এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে বেশ কয়েকটি পশ্চিমী দেশ রাশিয়াকে স্পষ্টতই নিন্দা করার বিষয়ে ভারতের অসম্মতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। একই সঙ্গে, গত বছর ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বিতর্কিত চিন সফর এবং বেজিংয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরতর করার ব্যাপারে তাঁর ইচ্ছা চিনের প্রতি ফ্রান্সের অস্পষ্ট নীতি নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলেছে। ইউক্রেনের প্রতি ফ্রান্সের দৃঢ় সমর্থন ও চিনের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এই দু’টি ক্ষেত্রেই ভারত ও ফ্রান্সের কেউই একে অপরকে অবস্থান বদলের জন্য বা নির্দিষ্ট কোনও অবস্থান গ্রহণের জন্য চাপ দেয়নি।
বৈদেশিক নীতির নিরিখে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের প্রতি উভয় দেশের তীব্র ঝোঁকের অর্থ হল এই ধরনের সম্ভাব্য সংঘাতবিন্দুর অপসারণ ঘটিয়ে এক বিশেষ সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করা। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শেষ মুহূর্তের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ভারতের প্রাচীনতম কৌশলগত অংশীদারিত্বের নির্ভরযোগ্য প্রকৃতি প্রদর্শন করে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হওয়ার অনুরোধ সদয় ভাবে গ্রহণ করেছিলেন। মধ্যম ও ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে ভারত ও ফ্রান্স একসঙ্গে ‘তৃতীয় পথ’-এর প্রতিনিধিত্ব করে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চিন ব্লকের রাজনীতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে।
ফ্রান্স বর্তমানে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী। ভারতের সঙ্গে তার অংশীদারিত্বের পরিমাণ ২৯%। ভারত-মার্কিন সম্পর্ক দ্রুত প্রসারিত হলেও মার্কিন অংশীদারিত্বের পরিমাণ মাত্র ১১%।
এই সম্পৃক্ততা বহুক্ষেত্রব্যাপী সহযোগিতার এক বহুমুখী অংশীদারিত্ব, যার কেন্দ্রে রয়েছে প্রতিরক্ষা। ফ্রান্স বর্তমানে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী। ভারতের সঙ্গে তার অংশীদারিত্বের পরিমাণ ২৯%। ভারত-মার্কিন সম্পর্ক দ্রুত প্রসারিত হলেও মার্কিন অংশীদারিত্বের পরিমাণ মাত্র ১১%। ফ্রান্সের অধিক কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা অধিগ্রহণ একটি তুলনামূলক ভাবে ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া। তাই ফ্রান্সকে একটি সহজ ‘কম পিছুটানসম্পন্ন’ অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করা হয়; বিশেষ করে ভারতের চিরাচরিত অংশীদার রাশিয়া থেকে নিজের প্রতিরক্ষা চাহিদার বৈচিত্র্যকরণের লক্ষ্যের প্রেক্ষিতে এবং একই সঙ্গে মেক ইন ইন্ডিয়া উদ্যোগের প্রেক্ষিতে দেশীয় যন্ত্রপাতি উৎপাদনের জন্য দরকারি প্রযুক্তি স্থানান্তর ও উন্নত জ্ঞানের প্রেক্ষিতে। রাফালে জেট এবং স্কোর্পেন সাবমেরিন সংক্রান্ত মেগা চুক্তি ছাড়াও দুই নেতা তৃতীয় দেশগুলিতে সরঞ্জাম সরবরাহের সম্ভাবনা-সহ সামরিক যন্ত্রপাতির সহ-উন্নয়ন ও সহ-উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি ‘প্রতিরক্ষা শিল্প পথনির্দেশিকা’ গ্রহণ করেছিলেন। বেসামরিক হেলিকপ্টার তৈরির জন্য এয়ারবাস-টাটা চুক্তির কাজ চলছে।
তবুও নিরাপত্তা সহযোগিতা শুধুমাত্র অস্ত্র চুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ইন্দো-প্যাসিফিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলেও প্রসারিত, যেখানে ভারত এবং ফ্রান্স এই অঞ্চলে তাদের ধারণাগত সংজ্ঞা, আইনের প্রশাসন এবং যোগাযোগের স্থিতিশীল সমুদ্রপথ বজায় রাখার প্রয়োজনে চিনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে। অবৈধ মাছ ধরা ও জলদস্যুতা প্রতিরোধের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো ‘সমমনস্ক’ দেশগুলির সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক সক্ষমতা-সহ নিরাপত্তা ক্ষেত্রে শক্তিশালী সামুদ্রিক সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি হয়েছে।
ভারত ও ফ্রান্স উভয়ই অঞ্চলস্থিত শক্তি। ফ্রান্সের এই অঞ্চলে নাগরিক, সামরিক ঘাঁটি ও অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে যা দেশটিকে ২০১৮ সালে একটি ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রকাশকারী প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসাবে তৈরি করেছে। ইউরো-আটলান্টিক ও ইন্দো-প্যাসিফিক মঞ্চে নিরাপত্তার সংযোগের মাধ্যমে ফ্রান্সের ভিত্তি তখন থেকে শক্তিশালী হয়েছে। গত বছর ভারত ও ফ্রান্স ইন্দো-প্যাসিফিক সহযোগিতার জন্য একটি পথনির্দেশিকা চালু করেছিল, যার মধ্যে তৃতীয় দেশগুলিতে স্থিতিশীল প্রকল্পগুলির জন্য একটি উন্নয়ন তহবিলও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক ওশান ইনিশিয়েটিভ-এ (আইপিওআই) ফ্রান্স সামুদ্রিক সম্পদের উৎসগুলির দেখভাল করে।
দুই নেতা জৈতাপুরে ছ’টি মুলতুবি থাকা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা না করলেও ছোট ও উন্নত দুই ধরনের মডিউলার চুল্লিতে সহযোগিতা পুনর্নবীকরণযোগ্য এবং দূষণহীন হাইড্রোজেনে পূর্ব বিদ্যমান শক্তি সহযোগিতা আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। জয়পুরে ম্যাঁক্রোকে যে চা পরিবেশন করা হয়, তার মূল্য তিনি ইউপিআই-এর মাধ্যমে প্রদান করেছিলেন। ইউপিআই ভারতের এমন ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, যা ফ্রান্স বাস্তবায়ন করতে চায় এবং তার শুরু করতে চায় আইফেল টাওয়ারের টিকিটের মাধ্যমে। মোদী এবং ম্যাক্রোঁ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের বিষয়ে একটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেছেন এবং মহাকাশ পরিস্থিতিগত সচেতনতার বিষয়ে সহযোগিতা আরও গভীরতর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
একই সময়ে ইন্দো-জার্মান বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল এর প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়াও, ফ্রান্স ভারতের ১১তম বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী।
যাই হোক, দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনও উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রথমটি হল বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ, যা ভারত-ফ্রান্স সম্পর্কের নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রকেন্দ্রিক প্রকৃতির কারণে চিরাচরিত ভাবে পিছিয়েই রয়েছে। ভারত এবং ফ্রান্স যথাক্রমে বিশ্বের পঞ্চম ও সপ্তম বৃহত্তম অর্থনীতি। তবুও ২০২২-২৩ সময়কালে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে ইন্দো-জার্মান বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল এর প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়াও, ফ্রান্স ভারতের ১১তম বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী।
এ কথা নিঃসন্দেহে উত্সাহজনক যে, বেসরকারি খাতের বৃহত্তর সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে এবং উচ্চ পর্যায়ের সফরের সময় ভারতীয় ও ফরাসি সিইওদের উপস্থিতির মাধ্যমে এই ভারসাম্যহীনতার মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে – যে আলাপ-আলোচনা বর্তমানে পুরোদমে চলছে - সেই বাণিজ্য সর্বাধিক বৃদ্ধি পেতে পারে।
মানুষে মানুষে সংযোগ বৃদ্ধি করা আর একটি প্রচেষ্টা, যা অংশীদারিত্বকে উপকৃত করতে পারে। এতে আরও শিক্ষাগত আদান-প্রদানের পাশাপাশি সুশীল সমাজের যোগসূত্র অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও জার্মানির সঙ্গে তুলনা করলে একটি চিত্র প্রকট হয়ে ওঠে — ফ্রান্সে মাত্র ১০০০০ ভারতীয় ছাত্র পাঠরত, যেখানে জার্মানিতে প্রায় ৩৫০০০ ভারতীয় ছাত্র রয়েছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যাটিকে ৩০০০০-এ উন্নীত করার ম্যাক্রোঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলস্বরূপ ভারতীয় ছাত্রদের পাঁচ বছরের স্বল্প-স্থায়ী শেনজেন ভিসা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে… উভয় প্রচেষ্টাই আশাব্যঞ্জক। তবুও ফ্রান্সের বিতর্কিত নতুন অভিবাসন আইন - যা অভিবাসী ও বিদেশীদের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে - এই ধরনের প্রচেষ্টাকে বাধা দিতে পারে।
এ বছর ভারতের সাধারণ নির্বাচনের নিরিখে মোদীর রাজনৈতিক সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তবে ম্যাক্রোঁ পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পরে দেশের অভ্যন্তরে অত্যন্ত খারাপ ফলাফল করেছেন, যা দ্বিতীয় দফায় তাঁর প্রশাসনিক ক্ষমতাকে প্রভাবিত করবে। এটি সম্প্রতি উল্লিখিত অভিবাসন আইনেও স্পষ্ট ছিল, যেখানে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করানোর জন্য কেন্দ্রবাদী ম্যাক্রোঁকে অতি-দক্ষিণপন্থী মানুষদের দিকে ঝুঁকতে দেখা গিয়েছে। উচ্চ আন্তর্জাতিক কূটনীতির আড়ম্বর ও প্রতিযোগিতা তাই একটি অভ্যন্তরীণ উত্সাহ প্রদান করে।
২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যাটিকে ৩০০০০-এ উন্নীত করার ম্যাক্রোঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলস্বরূপ ভারতীয় ছাত্রদের পাঁচ বছরের স্বল্প-স্থায়ী শেনজেন ভিসা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে… উভয় প্রচেষ্টাই আশাব্যঞ্জক।
একাধিক সঙ্কটে জর্জরিত অস্থির বিশ্বের কল্যাণের জন্য নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসাবে ভারত-ফ্রান্স অংশীদারিত্ব এক মঙ্গলময় শক্তি হয়ে উঠেছে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে, দুই নেতার মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে এবং গত জুলাই মাসে মোদীর প্যারিস সফরের সময়ে একটি উচ্চাভিলাষী ‘হরাইজন ২০৪৭ রোডম্যাপ’ প্রকাশ্যে আনা হয়। সম্পর্কের পথনির্দেশিকা এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত কথোপকথন এই সম্পর্কের সঞ্চারপথকে দিশা দিতে পারে। নয়াদিল্লি এবং প্যারিসের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে কার্যকর করা।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.