অতিমারি–উত্তর যুগে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা
দেশ ধীরে ধীরে অতিমারি থেকে বেরিয়ে আসছে, এবং অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার অপেক্ষায় রয়েছে; আর এই সময় সরকারের তরফ থেকে নতুন উদ্দীপনার সঙ্গে পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি চালু হওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চাভিলাষী নীতি কর্মসূচি ‘গতিশক্তি’ — একটি মাল্টিমোডাল সংযোগের জন্য জাতীয় মাস্টার প্ল্যান — পরিকাঠামো উন্নয়নে বর্ধিত মনোযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই উন্নয়ন পরিকল্পনায় ভারতমালা, সাগরমালা, উড়ান ও অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রকল্প সহ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এমন বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্পগুলিকে একত্র করা হয়েছে যেগুলি শিল্প ক্লাস্টার ও পরিকাঠামো করিডোরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ‘গতিশক্তি’ প্রবর্তনের পরে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তাঁর ২০২২–২৩ বাজেট ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন যে ২০২২ ও ২০২৩ সালের মধ্যে বিধ্বস্ত ভারতীয় অর্থনীতিকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি বিনিয়োগ ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে আকর্ষিত করবে।
প্রথম দিকটি হল নিয়ামক ও আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলি, যা দীর্ঘকাল ধরে ভারতে পরিকাঠামো উন্নয়ন বাস্তুতন্ত্রকে ঘিরে ধরেছে এবং দেশের বেশ কয়েকটি বড় মাপের পরিকাঠামো প্রকল্পকে বিলম্বিত এবং/অথবা ব্যাহত করেছে।
ভারতীয় পরিকাঠামো ক্ষেত্রের জন্য ‘গতিশক্তি’র সূচনা এবং ভারতীয় অর্থনীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য আরও জায়গা তৈরি করার জন্য বাজেট–ঘোষণা স্বাগত পদক্ষেপ। এই দুই উদ্যোগ ভারতের পরিকাঠামো ক্ষেত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কিছু দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধানে প্রয়াসী হয়েছে, এবং ভারতে পরিকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বার করতে ভবিষ্যতের রোডম্যাপ তৈরি করছে। এই লক্ষ্য মাথায় রেখে এই নিবন্ধে দুটি মূল দৃষ্টিকোণ থেকে পরিকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থায়নের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম দিকটি হল নিয়ামক ও আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলি, যা দীর্ঘকাল ধরে ভারতে পরিকাঠামো উন্নয়ন বাস্তুতন্ত্রকে ঘিরে ধরেছে এবং দেশের বেশ কয়েকটি বড় মাপের পরিকাঠামো প্রকল্পকে বিলম্বিত এবং/অথবা ব্যাহত করেছে। উদ্বেগের দ্বিতীয় জায়গাটি ভারতে পরিকাঠামোতে বিনিয়োগের সমস্যাগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত, বিশেষত উন্নত দেশগুলির তুলনায় দেশের পরিকাঠামোতে বেসরকারি বিনিয়োগের তুলনামূলকভাবে নিম্ন স্তরের বিষয়টি। ভারতে অন্যান্য কিছু মধ্যম আয়ের দেশগুলির অনুরূপ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতিপথ রয়েছে৷ নিবন্ধটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট পরিকাঠামো উন্নয়নের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ এবং অতিমারি পরিস্থিতি দ্বারা চিহ্নিত সামাজিক পরিকাঠামোতে নতুন করে আগ্রহের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। যাই হোক, এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করার আগে কেন পরিকাঠামোগত উন্নয়ন দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির অবিচ্ছেদ্য অংশ সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া প্রাসঙ্গিক।
নীতি আয়োগের সি ই ও অমিতাভ কান্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে, পরিকাঠামো ব্যয় সমগ্র অর্থনীতিতে একটি গুণক প্রভাব ফেলে। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে পরিকাঠামো প্রকল্পগুলি শ্রম ও নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা বাড়ায়, এবং সেই সঙ্গেই বৃহত্তর সংযোগ এবং পণ্য ও মানুষের চলাচল উন্নত করে অর্থনীতিতে দ্বিতীয় স্তরীয় প্রভাব ফেলে। অর্থনীতির পাণ্ডিত্যপূর্ণ সাহিত্যও এই অবস্থানকে সমর্থন করে। গুণক প্রভাব অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের তুলনায় অর্থনৈতিক সংকোচনের সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বড় হয়। সামগ্রিকভাবে, পরিকাঠামোতে সরকারি বিনিয়োগ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রেরণা জোগায়।
বিভিন্ন মন্ত্রক এবং অগণিত প্রশাসনিক নির্দেশিকাগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব হল অন্য একটি কারণ যা প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে তোলে।
যা প্রায়শই বিভিন্ন রাজ্য বা জেলার সীমানা পেরিয়ে বিস্তৃত হয় তেমন যে কোনও পরিকাঠামো প্রকল্প নির্মাণের জন্য, তা আবাসনে জল সরবরাহ হোক বা রাস্তা ও মহাসড়কের মতো বড় আকারের পরিকাঠামো প্রকল্পই হোক, কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও স্থানীয় স্তরে ছাড়পত্র এবং অনুমোদনের প্রয়োজন হয়৷ বিভিন্ন মন্ত্রক এবং অগণিত প্রশাসনিক নির্দেশিকাগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব হল অন্য একটি কারণ যা প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে তোলে। ভারতীয় রাষ্ট্র জুড়ে বিভিন্ন মন্ত্রক এবং রাজ্য থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পাওয়ার সময় গড়ে ১৮ মাস থেকে শুরু করে চার–পাঁচ বছর পর্যন্ত হতে পারে। এই ধরনের পদ্ধতিগত বাধাগুলি প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং সমাপ্তিতে বিলম্ব ঘটায়, যা প্রায়ই বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানোর কারণ হয়ে ওঠে।
দীর্ঘ বিরোধ–নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের দুর্ভোগ আরও বাড়ায়। পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাঁটোয়ারা এবং পরিষেবার বিধানের বিষয়ে অস্পষ্টতা প্রায়শই চুক্তিটিকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যায়, যা অন্যান্য পরিকাঠামো প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনেক প্রকল্প অর্ধসমাপ্ত রেখে দেওয়ার বা রূপায়ণের সময় দীর্ঘায়িত করার কারণ হয়। এই ঘাটতি মোকাবিলা করার জন্য ‘গতিশক্তি’ মাস্টার প্ল্যানের লক্ষ্য হল রেল, বিমান, ইলেকট্রনিক্স ও টেলিযোগাযোগ, শিপিং, সড়ক পরিবহণ, বস্ত্রবয়ন এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্রগুলি সহ সমস্ত পরিকাঠামো প্রকল্পের সঙ্গে ১৬টি সরকারি মন্ত্রকের সমন্বয় সাধন করা। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য প্রযুক্তিভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের মধ্যে রিয়েল টাইম সমন্বয় নিশ্চিত করা এবং আন্তঃক্ষেত্রীয় প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের (উদাহরণস্বরূপ, একযোগে বন্দর, রেলপথ ও মহাসড়কগুলিকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা) জন্য আহ্বান জানানো।
প্রশাসনিক এবং নিয়ামক বাধা ছাড়াও বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ হল পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রশ্নে একটি প্রয়োজনীয়তা এবং উদ্বেগের বিষয়। পরিকাঠামো সুবিধার জন্য ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু সরকারি বিনিয়োগ এই সুবিধাগুলির অর্থায়নের জন্য যথেষ্ট হবে না।
জলবায়ু পরিবর্তন কম–কার্বন পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির স্থাপনাকে গতি দিয়েছে। এই লেখার সময় পর্যন্ত ভারত শক্তির মতো ক্ষেত্রগুলিতে ইতিমধ্যেই প্রায় ১৯৬.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের প্রকল্প তৈরি করতে শুরু করে দিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে৷
তার উপর আবার বড় মাপের পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির জন্য খুব বেশি প্রাথমিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য আয় বা লাভ কম হয়। তাই, কর রাজস্ব এই ধরনের প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য অপ্রতুল উৎস। আমরা যদি শুধু শহুরে কেন্দ্রগুলি বিবেচনা করি, তাহলে দেখব রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব নগরায়ণ সম্ভাবনা ২০১৮ এই অনুমান করে যে ভারতের শহুরে জনসংখ্যা ২০১৮ এবং ২০৫০-এর মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে ৪৬১ থেকে বেড়ে ৮৭৭ মিলিয়নে পৌঁছে যাবে। এই ধরনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অত্যাবশ্যক এবং কম-জরুরি পরিকাঠামো সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। অধিকন্তু, কোভিড–১৯ অতিমারি সামাজিক পরিকাঠামো, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনগুলি তুলে ধরেছে। একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন কম–কার্বন পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির স্থাপনাকে গতি দিয়েছে। এই লেখার সময় পর্যন্ত ভারত শক্তির মতো ক্ষেত্রগুলিতে ইতিমধ্যেই প্রায় ১৯৬.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের প্রকল্প তৈরি করতে শুরু করে দিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে৷ এছাড়াও, সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্র মিলিয়ে প্রায় ৩০০টি ইউটিলিটি–স্কেল পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প পাইপলাইনে রয়েছে। অতএব, পরিকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য প্রচুর সুযোগ রয়েছে।
সাধ্যায়ত্ত্ব স্বাস্থ্যসেবা, গ্রামীণ জনসেবা বা পরিকাঠামোগত সুবিধার মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিকাঠামো প্রকল্পগুলি, যেখানে বিনিয়োগের আয় অত্যন্ত কম, সেগুলি বাদ দিয়ে অন্যান্য পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ সংগঠিত করা যেতে পারে। একটি উপযুক্ত বাজার পরিবেশের অভাব এবং সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিকে প্রভাবিত করে এমন নিয়ন্ত্রক সীমাবদ্ধতা ভারতে বেসরকারি ক্ষেত্রের বিনিয়োগের গতিপথকে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে ২০০৮ ও ২০১৮–র মধ্যে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ ২০০৮ সালের ৩৭ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়ে ২০১৮ সালে ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷ ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে নন–পারফর্মিং সম্পদের সংকট এই পতনের একটি প্রাথমিক কারণ ছিল৷ ব্যাঙ্কিং শিল্প ছাড়াও নিয়ন্ত্রণ আরোপকারী সরকারি নিয়মগুলি বিমা শিল্প এবং পেনশন তহবিল থেকে বিনিয়োগকে বাধা দেয়, যা অন্যথায় পরিকাঠামোতে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সরবরাহ করতে পারে। পরিশেষে, পরিকাঠামোতে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারি বৃদ্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট এবং লক্ষ্যভিত্তিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে। এখানে স্পেশাল পারপাস ভেহিকল বা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং–এর মতো উপকরণগুলি সহায়ক হতে পারে, কারণ সেগুলি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ঝুঁকি হ্রাস করতে সরকারি বিনিয়োগ থেকে প্রকল্পের তহবিলের একটা অংশ সংগ্রহ করে এবং বাকিটা বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে।
ব্যাঙ্কিং শিল্প ছাড়াও নিয়ন্ত্রণ আরোপকারী সরকারি নিয়মগুলি বিমা শিল্প এবং পেনশন তহবিল থেকে বিনিয়োগকে বাধা দেয়, যা অন্যথায় পরিকাঠামোতে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সরবরাহ করতে পারে।
এমন সময়ে যখন ভারত ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার জন্য প্রস্তুত, এবং তা ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে (শক্তি, পরিবহণ, লজিস্টিকস, ইত্যাদি) পরিকাঠামোগত সুবিধার ঊর্ধ্বগতি প্রত্যক্ষ করছে, তখন অতিমারি–প্রভাবিত অর্থনীতিকে গতিশীল করতে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রের পরিকাঠামো বিনিয়োগ অপরিহার্য। নিয়ামক ব্যবস্থায় প্রগতিশীল পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের আস্থা যথেষ্ট পরিমাণে বাড়াবে ঠিকই, কিন্তু বিনিয়োগ পোর্টফোলিও, বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ এই সময়ের জরুরি প্রয়োজন। গতিশক্তি, জাতীয় পরিকাঠামো পাইপলাইন এবং সম্পদ নগদীকরণ পরিকল্পনার মতো সাম্প্রতিক নীতিগত কিছু ব্যবস্থা উপরে উল্লিখিত কিছু উদ্বেগের সমাধান করে। যাই হোক, লক্ষ্যভিত্তিক নীতিগুলি—যা নির্দিষ্ট পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির প্রয়োজন এবং বাজারে উপলব্ধ সম্ভাব্য বিনিয়োগ ক্ষেত্রগুলির মধ্যে ব্যবধান পূরণ করে—এই ক্ষেত্রের আসন্ন সুযোগগুলি ব্যবহার করার চাবিকাঠি হবে৷
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.