২০১৭ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাস পরে প্যারিসের সরবন ইউনিভার্সিটিতে এক বক্তৃতায় এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একটি ‘সার্বভৌম ইউরোপ’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন, যা একটি ইউরোপীয় কৌশলগত সংস্কৃতি তৈরির পাশাপাশি একটি সাধারণ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করবে। জুন মাসে হতে চলা ইউরোপীয় নির্বাচনের ঠিক আগে এই বছর ২৫ এপ্রিল ম্যাক্রোঁ একটি দীর্ঘ বক্তৃতায় সরবনের অনুরূপ ভাবনাগুলিকে আরও বেশি তাগিদ ও আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একাধিক অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি মৌলিক ভাবে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ হেন বক্তৃতাটি ম্যাক্রোঁর তরফে অ্যাপোক্যালিপটিক বা ধ্বংস-পূর্ববর্তী সতর্কতা-সম, যখন ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন, ‘ইউরোপ নশ্বর; তারও মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু তা নির্ভর করবে আমরা কোন পথে হাঁটব, তার উপর।’ এখনও পর্যন্ত ইউরোপীয় সমৃদ্ধির উপর নির্ভরশীলতার নিরিখে পরিচিত ত্রয়ীর (তিন দেশ) কথা তুলে ম্যাক্রোঁ পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, ‘চিনে আমাদের উৎপাদনের ভিত্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের প্রতিরক্ষা অর্পণ এবং রাশিয়া থেকে আমাদের জ্বালানি পাওয়ার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে।’
এখনও পর্যন্ত ইউরোপীয় সমৃদ্ধির উপর নির্ভরশীলতার নিরিখে পরিচিত ত্রয়ীর (তিন দেশ) কথা তুলে ম্যাক্রোঁ পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, ‘চিনে আমাদের উৎপাদনের ভিত্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের প্রতিরক্ষা অর্পণ এবং রাশিয়া থেকে আমাদের জ্বালানি পাওয়ার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে।’
ম্যাক্রোঁর বক্তৃতার মূল বক্তব্য
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রতিরক্ষা বিষয়ে ম্যাক্রোঁর ধারণা এবং ইউরোপীয় কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার জন্য তাঁর উত্সাহী চাপকে আরও বেশি পরিমাণে আশ্বাস প্রদান করেছে। তাঁর দু’ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ বক্তৃতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে প্রধান বিষয়টিই ছিল প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (ইউএস) সমর্থন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা। ম্যাক্রোঁ একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরক্ষা কৌশল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সামরিক প্রস্তুতিকে শক্তিশালী করার জন্য ইউরোপের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন, যা ‘ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা উদ্যোগ’ নির্মাণ এবং এর ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। একটি ‘ইউরোপ ফার্স্ট’ বা ‘সর্বাগ্রে ইউরোপই’ পদ্ধতি অবলম্বন করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় এবং ব্লকের প্রতিরক্ষা শিল্পকে উত্সাহিত করার ক্ষেত্রে স্থানীয় ইউরোপীয় নির্মাতাদের জন্য তাঁর পছন্দের উপর জোর দিয়েছিলেন।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রতিরক্ষা বিষয়ে ম্যাক্রোঁর ধারণা এবং ইউরোপীয় কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার জন্য তাঁর উত্সাহী চাপকে আরও বেশি পরিমাণে আশ্বাস প্রদান করেছে।
গত বছর বেজিং সফরের সময় তাইওয়ান সম্পর্কে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্যের রেশ টেনে ম্যাক্রোঁ আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চিন বৃহৎ শক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝেই তৃতীয় পথ রচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, ইউরোপ কখনওই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না এবং ট্রান্স-আটলান্টিক জোটের শক্তি থাকা সত্ত্বেও ইউরোপ কখনওই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার ছিল না।
বাণিজ্যের বিষয়ে ম্যাক্রোঁ স্থানীয় শিল্পকে উত্সাহিত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন দ্বারা ব্যবহৃত ভর্তুকি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নিয়মকে সম্মান না করার দায়ে উক্ত দুই দেশকে অভিযুক্ত করেছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ইইউ বৈদ্যুতিক যানবাহনের চিনা উৎপাদন সংক্রান্ত একটি ভর্তুকি বিরোধী তদন্ত শুরু করেছে এবং এখন সৌর প্যানেলের মতো অন্যান্য ক্ষেত্রেও তদন্ত করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। অন্য দিকে, ইউরোপীয় সংস্থাগুলি ইউএস ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট বা মার্কিন মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইনের প্রভাবের আশঙ্কা করছে, যা দূষণহীন রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করার কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসাগুলিকে ভর্তুকি প্রদান করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ম্যাক্রোঁ ইইউ বাণিজ্য নীতিকে সংস্কার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, যার মধ্যে বৃহত্তর জনবিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রিন এনার্জি বা দূষণহীন জ্বালানি এবং প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সংস্থাগুলিকে সমর্থন করার পাশাপাশি ইইউ-এর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করার কথাও অন্তর্ভুক্ত।
ম্যাক্রোঁর বক্তৃতায় অন্তর্ভুক্ত অন্য ভাবনাগুলির মধ্যে রয়েছে ফরাসিদের প্রিয় পারমাণবিক শক্তির পাশাপাশি রাশিয়া ও ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলির দ্বারা ইউরোপের ‘পরিবেষ্টিত’ হয়ে পড়া সংক্রান্ত সতর্কীকরণ এবং ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দেওয়ার সমালোচনা। ম্যাক্রোঁ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের রূপরেখা প্রদান করেছেন, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে ইইউ একটি ‘বিশ্ব নেতা’ হয়ে উঠবে, যার মধ্যে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মহাকাশ, বায়োটেক বা জৈব প্রযুক্তি, গ্রিন এনার্জি বা দূষণহীন জ্বালানি এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং অন্তর্ভুক্ত। তিনি ইইউ-এর কার্বন শুল্কের মাধ্যমে ইইউ সম্পদ বৃদ্ধির উপায় দর্শিয়েছেন এবং ইইউ-র ৮০০ বিলিয়ন ইউরো অতিমারি সংক্রান্ত পুনরুদ্ধার তহবিলের মতো নতুন যৌথ ইউরোপীয় ঋণ অধিগ্রহণকেও সমর্থন করেছেন।
ম্যাক্রোঁর বক্তৃতায় অন্তর্ভুক্ত অন্য ভাবনাগুলির মধ্যে রয়েছে ফরাসিদের প্রিয় পারমাণবিক শক্তির পাশাপাশি রাশিয়া ও ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলির দ্বারা ইউরোপের ‘পরিবেষ্টিত’ হয়ে পড়া সংক্রান্ত সতর্কীকরণ এবং ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দেওয়ার সমালোচনা।
একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি
২০১৭ সাল থেকে ম্যাক্রোঁর অভ্যন্তরীণ অবস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁর পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর মাধ্যমে দুর্বল হয়ে পড়েছে, যা গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করার কাজটিকে কঠিন করে তুলেছে, যেমনটি সম্প্রতি পাস হওয়া অভিবাসন আইনের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ছিল এবং তাঁর পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ টানা প্রতিবাদেও সেই একই কথা বোঝা গিয়েছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলি দর্শায় যে, ফ্রান্সের এক তৃতীয়াংশেরও কম ভোটার তাঁদের প্রেসিডেন্টের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। ইইউ স্তরেও বিরোধী দলীয় নেতা মেরিন লে পেনের অতি-দক্ষিণপন্থী রাসেম্বলমেন্ট ন্যাশনাল পার্টি একটি অগ্রণী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা বর্তমান ইউরোপীয় পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম ব্লক ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী রিনিউ গ্রুপকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
সর্বোপরি, ফরাসি প্রেসিডেন্টকে প্রায়শই দেখনদারির দোষে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কারণ ম্যাক্রোঁ বিশদ বিবরণ এবং সুস্পষ্ট সমাধান প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন। কেউ কেউ এই বক্তৃতাটিকে ম্যাক্রোঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সশক্ত করার একটি উপায় বলে মনে করেন; যেহেতু ফরাসি আইন অনুসারে ২০২৭ সালে ম্যাক্রোঁ আবার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এ ছাড়াও, অন্য ইউরোপীয় দেশগুলির তুলনায় ইউক্রেনকে কম ত্রাণ প্রদান করা, কম ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে স্থান দেওয়া এবং এখনও পর্যন্ত ন্যাটোর শর্তানুযায়ী জিডিপি-র ২ শতাংশ ব্যয়ের মাত্রা পূরণ না করার মতো ফরাসি নীতির প্রবণতা আসলে ম্যাক্রোঁর দুঃসাহসী বক্তব্যের বিপরীত। মার্কিন কৌশলগত নির্ভরতা-সহ ইস্টার্ন ফ্ল্যাঙ্কের স্বাচ্ছন্দ্যের আকারেই নয়, ফ্রাঙ্কো-জার্মান ও ইউনিয়নের মধ্যে অন্যান্য বিচ্ছিন্নতার আকারেও বৃহত্তর ইউরোপীয় স্বায়ত্তশাসনের পথে প্রতিকূলতা বিদ্যমান।
এবং তা সত্ত্বেও ২০১৭ সালে ম্যাক্রোঁর শেষ ভাষণের পর থেকে যে ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাগুলি ঘটেছে, তা থেকে, বিশেষত নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের ধারণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সতর্কতা নির্বিশেষে ম্যাক্রোঁর দৃষ্টিভঙ্গি এমন বিপ্লব ঘটাতে পারে, যা ইউরোপকে তার আত্মতুষ্টির বুদ্বুদ থেকে নিজেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে, যদি না ইউরোপ তার ৪৫০ মিলিয়ন নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি মার্কিন ভোটারদের আনুকূল্যে ছেড়ে দিতে চায়।
শায়রী মলহোত্র অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.