবং আরও কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।
নেপাল তার ২৪০ বছরের রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর থেকে রাজতন্ত্রপন্থী এবং হিন্দুপন্থী বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে। শুধু মাত্র ২০২৩ সালেই ধরন, নেপালগঞ্জ এবং আরও কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।
প্রসাইয়ের নেতৃত্বে বিক্ষোভগুলি যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে। কারণ বিক্ষোভগুলি ‘দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক কর্তাদের শঙ্কিত করেছে’। এ হেন প্রতিক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে, যা টিকটক-এর উপর নেপাল সরকারের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞাতেই স্পষ্ট। প্রসাইয়ের নেতৃত্বে বিক্ষোভের কিছু দিন আগে নেপাল সরকার সামাজিক সম্প্রীতির উপর অ্যাপের নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে ১৩ নভেম্বর টিকটক-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যাই হোক, অনেকে দাবি করেন যে অলি এবং প্রচণ্ডের সমালোচনা করে প্রসাইয়ের পোস্টগুলিকে দমন করার জন্যই অ্যাপটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আসলে প্রসাইয়ের পোস্টগুলি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে এ হেন নিষেধাজ্ঞাকে বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আঘাত বলে গণ্য করা হয়। এ কথা বলা জরুরি যে, তিহার উৎসবের সময়, যখন দেশের বেশির ভাগ অংশই বন্ধ থাকে, তখন অংশীদারদের সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। টিকটক-এর উপরে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ১৪টি রিট পিটিশন সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা হয়েছে। আদালত সরকারকে নিষেধাজ্ঞার কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিলেও অন্যান্য বিচারাধীন মামলার কারণে এখনও নির্ধারিত শুনানি হয়নি।
অ্যাপটিকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরাও। নেপালের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক দাবি করে যে, টিকটক নিয়ন্ত্রণ করার কোনও উপায় নেই এবং নেপালে প্রচলিত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং এক্স-সহ (আগে যা ছিল টুইটার) অন্য সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলির ভাগ্য সম্পর্কে শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলি ইতিমধ্যেই ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণের সম্মুখীন হচ্ছে। সম্প্রতি পাস হওয়া ‘ডিরেক্টিভস অন দি অপারেশন অব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ২০২৩’ অনুসারে মঞ্চগুলির অফিস নেপালে স্থাপন করার বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নির্দেশিকায় সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলির ব্যবহারকারীদের তরফে করা-যাবে-না এমন ১৯ দফার তালিকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, সরকার টিকটক-এর মাধ্যমে ‘পরিস্থিতির গভীরতা মেপে দেখছে’ এবং আগামিদিনে অন্য সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলির উপরেও বিধিনিষেধমূলক পন্থা নিতে পারে।
নেপালের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক দাবি করে যে, টিকটক নিয়ন্ত্রণ করার কোনও উপায় নেই এবং নেপালে প্রচলিত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং এক্স-সহ (আগে যা ছিল টুইটার) অন্য সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলির ভাগ্য সম্পর্কে শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
প্রসাই-এর নেতৃত্বে বিক্ষোভগুলি প্রাথমিক ভাবে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এলেও নেপালের বৃহত্তম রাজতন্ত্রপন্থী দল রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টিও (আরপিপি) – যার হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদে ১৪টি আসন রয়েছে - সম্প্রতি তার কার্যক্রম জোরদার করেছে। দলটি সম্প্রতি ঝাপায় রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ-এর একটি মূর্তি উন্মোচনের আয়োজন করেছে। রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ-কে আধুনিক নেপালের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। এই অনুষ্ঠানে নেপালের শেষ রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়, যিনি দলের এক শক্তিশালী সমর্থক। দলটি গত বছরে বেশ কয়েকটি বড় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে এবং ‘এক অভ্যুত্থানের ভিত্তি স্থাপন’ করার উদ্দেশ্যে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে দু’মাস ধরে সচেতনতা প্রচার চালানোর পরিকল্পনা করেছে।
আরপিপি ও প্রসাই নিজেদেরকে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেও তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা নেপালে অ-প্রজাতন্ত্রী, অ-ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবকেই শক্তিশালী করেছে বলে মনে হয়।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা এবং নেপালি কংগ্রেসের সভাপতি জানিয়েছেন যে, তাঁর দল – যা নেপালের বর্তমান জোট সরকারের অংশও - ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাঁরা মনে করেন যে, রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা ‘অকল্পনীয়’। উপরন্তু প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে, নেপালি কংগ্রেসের সদস্যদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিন্দু রাষ্ট্র পুনরুদ্ধারের বিষয়টিকে সমর্থন করে। প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড অবশ্য এই অবস্থানেই অটল থেকেছেন যে, তাঁর সরকার ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের প্রেক্ষিতে সমঝোতা করবেন না। তার পাশাপাশি তিনি এ-ও দাবি করেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতার পতন নেপালি প্রজাতন্ত্রের সমূহ পতন ডেকে আনবে।
ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী পর্যায় নেপালের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কোনও অসাধারণ ঘটনা নয়। সপ্তম এবং বর্তমান সংবিধানে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ হিসাবে নেপালের শ্রেণিকরণ সর্বজনীন-স্বাগত পরিবর্তন ছিল না। নেপালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ‘হিন্দু’ বা ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিল। ২০১৫ সালে এই সংবিধান প্রবর্তনের পর থেকে নেপাল একটি হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে নেপালকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষিপ্ত সমাবেশের সাক্ষী থেকেছে।
২০২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের আগে এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বাতাবরণে হওয়ার দরুন বিদ্যমান আন্দোলনটি অবশ্য নানাবিধ তাৎপর্য বহন করে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, যে দলগুলি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, সেই দলগুলি আসন্ন নির্বাচনে খারাপ ফল করতে পারে।
হিন্দুপন্থী ও রাজতন্ত্রপন্থী প্রবণতার গতিপথ এমন একটি দেশে পরিমাপ করা কঠিন, যেখানে নেতা এবং দলগুলি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য কুখ্যাত। তা সত্ত্বেও এই প্রবণতার মূল কারণগুলির দিকে মনোযোগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ - যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সেই সব নেতার প্রতি নেপালের মানুষজনের স্পষ্ট মোহভঙ্গ ঘটেছে, যাঁরা তাঁদের প্রতিশ্রুত আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রতিষ্ঠা রিজাল নিউ দিল্লির দি এশিয়া গ্রুপের সাউথ এশিয়া অ্যাসোসিয়েট। তিনি জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি থেকে এশিয়ান স্টাডিজে স্নাতকোত্তর।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.