Author : John C. Hulsman

Published on Aug 15, 2021 Updated 0 Hours ago

শি’র দৃষ্টিকোণ থেকে চিনের সামনে থাকা বিকল্পগুলি বিচার করলে আর কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছন যায় না। আশু ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকাই হবে আমাদের একমাত্র পথ।

এ যুগের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সিদ্ধান্তটি নিতে চলেছেন শি জিনপিং

ভূমিকাঃ সাম্রাজ্যবাদী জাপানের ধ্বংসাত্মক কৌশলী চাল

বিষয়টা নিয়ে আর দেরি করার কোনও সুযোগ ছিল না; ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে সাম্রাজ্যবাদী জাপানের সেনা-প্রভুত্বাধীন সরকার কৌশলগত দিক থেকে একটা বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। চিনে জাপানের ধারাবাহিক আগ্রাসনে ক্ষুব্ধ পশ্চিমী শক্তিগুলি (আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস) টোকিওর জঙ্গিপনা অংকুরেই বিনাশ করতে জাপানকে তেল সরবরাহে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জাপানের জ্বালানি চাহিদার ৯০ শতাংশই সেই সময় এই তিনটি দেশ সরবরাহ করত। তাই দেশে তেলের সঞ্চয় থাকলেও জাপানি হাইকমান্ড বুঝতে পেরেছিল, এই নিষেধাজ্ঞা এক মারাত্মক আর্থিক বিপর্যয় হয়ে উঠতে চলেছে। চিনে তাদের অভিযান (যার জন্য জাপান সরকার সর্বস্ব পণ করেছিল) থামিয়ে দিয়ে অত্যন্ত লজ্জাকর ভাবে মাথা নিচু করে ফিরে না এলে টোকিওর অর্থনীতি খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়বে। কৌশলগত দিক থেকে তাই দ্রুত তাদের একটা চূড়ান্ত পথ বেছে নিতেই হবে।

তেল নিয়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় অস্তিত্বগত ভাবে বিপন্ন সমরবাদী টোকিওর সামনে তিনটি পথ খোলা ছিলঃ আরও তেড়েফুঁড়ে লড়াই করে পুরো চিন দেশটাই দখল করা এবং তার সম্পদের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা; সম্পদে সমৃদ্ধ এবং প্রায় প্রতিরক্ষাহীন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ (আজকের ইন্দোনেশিয়া) আক্রমণ করা, বা পার্ল হারবারে শক্তিশালী মার্কিন নৌবহরকে নিশ্চিহ্ন করে সার্বিক ভাবে প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার প্রতিপত্তি নষ্ট করা। সবারই জানা, জাপান বিপজ্জনক ভাবে তৃতীয় বিকল্পটিই বেছে নিয়ে সরাসরি নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল।

১৯৪০-এর দশকের গোড়ায় সাম্রাজ্যবাদী জাপানের যে অবস্থা হয়েছিল, আজকের চিন ঠিক সেই রকম এক কৌশলগত বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। শি জিনপিং-এর চিনা কমিউনিস্ট পার্টি চাপে রয়েছে—তবে এই পরিস্থিতির পিছনে অন্য অনেক কিছুর থেকে বড় হয়ে উঠেছে অনড় অটল ভৌগোলিক শক্তি। ইন্দোপ্যাসিফিক এলাকায় প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য বেজিং-এর প্রধান বাধা তার ভৌগোলিক অবস্থান। ঘিরে থাকা প্রথম সারির দ্বীপমালা (ফার্স্ট আইল্যান্ড চেন) তাকে যেন বোতলবন্দি করে স্তিমিত করে রেখেছে। তাইওয়ান থেকে শুরু করে জাপান এবং ফিলিপিন্স হয়ে দক্ষিণে এই দ্বীপমালা মালাক্কা প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত (ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াকে ঘিরে)। চিনের যাবতীয় বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্ভাবনা সর্বদাই বিপন্নতার মুখে—উত্তরে তাইওয়ান প্রণালীতে আমেরিকা ও জাপান, আর দক্ষিণে আমেরিকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারত যখন তখন অবরোধ সৃষ্টি করতে পারে।

ফার্স্ট আইল্যান্ড চেনের প্রধান রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা মার্কিন নেতৃত্বাধীন চিন-বিরোধী জোটের হাতে ভূ-কৌশলগত ভাবে নৌশক্তি ও বাণিজ্যিক স্বার্থের এই বন্দিদশা থেকে চিন বেরিয়ে আসতে চাইছে। আর এরই ফলে এই অঞ্চলে তৈরি হয়েছে ঘনিয়ে ওঠা চিন-মার্কিন ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রধান কৌশলগত ক্ষেত্র। এটা না করলে চিনের পক্ষে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চল থেকে পূর্ব এশিয়ায় কর্তৃত্ব স্থাপন এবং প্রভাবশালী বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠা একেবারেই অসম্ভব।

সাম্রাজ্যবাদী জাপানের মতোই শি’র চিনের সামনে এখন তিনটি বিস্তারিত কৌশলগত বিকল্প রয়েছে। প্রথমত, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বি আর আই) স্থলপথ; দ্বিতীয়ত, দক্ষিণের পথ (মালাক্কা প্রণালী), এবং তৃতীয়ত, উত্তরের পথ (তাইওয়ান প্রণালী)। কৌশলগত দিক থেকে শি কোন পথ বেছে নেবেন তা যতটা তাৎপর্যপূর্ণ, ততটাই কম আলোচিত। তাঁর চোখে এই তিনটি চাল কেমন দেখায় সেটা এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।

বি আর আই স্থলপথ

বি আর আই শি’র কার্যকালের এক জবরদস্ত (অন্তত কাগজে-কলমে) ভূ-অর্থনৈতিক স্তম্ভ। বিপুল উদবৃত্ত মূ্লধন ও নবার্জিত বৃহৎ আর্থিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে চিন বি আর আই-কে তাদের অর্থে নির্মিত রেল, সড়ক, বন্দর ও জ্বালানি পাইপলাইনের এক বিশাল জালে পরিণত করেছে।

১৩৯টির মতো বিপুল সংখ্যক দেশ কোনও না কোনও ভাবে বি আর আই অনুমোদন করেছে (এর মধ্যে ইতালি, পর্তুগাল এবং নিউজিল্যান্ডের মতো পশ্চিমী মার্কিনপন্থী দেশও আছে)। রেশম পথ বা সিল্ক রুট বরাবর এই স্থলপথ তৈরিকে বিপুল ভাবে সফল করে তুলতে পারলে শি আমেরিকা ও তার সহযোগীদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে পারবেন (অপর দুটি কৌশলগত বিকল্পে যা সম্ভব নয়), কারণ তখন ইউরেশিয়ার প্রধান ভূখণ্ডগুলি চিনের অভিভাবকত্বে ভূ-অর্থনৈতিক ভাবে সংযুক্ত হয়ে যাবে। স্থলপথের ভৌগোলিক চরিত্রের জন্যই বি আর আই বিকল্পটি ফার্স্ট আইল্যান্ড চেনকে অর্থহীন করে তুলবে, সঙ্গে সঙ্গে অর্থহীন হয়ে যাবে এখনও প্রবল শক্তিশালী মার্কিন নৌবহর।

কয়েক দশকে সফল ও সুপ্রতিষ্ঠিত হলে বি আর আই এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি ইউরোপেরও বড় অংশে চিনের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরতার এক সুবিস্তৃত জাল গড়ে তুলতে পারবে। ইউরেশিয়ায় বি আর আই-এর অংশীদার অধিকাংশ দেশেই আধুনিক পরিকাঠামোর চাহিদা বিপুল, তাই চিন তাদের প্রলুব্ধ করার জন্য চোখের সামনে প্রয়োজনীয় খুড়োর কলটি সাজিয়ে রেখেছে।

এই বিকল্পটির সমস্যা হল, বি আর আই নিয়ে ঢক্কানিনাদ যত হয়েছে, কাজের কাজ হয়েছে তার থেকে অনেক কম। প্রথমত, বি আর আই প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। যেমন, মালয়েশিয়ায় বি আর আই প্রকল্পের ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি পরিমাণ সরকারি অর্থ নিছক গায়েব হয়ে গেছে।

দ্বিতীয়ত, বি আর আই ‘ঋণের ফাঁদ কূটনীতি’র সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠেছে। কারণ ঋণগ্রহীতা দেশগুলি পরিকাঠামো-ঋণ শোধ করতে না পারায় তাদের যে সব সম্পদ জামানত রাখা ছিল, চিন তা বাজেয়াপ্ত করে নিচ্ছে। এর সব থেকে মারাত্মক নজির হল, ঋণ শোধ করতে না পারায় দরিদ্র শ্রীলঙ্কা তার প্রধান বন্দর হামবানটোটা চিনের হাতে ৯৯ বছরের লিজে তুলে দিয়েছে।

তৃতীয়ত, বি আর আই পথ বরাবর স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার বদলে বেশিরভাগ সময়ই পরিকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্প রূপায়ণে স্থানীয় ইউনিয়ন এবং শ্রম আইনকে পাশ কাটিয়ে চিনা কর্মীদের নিয়ে আসা হচ্ছে। এতে সব মিলিয়ে স্থানীয় মানুষজনও বিরক্ত। ফলে বি আর আই পথ বরাবর স্থানীয় গোষ্ঠীগুলিকে সাহায্য করার বদলে চিনা কর্মীদের চাকরি বজায় রাখার প্রকল্প হিসেবেই আরও বেশি করে  বি আর আই-কে দেখা হচ্ছে।

চতুর্থত, চিনের পক্ষে হাজার হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মত ও পথের নানা সরকারের সঙ্গে কাজ করার রাজনৈতিক ঝুঁকি বিপুল। এই রাজনৈতিক ঝুঁকি ইতালির মতো উন্নত দেশের পক্ষেও সত্যি। সেখানে সরকার বদল হয়েছে, চিন সমর্থক ফাইভ স্টার মুভমেন্টের হাত থেকে ক্ষমতা এসেছে মারিও দ্রাঘির আরও রক্ষণশীল, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সহযোগিতায় বিশ্বাসী (প্রো-আটলান্টিসিস্ট) সরকারের হাতে। ফলে একদা অত্যন্ত আগ্রহী থেকে ইতালি এখন বি আর আই সম্পর্কে রীতিমতো সন্দেহাকুল।

এই সব কারণ মিলিয়ে শি’র ভূ-আর্থনীতিক প্রধান উদ্যোগটির জৌলুস কিছুটা কমেছে। বি আর আই-এর মাধ্যমে ২০২০ সালে চিনের বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭০০ কোটি মার্কিন ডলার—আগের বছরের থেকে এক ধাক্কায় কমেছে ৫৪ শতাংশ। কৌশলগত দিক থেকে বি আর আই বিকল্প শি’র পক্ষে তখনই কার্যকর থাকবে—বিশেষ করে যদি অতিমারি-উত্তর পৃথিবীতে পশ্চিম দুর্বল হয় আর চিন তুলনামূলক ভাবে ভাল ফল করে। কিন্তু এত রকম জলজ্যান্ত সমস্যা থাকায় এই উদ্যোগ বিকল্প পরিকল্পনার স্তরেই থেকে যাবে।

দক্ষিণের পথ (মালাক্কা প্রণালী)

মালাক্কা প্রণালী যেখানে সব থেকে সরু, সেখানে তা মাত্র ২.৭ কিলোমিটার চওড়া। ফলে এ এক স্বাভাবিক বাধা, ভারত মহাসাগর থেকে (আন্দামান সাগর হয়ে) প্রশান্ত মহাসাগর যাওয়ার পথ (দক্ষিণ চিন সমুদ্র হয়ে) বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে আদর্শ। প্রণালীটি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকার দীর্ঘ দিনের সহযোগী সিঙ্গাপুর। বর্তমানে এই প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সহজেই শক্তিশালী  মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে  কাজে লাগানো সম্ভব।

গত দশক ধরে চিন দক্ষিণ চিন সমুদ্রের দ্বীপগুলির সামরিকীকরণ করলেও মালাক্কা প্রণালী এবং তার ভারত মহাসাগরীয় দিকটি শক্তপোক্ত ভাবেই মার্কিন/ ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভারতের নিকোবর দ্বীপমালা এই ভূ-কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থানের অন্যতম চাবিকাঠি। তাইল্যান্ডে ক্রা খাল তৈরির মাধ্যমে মালাক্কা প্রণালীকে এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে চিন কিছু ভাবনাচিন্তা করলেও মার্কিন-সহযোগী দেশ তাইল্যান্ডের সতর্ক মনোভাব (এবং এখানেও চিন-বিরোধী নৌশক্তিকে ব্যবহার করে খালের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনা) বিষয়টিকে অকেজো করে ফেলেছে।

মালাক্কা প্রণালীর প্যাঁচ থেকে যে বেজিং বেরিয়ে আসতে চায় তাতে কোনও সন্দেহ নেই, আর তাত্ত্বিক ভাবে সেটা সম্ভবও বটে। কিন্তু বাস্তবে এই দক্ষিণের পথ শি’র তিনটি বিকল্পের মধ্যে সব থেকে কম গ্রহণযোগ্য। চিনের কৌশলগত ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে মালাক্কা বড্ড বেশি দূর, ফলে সমরসম্ভার সরবরাহের দিক থেকে এই বিকল্পটি বিপজ্জনক। এই সঙ্গে, ভীতিপ্রদ সপ্তম নৌবহর ছাড়াও এখানে সম্ভবত চিনকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো মার্কিন অনুগামী দেশ এমনকি বৃহৎ শক্তি ভারতকেও সামরিক ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। বড্ড দূরবর্তী এবং বড্ড কঠিন—দক্ষিণের পথটি চিনের পক্ষে কৌশলগত বিকল্প হিসেবে মোটেই কার্যকর নয়।

উত্তরের পথ (তাইওয়ান প্রণালী)

সব শেষে পড়ে রইল উত্তরের পথ—ভূ-কৌশলগত ভাবে তাইওয়ান প্রণালীর মাধ্যমে চিনের মুক্তির পথ। সব থেকে সরু অংশে মাত্র ১৬০ কিলোমিটার চওড়া এই প্রণালী চিনের মূল ভূখণ্ড থেকে গণতান্ত্রিক দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে আলাদা করেছে। দক্ষিণের পথে রসদ সরবরাহের যে সমস্যা, তা এখানে নেই। তা ছাড়া চিনের দিক থেকে আরও কৌশলগত সুবিধা আছে। কমজোরি তাইওয়ানকে সামরিক ভাবে সাহায্য করার জন্য আমেরিকার সঙ্গে হাত মেলাতে খুব কম সহযোগীই এগিয়ে আসবে। যদিও জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী তারো আসো সদ্য স্পষ্ট করেই বলেছেন, চিন যদি তাইওয়ান আক্রমণ করে টোকিও তা হলে সে ঘটনাকে ‘অস্তিত্বের সংকট’ হিসেবেই বিবেচনা করবে এবং আমেরিকার সাহায্যে এগিয়ে যাবে, কিন্তু বাস্তবে এ ক্ষেত্রে ফের জ্বালানি ভরে নেওয়া এবং রসদ সরবরাহের সমস্যা আছে। তাই সত্যিকারের মরিয়া লড়াইয়ে আমেরিকাকে জাপানের সহায়তার পরিমাণ যথেষ্ট কমই হবে।

ফার্স্ট আইল্যান্ড চেনের ভূ-কৌশলগত বন্দিদশা থেকে মুক্তি, কি শেষ পর্যন্ত চিনা নৌবহরের খোলা সমুদ্রে বেরিয়ে আসার সুযোগ- এসব ছাড়াও উত্তরের পথে বেজিং-এর পক্ষে আরও কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত আকর্ষণ রয়েছে। তাইওয়ান এখন সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরিতে বিশ্বসেরা। তাই তাইওয়ান জয় করতে পারলে চিন অর্থনৈতিক ভাবে অত্যাবশ্যক এই চিপ-এর বাজারটাও দখল করতে পারবে।

সব থেকে বড় কথা, আমেরিকা চিনের সঙ্গে একটা যুদ্ধ হেরে যাচ্ছে (বা আরও খারাপ, তাইওয়ানকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে তাড়াহুড়ো করে সরে আসছে আমেরিকা)—এমন ঘটনা চোখের সামনে ঘটলে সমগ্র ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চল জুড়ে তার অত্যন্ত তীব্র মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়বে। এশিয়ার বিপুল সংখ্যক মার্কিন সমর্থক দেশ এক সুরে প্রশ্ন তুলবে, আমেরিকা যদি তাইওয়ানের মতো দীর্ঘ দিনের গণতান্ত্রিক সহযোগীর প্রতিরক্ষাতেই এগিয়ে আসতে ইচ্ছুক না হয়, তা হলে ভবিষ্যতেও এ রকম ঘটনা ঘটতে বাধা কোথায়?

এ রকম ক্ষেত্রে আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা যখন তলানিতে, তখন তার সযত্নে গড়ে তোলা ইন্দোপ্যাসিফিক জোটের কাঠামোও যে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এ কথা বললে খুব বাড়িয়ে বলা হবে না। তখন ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম এবং আসিয়ানভুক্ত অন্যান্য দেশ পুরো পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে নতুন প্রধান শক্তি চিনের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করবে।

ভৌগোলিক নৈকট্যের দরুণ সরবরাহগত বিপুল সুবিধা, খুব কম মার্কিন সহযোগী দেশের মোকাবিলা করতে হওয়া, চিনের অভ্যন্তরীণ জাতীয়তাবাদী মানদণ্ড, তাইওয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সেমিকন্ডাক্টার শিল্প এবং মূলত বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার প্রভাব—এই সব কারণ মিলিয়ে শি জিনপিং-এর দৃষ্টিকোণ থেকে ফার্স্ট আইল্যান্ড চেনের বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উত্তরের পথই যুক্তিসঙ্গত কৌশলগত বিকল্প।

উপসংহারঃ চিনমার্কিন ঠান্ডা যুদ্ধের কেন্দ্র

তাইওয়ানই যদি নতুন চিন-মার্কিন ঠান্ডা যুদ্ধের কেন্দ্র হয়, তা হলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ক্রমশই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে এই বিরোধ শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটবে না। চিন যে ভাবে হংকং-এর পরিস্থিতি কড়া হাতে মোকাবিলা করেছে, তাতে চিনের সঙ্গে পুনর্মিলন প্রস্তাবে সম্মতির বিনিময়ে তাইপেকে দেওয়া চিনের আশ্বাস ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’-র অসারতা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বাস্তবিক পক্ষে, তাইওয়ানে ২০২০তে এক জাতীয় নিরাপত্তা সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের মাত্র এক শতাংশ মানুষ চিনের সঙ্গে অবিলম্বে পুনর্মিলন চান। কাজেই পুনর্মিলন যদি হতেই হয়, তা হবে বন্দুকের মুখে।

বেজিং-এর আশা, আগামী কয়েক বছরে বড় জিনিসকে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙ্গে নেওয়ার তাদের যে সাধারণ কৌশল, তা তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও খাটবে। এতে এক দিকে যেমন চিন যা চাইছে তাই পাবে, অন্য দিকে আমেরিকার সঙ্গে বড় রকম সঙ্ঘাতের বিপর্যয়ও এড়ানো যাবে। বার বার আকাশসীমা লঙ্ঘন, নৌবহর নিয়ে ঢুকে পড়া, সাইবার হানা, কূটনৈতিক চাপ—সবই একমুখী উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে চলা হবে। বার্লিন নিয়ে মার্কিন-সোভিয়েত ঠান্ডা যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট কেনেডি যা সত্যি বলে বুঝেছিলেন, এখানেও সেটাই ঘটতে চলেছে—শত্রুরা খুঁজবে আমেরিকা কখন নি্রুদ্যম, যাতে সহযোগীদের থেকে তাকে আলাদা করে ফেলা যায়।

যদি আগামী পাঁচ-ছয় বছরে এই বিভাজন না ঘটে তা হলে বুঝতে হবে আমরা এক চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে পৌছেছি। হয় বেজিংকে ফার্স্ট আইল্যান্ড চেনের কৌশলগত বন্দিদশা মেনে নিতে হবে, এবং ভূ-কৌশল আমূল বদলে নিজেকে স্থিতাবস্থার শক্তি হিসেবেই দেখতে হবে, অথবা শি তাঁর বর্তমান পথেই চলবেন যাতে সঙ্ঘর্ষ অনিবার্য।

অবশ্যই এ সব খুব সংযত ভাবে বলা। তবে শি’র দৃষ্টিকোণ থেকে চিনের সামনে বিকল্পগুলি দেখলে এ ছাড়া আর কোনও উপসংহারে পৌঁছনো যায় না। আশু ভবিষ্যতের জন্য আমাদের যতটা সম্ভব প্রস্তুত থাকতে হবে। নীতিমূলক বাস্তবতার শিক্ষা হল পৃথিবীকে সাদা কালো সব মিলিয়ে দেখতে হবে, আর চেষ্টা করতে হবে যাতে তাকে আরও ভাল করা যায়। আমেরিকার পক্ষে সব থেকে দরকারি কাজ হবে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, আর জোটের কাঠামো জোরদার করা—কারণ একটা মার্কিন নেতৃত্বাধীন শক্তিশালী জোট চিনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে সেটাই বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থা অটুট রাখা আর বিশ্বশান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে আমেরিকার একমাত্র করণীয়।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.