Image Source: Getty
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বিরোধী মনোভাবের মূল্যায়ন (প্রথম পর্ব)
ভারত বিরোধী ধারণা ও আবেগ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি দীর্ঘস্থায়ী ঘটনা। জানুয়ারির শুরুতে মলদ্বীপে ‘ইন্ডিয়া আউট’ অভিযানের পুনরুজ্জীবন এই নিরবচ্ছিন্ন সমস্যাটিকে দর্শায়।
ভুটান এবং আফগানিস্তান চিন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত বিরোধিতার কারণে ভারতের প্রতি একটি ইতিবাচক মনোভাব বজায় রেখে চললেও তা নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং মলদ্বীপের ক্ষেত্রে সত্য নয়। এই দেশগুলির অনেক অংশের মানুষ এবং রাজনীতিবিদরাই ভারতকে শত্রুতা, বিশ্বাসহীনতা এবং সন্দেহের চোখে দেখে। তাই একটি দক্ষ প্রতিবেশী কৌশল এবং নীতি গঠনের স্বার্থে এই ভারত বিরোধী মনোভাবগুলির মূল কারণগুলির মূল্যায়ন এবং মোকাবিলা করা জরুরি।
এই দুই পর্বের প্রতিবেদন সিরিজের মূল লক্ষ্য হল প্রতিবেশে ভারত বিরোধী মনোভাবের সূত্রপাত ও প্রচারের নেপথ্যে থাকা কারণগুলিকে খুঁজে বের করা। প্রথম পর্বে আলোকপাত করা হয়েছে ভারতের ইতিহাস গঠন এবং পরিচিতি নির্মাণের পাশাপাশি তার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক স্বার্থের উপরে। দ্বিতীয় পর্বে অমীমাংসিত সমস্যা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং এই ভারত-বিরোধী মনোভাব পোষণে গণতন্ত্রের প্রচারের ভূমিকা মূল্যায়ন করা হয়েছে।
ইতিহাস এবং পরিচিতি নির্মাণ
দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান আন্তর্দেশীয় সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গি এখনও ইতিহাস দ্বারাই প্রভাবিত। যদিও চিন এই উপমহাদেশে অপেক্ষাকৃত ভাবে একটি নতুন শক্তি, স্বাধীন পাকিস্তান ইতিমধ্যেই ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং নতুন পরিচয় গঠনের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু অন্য দিকে স্বাধীন ভারত মূলত তার সভ্যতাগত ইতিহাস এবং জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈচিত্র্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার পরিচয় ও দেশ গঠনের পথে এগিয়েছে।
বাংলাদেশে হিন্দু জমিদারদের এবং ১৯০৫ ও ১৯৪৭ সালের দেশভাগের স্মৃতি এখনও ভারতের বিরুদ্ধে সংশয়ের বীজ বপন করে চলেছে।
এই বৈচিত্র্যময় অঞ্চল এবং জাতিসত্তাগুলির তাদের প্রতিবেশী দেশ এবং রাজ্যপাটগুলির সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল। এবং এই পারস্পরিক সম্পর্ক ছোট দেশগুলিকে স্বাধীন ভারত সম্পর্কে তাদের ধারণাকে রূপ দিতে সাহায্য করেছে। যদিও অতীতের সম্পর্কগুলি সব সময় আগ্রাসী ছিল না, তবুও বেশ কিছু নেতিবাচক ঘটনা এবং সম্পর্ক সকলের স্মৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে। ভারত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকেই এই সব দেশের অভিজাত সম্প্রদায় এবং সাধারণ জনগণ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য এবং পরিচয় সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়েছে।
ফলে শ্রীলঙ্কা এবং মলদ্বীপ দুই দেশই এখনও ভারতকে চোল আক্রমণের দিন থেকে মনে রেখেছে। বাংলাদেশে হিন্দু জমিদারদের এবং ১৯০৫ ও ১৯৪৭ সালের দেশভাগের স্মৃতি এখনও ভারতের বিরুদ্ধে সংশয়ের বীজ বপন করে চলেছে। একই ভাবে একটি অ-ঔপনিবেশিক রাজ্য হওয়ার সুবাদে এবং লুম্বিনীর উপর এক্তিয়ার থাকার ফলে ভারতের প্রেক্ষিতে নেপালের পরিচয় গড়ে উঠেছে। এই ব্যাপক পার্থক্যের নেপথ্যে ধর্মেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মলদ্বীপ এবং বাংলাদেশের কিছু অংশ এখনও স্বাধীন ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবেই মনে করে, যেখানে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে অবজ্ঞা করা হয়। এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও ভারতকে বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তামিল নীতি এই ধারণাকে আরও জোরালো করে তুলেছে।
ইতিহাস এবং পরিচিতি নির্মাণের নেপথ্যের এই কারণগুলি এ ভাবে ভারতের বিরুদ্ধে সংশয়বাদের প্রাথমিক বীজ বপন করেছে। এবং এই ঘটনাটি ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই চলে আসছে।
অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা
ঐতিহাসিক এবং সভ্যতাগত সম্পর্ক জুড়ে ভারত তার বর্তমান সময়ের প্রতিবেশীদের সঙ্গে জাতিগত এবং ধর্মীয় প্রসার ঘটিয়েছে, যেমন নেপালের মদেশি, শ্রীলঙ্কায় তামিল এবং বাংলাদেশের হিন্দুরা। এটি একটি নীতিগত ধারণাকে রূপ দিতে সাহায্য করেছে যেখানে ভারতের নিরাপত্তা এবং শান্তি একটি সর্বাঙ্গীন, স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত।
কিন্তু এই জাতিগত বা ধর্মীয় প্রসার সব সময় অন্যরা ইতিবাচক ভাবে দেখেনি। শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং বাংলাদেশের অভিজাত ও উগ্রপন্থী সম্প্রদায়গুলি দ্বারা যথাক্রমে তামিল, মদেশি এবং হিন্দুদের বহিরাগত হিসেবে দেখা হয়। স্পষ্টতই যখন নিজের সহ-জাতিগত এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, ভারত এই দেশগুলিতে প্রতিবাদ জানিয়েছে, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এমনকি হস্তক্ষেপও করেছে।
ঐতিহাসিক এবং সভ্যতাগত সম্পর্ক জুড়ে ভারত তার বর্তমান সময়ের প্রতিবেশীদের সঙ্গে জাতিগত এবং ধর্মীয় প্রসার ঘটিয়েছে, যেমন নেপালের মদেশি, শ্রীলঙ্কায় তামিল এবং বাংলাদেশের হিন্দুরা। এটি একটি নীতিগত ধারণাকে রূপ দিতে সাহায্য করেছে যেখানে ভারতের নিরাপত্তা এবং শান্তি একটি সর্বাঙ্গীন, স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ১৯৮০-এর দশকে ভারত শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করেছিল এবং তামিল-সিংহল সংঘর্ষের অবসান ঘটাতে নিজেদের বাহিনী মোতায়েন করেছিল। এটি ১৩তম সংশোধনী এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তামিলদের পুনর্মিলনের বিষয়গুলিতে এখনও জোর দিচ্ছে। নেপালে ভারত মদেশিদের জন্য একটি সর্বাঙ্গীন গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর প্রচারে জোর দিয়েছে এবং শোনা যায়, তার অভিজাতরা তা করতে ব্যর্থ হলে একটি অবরোধে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপরে সংখ্যাগরিষ্ঠদের হামলার বিরুদ্ধে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এই সব পদক্ষেপের ফলে কিছু নেতিবাচক ধারণারও জন্ম হয়েছে। ভারতের কার্যকলাপ এবং অভিযোগগুলিকে প্রতিবেশী দেশগুলির সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপকারী একটি বড় দেশের কার্যকলাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে এমনটাও মনে করা হয় যে, ভারত নিজের প্রতিবেশী অঞ্চলের বিশেষ কয়েকটি দেশকে অগ্রাধিকার দেয় এবং সেই সব রাজনৈতিক দল বা অভিজাত সম্প্রদায়কে সমর্থন জোগায় যারা ভারতের স্বার্থে কথা বলে। এই ধারণাগুলি ভারতের বিরুদ্ধে ছোট দেশগুলির সংশয়কে তীব্র করে তুলেছে।
ভূ–রাজনীতি এবং কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা
ভারতের কৌশলগত পদক্ষেপ এবং এ ক্ষেত্রে বাইরের শক্তিগুলির ক্রমাগত জড়িয়ে পড়াও ভারত বিরোধী মনোভাবকে উস্কে দিতে সাহায্য করেছে। প্রথাগত ভাবে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলিকে নিরাপত্তাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখেছে এবং দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরকে তার প্রভাবের ক্ষেত্র এবং প্রতিরক্ষার প্রথম পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করেছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে নিজেদের শক্তি সমীকরণ বজায় রাখার জন্য ভারত একাধিক প্রণোদনা ও বলপূর্বক কৌশল গ্রহণের মতো কাজ করেছে যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট, পারস্পরিক চুক্তি স্বাক্ষর এবং অর্থনৈতিক অবরোধ। এর ফলে এক দিকে পাকিস্তান এবং চিন সংক্রান্ত ঝুঁকি প্রশমনে এবং ভারত তার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সমর্থ হলেও, অন্য দিকে অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিবেশী দেশগুলির অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতিতে হস্তক্ষেপকারী দেশ হিসেবে ভারতের একটি প্রতিমূর্তি গড়ে উঠেছে।
কিন্তু চিনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিও তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বি আর আই) এবং পরিকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ থেকে অর্থনৈতিক লাভ তোলার আশা রাখছে। এই সব কর্মসূচির বিরোধিতা করে তার স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পাশাপাশি ভারত প্রতিবেশী দেশগুলিকে তার সংবেদনশীলতা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। এর ফলে বেশ কয়েকটি স্তরে ভারতের বিরুদ্ধে এই ধারণা গড়ে উঠেছে যে, সে সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করলেও তার দেওয়ার মতো বিশেষ কিছু নেই।
এই সব কর্মসূচির বিরোধিতা করে তার স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পাশাপাশি ভারত প্রতিবেশী দেশগুলিকে তার সংবেদনশীলতা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে।
এর পাশাপাশি পাকিস্তান এবং চিনও ছোট দেশগুলির বেশ কিছু অংশকে ভারত বিরোধী বিক্ষোভ এবং আবেগকে বাড়িয়ে তুলতে ব্যবহার করেছে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠীগুলি আদর্শগত সুবিধা অথবা আর্থিক ও রাজনৈতিক লাভের আশায় এমনটা করে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনের মধ্যে শক্তিশালী আদর্শগত সম্পর্ক রয়েছে। যেমন হেফাজত-এ-ইসলাম এবং জামাত-এ-ইসলামি। এমনটাও অভিযোগ উঠেছে যে, বাংলাদেশে মোদী বিরোধী বিক্ষোভ পরিচালনার জন্য এই সংগঠনগুলিকে পাকিস্তান অর্থ সাহায্য করেছে।
একই রকম ভাবে মলদ্বীপের ইয়ামিন এবং নেপালের কে পি ওলির মতো কিছু নেতা চিন দ্বারা সমর্থিত হয়ে তাদের ভারত-বিরোধী নির্বাচনী ভিত্তি, বাগাড়ম্বর এবং নীতিগুলিকে উৎসাহ জুগিয়েছে। আর্থিক উদ্যোগগুলিও এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ ওলি এবং ইয়ামিন উভয়ের বিরুদ্ধেই চৈনিক সংস্থা এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লেনদেনের সময় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চিন এমনকি মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনকে ব্যবহার করে এক জন নিরাপত্তাপ্রদানকারী রূপে ভারতের ভূমিকাকে সমস্যার মুখে ফেলার চেষ্টা করেছে। ২০১৭ সালে ডোকলামে উত্তেজনা তীব্র হলে ইয়ামিন মলদ্বীপে ভারতীয় টহল জাহাজ, বিমান এবং কর্মীদের মোতায়েনের রাজনীতিকরণের মাধ্যমে নতুন উদ্যমে ভারত-বিরোধী প্রচার শুরু করেছিলেন। এই কারণ দিয়েই ইয়ামিন মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই ‘ইন্ডিয়া আউট’ বিক্ষোভের গতিশীলতা বৃদ্ধিকে ব্যাখ্যা করা যায়।
ফলে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য ভারতের প্রচেষ্টা এবং প্রতিবেশী অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা এবং প্রভাব এই ভারত-বিরোধী মনোভাবকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
দ্বিতীয় পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.