Expert Speak Raisina Debates
Published on Feb 24, 2022 Updated 11 Hours ago

এই দুই পর্বের প্রতিবেদন সিরিজের মূল লক্ষ্য হল প্রতিবেশে ভারত বিরোধী মনোভাবের সূত্রপাত ও প্রচারের নেপথ্যে থাকা কারণগুলিকে খুঁজে বার করা। এই পর্বে অমীমাংসিত সমস্যা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের প্রচারের ভূমিকার মূল্যায়ন করা হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বিরোধী মনোভাবের মূল্যায়ন (দ্বিতীয় পর্ব)

Image Source: iStock — Getty

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বিরোধী মনোভাবের মূল্যায়ন (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রথম পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।


অমীমাংসিত সমস্যা

দীর্ঘস্থায়ী দ্বিপাক্ষিক সমস্যা এবং অসন্তোষের কারণগুলিও ভারত বিরোধী মনোভাব বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এই সব অমীমাংসিত সমস্যা এই ধারণার জন্ম দিয়েছে যে, এই অঞ্চলে ভারতের আগ্রহ নেই এবং ভারত নিজের জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেখতে অক্ষম। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব উভয় তরফে বিদ্যমান থাকলেও ভারত সম্পর্কিত সংশয়, ভয় এবং প্রত্যাশা এই দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাকে শক্তিশালী করেছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জল বণ্টন সংক্রান্ত সমস্যা বাংলাদেশে ভারতের প্রতি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। স্পষ্টতই আজ পর্যন্ত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী থাকা সত্ত্বেও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কেবল মাত্র একটি জল বণ্টন চুক্তি বর্তমান। মুহুরি সমস্যা, ভারতের সীমান্তে বেড়া দেওয়া এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যাও এই নেতিবাচক মনোভাবকে জিইয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। পাশপাশি অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং আন্তঃসীমান্তবর্তী অপরাধমূলক কাজকর্মের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করাও ভারতের ভাবমূর্তিকে ইতিবাচক করে দেখায়নি। একই ভাবে শ্রীলঙ্কায় ভারত মৎস্যজীবী সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে এবং ভারত শ্রীলঙ্কাকে ১৩তম সংশোধনী ধারা বহাল করার জন্য বারংবার জোর দিয়েছে।

অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং আন্তঃসীমান্তবর্তী অপরাধমূলক কাজকর্মের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করাও ভারতের ভাবমূর্তিকে ইতিবাচক করে দেখা হয়নি।

নেপালের সঙ্গেও ভারতের একাধিক অমীমাংসিত সমস্যা বর্তমান। জল বণ্টন দু’দেশের মধ্যে একটি মুখ্য মন কষাকষির কারণ। কোশি, গণ্ডকী এবং মহাকালী নদীর জল সংক্রান্ত চুক্তিগুলিকে নেপালিরা অন্যায্য এবং শোষণমূলক বলে মনে করে। এ ছাড়াও গোর্খাদের নিয়োগ, চোরাচালান, আন্তঃসীমান্ত অপরাধমূলক কাজকর্ম, উন্মুক্ত সীমান্তের অপব্যবহার, ১৯৫০ সালের চুক্তি, ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীদের দ্বারা সীমান্তবর্তী অঞ্চল দখল এবং নেপালি ভূখণ্ডে তাদের অবৈধ প্রবেশও দুই দেশের মধ্যে প্রধান অশান্তির কারণগুলির অন্যতম।

দেশগুলির তরফে এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলি সমাধানে অক্ষমতা এবং অনিচ্ছা ভারতের প্রতি তাদের সংশয়কে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অন্যান্য দেশের সংবেদনশীলতাকে ভারত কতটা সম্মান করে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।

অর্থনৈতিক প্রত্যাশা এবং সম্পর্ক

ভারত বিরোধী মনোভাব নির্ধারণ ও প্রচারে অর্থনীতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক আয়তন অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিবেশী দেশগুলির মনে ভারতের তরফে সৌহার্দ্যের আশা জাগিয়েছে। ফলে সকলে আশা করে যে, ভারত সংযোগ ব্যবস্থা, মুক্ত বাণিজ্যে উৎসাহ জোগাবে এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধিনিষেধও শিথিল করবে। কিন্তু অর্থনৈতিক সমন্বয় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার সাম্প্রতিক উন্নতি সত্ত্বেও আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ এখনও খুবই কম। একই রকম পণ্যের উৎপাদন ও রফতানি, প্যারা-ট্যারিফ, সুরক্ষাবাদী নীতি, উচ্চ পরিবহণ খরচ, অসংগঠিত বাণিজ্য এবং শুল্কহীন সীমানার মতো বিষয়গুলির জন্য বাণিজ্যের পরিমাণ আগামী দিনেও কমই থাকবে।

সমস্ত দ্বিপাক্ষিক এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের মোট মূল্য মাত্র ৩৬০০ কোটি মার্কিন ডলার।

স্পষ্টতই সমস্ত দ্বিপাক্ষিক এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের মোট মূল্য মাত্র ৩৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই যে, ভারতের সুবিধার্থে এই বাণিজ্যিক লোকসান তার প্রতিবেশী দেশগুলিকে আরও হতাশ করেছে এমন এক সময়ে যখন তারা ভারতের কাছে আরও বেশি সৌজন্য আশা করে (সারণি ১ দেখুন)। এর ফলে একটি মামুলি বাণিজ্য শক্তি এবং একটি শোষণকারী দেশ হিসেবে ভারত পরিচিত হয়েছে।

এই বাণিজ্য ঘাটতি ছোট প্রতিবেশী দেশগুলির ভৌগোলিক অসুবিধা, পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এবং বাণিজ্য প্রসারের অক্ষমতাকেও চিহ্নিত করে। ফল স্বরূপ বলা যায়, চিনের সঙ্গেও অনুরূপ ঘাটতি লক্ষ করা গেছে (সারণি ১ দেখুন)। কিন্তু চিন বিরোধী মনোভাবের অনুপস্থিতি দর্শায় যে, পূর্ব বিদ্যমান সংশয়বাদ, ঐতিহাসিক মতপার্থক্য এবং ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলি এই বিরোধী মনোভাব এবং ধারণা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। 

সারণি ১: ২০২০-২০২১ সালে ভারত ও চিনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি 

দেশ

ভারতের রফতানি

(মার্কিন বিলিয়ন ডলার)

ভারতের আমদানি

(মার্কিন বিলিয়ন ডলার)

চিনের রফতানি

(মার্কিন বিলিয়ন ডলার)

চিনে আমদানি

(মার্কিন বিলিয়ন ডলার)

বাংলাদেশ ৯.০৮ ১.০৬ ১১.৪৯ ০.৬০
নেপাল ৬.৭৬ ০.৬৬৯ ১.৯৫ ০.০০৮
শ্রীলঙ্কা ৩.৪৯ ০.৬৪২ ৩.৫৭ ০.২২৩
মলদ্বীপ ০.১৯৫ ০.০২৪ ০.৩৩৮ ০.০৩০

সূত্র: প্রতিবেদকের সংগ্রহ

অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের প্রচার

অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের প্রচার প্রতিবেশী অঞ্চলে ভারত বিরোধী মনোভাবের পালে হাওয়া দিয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক স্বার্থ, সমস্যা সমাধানে তার ব্যর্থতা এবং অঞ্চলটির অর্থনৈতিক ক্ষোভ এমন এক শূন্যতার জন্ম দিয়েছে যেটি অভিজাত সম্প্রদায় দ্বারা তাদের অভ্যন্তরীণ এবং নির্বাচনী সুবিধার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কর্তৃত্ববাদী ও এককেন্দ্রিক শাসনের সময়ও ভারত বিরোধী মনোভাব বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ক্ষমতার বহুমুখীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণ এই গণতান্ত্রিক অভিজাতদের ভারতকে জনমানসে একটি আশঙ্কার কারণ হিসেবে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে — এই সমস্যাটি মূলত অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত ছিল। এই ভাবে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব ভারতীয় বিনিয়োগ, উন্নয়ন প্রকল্প এবং অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার কাজগুলির রাজনীতিকরণে সাহায্য করেছে। এবং মলদ্বীপ ও নেপালের মতো প্রতিবেশী অঞ্চলে গণতন্ত্রের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যাগুলিও প্রকট হয়ে উঠেছে।

অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে এই অঞ্চলটিতে ভারতের পছন্দের লোকজন ছিল। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের প্রসার এই সব অভিজাতকে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের দেশকে রক্ষাকারী শক্তিশালী নেতা হয়ে উঠতে বাধ্য করেছে। এই সব দেশ জাতীয়তাবাদের প্রচারের জন্য প্রায়শই অন্য দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে, এমনকি সেটা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিনিময়েও।

সর্বোপরি অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে এই অঞ্চলটিতে ভারতের পছন্দের নেতৃত্ব ছিল। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের প্রসার এই সব অভিজাতকে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের দেশকে রক্ষাকারী শক্তিশালী নেতা হয়ে উঠতে বাধ্য করেছে। এই সব দেশ জাতীয়তাবাদের প্রচারের জন্য প্রায়শই অন্য দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে, এমনকি সেটা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিনিময়েও। এর ফলে আরও বেশি করে ভারত বিরোধী মনোভাব এবং মন্তব্য তৈরি হয়।

এটা খুবই আশ্চর্যের যে, প্রতিবেশী অঞ্চলে গণতন্ত্রের প্রচারের জন্য ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এক বিদ্বেষময় এবং প্রতিযোগিতামূলক প্রবাহ রূপে ভারতের বিরুদ্ধেই ধেয়ে এসেছে।

উপসংহার

ভারত বিরোধী মনোভাব এবং আবেগ প্রতিবেশী কৌশল এবং নীতিনির্ধারণে ভারতের দক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এই দুই পর্বের প্রতিবেদন সিরিজের মূল লক্ষ্য হল প্রতিবেশে ভারত বিরোধী মনোভাব ও আবেগের নেপথ্যে থাকা কারণগুলিকে খুঁজে বার করা। এই সিরিজটিতে ইতিহাস এবং আত্মপরিচয়, ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক স্বার্থ, অমীমাংসিত সমস্যা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রতিবেশী অঞ্চলে ভারত যে সমস্যাগুলির সম্মুখীন, সেগুলিকে ভারত স্বীকার করেছে এবং আগামিদিনে তারা এর পুনর্মূল্যায়নের পথে হাঁটতে চলেছে। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপরে জোর দেওয়া এবং একটি স্থিতিশীল ও সারবত্তাপূর্ণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতের প্রতিবেশী নীতিকে আকার দিয়েছে। কোভিড-১৯ সংকটের সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলিকে করা নয়াদিল্লির সহায়তা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অপরিহার্য ভূমিকাকে আরও জোরদার করেছে। কাঠামোগত সমস্যার জন্য অদূর ভবিষ্যতেও এই অঞ্চলে ভারত বিরোধী মনোভাব কমবে না। কিন্তু ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা যদি এই আবেগের মূল শিকড়কে চিনতে পারেন, তা হলে তাঁরা তাঁদের নীতিগত প্রতিক্রিয়াকে আরও ভাল ভাবে রূপ দিতে সক্ষম হবেন।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.