নেপাল সরকার গত ১৩ নভেম্বর চিনা মালিকানাধীন অ্যাপ টিকটক-কে এই বলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে যে, অ্যাপের বিষয়বস্তু সামাজিক সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর। সেই অনুযায়ী নেপাল টেলিকমিউনিকেশন অথরিটি (এনটিএ) দেশের সমস্ত ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীকে এই অ্যাপটি ব্লক করতে বলেছে, যা ২০১৮ সালের অগস্ট মাসে বেজিংভিত্তিক প্রযুক্তি সংস্থা বাইটড্যান্স দ্বারা নেপালে চালু হয়েছিল। এটি ইউটিউব ও ফেসবুকের পরেই দেশের তৃতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত মঞ্চ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। জানা গিয়েছে, অ্যাপটি নিষিদ্ধ করার সময় নেপালের ৩০ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ২.২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ সক্রিয় ভাবে সেটি ব্যবহার করছিলেন।
সরকার কেন টিকটক-কে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী রেখা শর্মা বলেছেন যে, এটি নেপালের ‘সামাজিক সম্প্রীতি, পারিবারিক কাঠামো ও পারিবারিক সম্পর্ক’কে ব্যাহত করেছে। গত চার বছরে ১৬০০টি টিকটক-সম্পর্কিত সাইবার অপরাধের মামলা সরকারের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়াও, টিকটক-কে ছোট আকারের ভিডিয়োগুলির মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে অশ্লীলতা প্রচারের জন্য দায়ী করা হয়েছিল।
গত চার বছরে ১৬০০টি টিকটক-সম্পর্কিত সাইবার অপরাধের মামলা সরকারের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে।
টিকটক-এর কিছু নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে নেপাল সরকার বারবার টিকটক-এর সংস্থার কাছে তার বিষয়বস্তুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। নেপাল এই সমস্যাগুলির সমাধান করার জন্য দেশে টিকটক-এর প্রতিনিধি নিয়োগ করতে চেয়েছিল। যাই হোক, টিকটক-এর অফিস এই উদ্বেগের প্রতি কর্ণপাত করেনি। এটিই একটি প্রধান কারণ, যা নেপাল সরকারকে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিষয়ে চালিত করেছিল।
এই ঘটনার পরেই সরকার ফেসবুক, এক্স এবং ইনস্টাগ্রাম-সহ সমস্ত সামাজিক গণমাধ্যম সংস্থাগুলিকে লিয়াজোঁ অফিস খুলতে এবং তিন মাসের মধ্যে নেপালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রকের সঙ্গে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সারার কথা জানিয়েছে। তেমনটা করতে ব্যর্থ হলে এ হেন মঞ্চগুলিরও টিকটক-এর মতোই পরিণতি হতে পারে।
নেপালে টিকটক-এর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে টিকটক অফিস বলেছে যে, এই ধরনের পদক্ষেপ শুধুমাত্র নেপালে তার বিনিয়োগ পরিকল্পনাকেই প্রভাবিত করবে না, বরং দেশের ব্যবসায়িক কার্যক্রমকেও মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত করবে। নেপালের বেশ কয়েকটি ছোট ব্যবসা, যেগুলি পণ্য এবং পরিষেবা বিপণনের বিকল্প উপায় হিসাবে টিকটক-এর ব্যবহার করেছিল, সেগুলি এই সিদ্ধান্তের দ্বারা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে। কারণ অনেকেই এ হেন সামগ্রী তৈরির মাধ্যমে আয়ের উপায় করেছেন।
টিকটক সংস্থার মতো প্রায় একই সুরে সুর মিলিয়ে নেপালের কিছু অধিকাররক্ষা গোষ্ঠী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ টিকটক-কে নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের এই সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে চিহ্নিত করেছেন। নেপালি কংগ্রেস নেতা গগন থাপা বলেছেন, ‘যারা সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে, তাদের নিরুৎসাহ করার জন্য প্রবিধান প্রয়োজন। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের নামে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়া সম্পূর্ণ ভুল।’
নেপালের বেশ কয়েকটি ছোট ব্যবসা, যেগুলি পণ্য এবং পরিষেবা বিপণনের বিকল্প উপায় হিসাবে টিকটক-এর ব্যবহার করেছিল, সেগুলি এই সিদ্ধান্তের দ্বারা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে। কারণ অনেকেই এ হেন সামগ্রী তৈরির মাধ্যমে আয়ের উপায় করেছেন।
প্রায় ৩০টি সংস্থা তাদের যৌথ বিবৃতিতে টিকটক-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সরকারি পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছে যে, এ হেন পদক্ষেপ কেবল মাত্র বাক্স্বাধীনতার অধিকার সংক্রান্ত নেপালের সংবিধানের ১৭তম (১২ক) অনুচ্ছেদ এবং ১৯তম অনুচ্ছেদকেই লঙ্ঘন করেনি, তার পাশাপাশি এটি ইউনিভার্সাল ডিক্লেয়ারেশন অব হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড দি ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস-এরও বিরোধিতা করেছে। এর পাশাপাশি আবার টিকটক নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নেপালের সুপ্রিম কোর্টে ১০টি পিটিশনও দায়ের করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতই ছিল প্রথম দেশ, যারা ২০২০ সালের জুন মাসে ভূ-রাজনৈতিক কারণে টিকটক-সহ চিনা ডেভলপারদের বেশ কয়েকটি অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছিল। ২০২০ সালের অক্টোবর মাস থেকে পাকিস্তান নানা পর্যায়ে অ্যাপটিকে চার বার নিষিদ্ধ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত, টিকটক অ্যাপটি তদন্তের আওতাধীন হয়েছে। কারণ টিকটক চিনা কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য পাঠানোর প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে কাজ করত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (ইউএস), ব্রিটেন (ইউকে), কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং অন্য একগুচ্ছ দেশও টিকটক-কে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
নেপালে অবশ্য কিছু গোষ্ঠী বিশ্বাস করে যে, অন্য বিষয়গুলির চাইতেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে টিকটক-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সি অনেক তরুণ - যাঁরা এখন হিন্দু রাষ্ট্র এবং রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত - তাঁদের বেশির ভাগই নিজেদের মতামত প্রচারের জন্য টিকটক ব্যবহার করে থাকেন। এই ধরনের কর্মকাণ্ড নেপালের বর্তমান সরকারের অস্তিত্বের জন্য এক ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেছে, যা দুর্নীতি, চোরাচালান এবং একের পর এক কেলেঙ্কারি রোধে ব্যর্থতার জন্য ধীরে ধীরে অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সর্বোপরি, টিকটক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রীয় ও প্রজাতন্ত্রী রূপগুলিকেও চ্যালেঞ্জ করেছিল। কারণ নতুন ক্ষমতাধররা হিন্দু রাষ্ট্র ও রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল, যা ২০০৮ সালে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সি অনেক তরুণ - যাঁরা এখন হিন্দু রাষ্ট্র এবং রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত - তাঁদের বেশির ভাগই নিজেদের মতামত প্রচারের জন্য টিকটক ব্যবহার করে থাকেন।
সর্বোপরি, কাঠমান্ডু এবং বেজিংয়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আগের মতো উষ্ণ নয়। এমনকি নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহলের সাম্প্রতিক চিন সফরের সময়ও চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে কোনও উল্লেখযোগ্য প্রকল্প দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়নি। এর বিপরীতে বরং নেপাল দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাকে পশ্চিম নেপালের পোখরায় ২১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচসম্পন্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে তদন্ত করার অনুমতি দিয়েছে, যা চিনা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির অর্থায়নে এবং উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল। চিন এটিকে তার ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প বলে মনে করলেও প্রধানমন্ত্রী দহলের উদ্বোধনের প্রায় এক বছর পরেও এই বিমানবন্দরে কোনও আন্তর্জাতিক উড়ান চলাচল করেনি। দুই দেশের মধ্যে এই অবিশ্বাসের আবহের মাঝেই নেপাল সরকার টিকটক নিষিদ্ধ করার একটি সহজ অজুহাত খুঁজে পেয়েছে এবং বলেছে যে, অ্যাপটি নেপালের সামাজিক সম্প্রীতিকে বিঘ্নিত করেছে।
আসলে, সরকার যদি টিকটক নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে সাইবার-অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করত, তা হলে তা সত্যিই প্রশংসনীয় হত। কিন্তু এ কথাও উপেক্ষা করা যায় না যে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যায় (অর্থাৎ একবার অ্যাপ ব্যবহারের অনুমতি দিলে অপরাধীদের শনাক্ত করার কাজটি কঠিনই শুধু নয়, বরং দুরূহ হয়ে পড়ে)। সমস্ত ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে টিকটক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া ফ্লাডগেট খোলার চাইতে খুব বেশি আলাদা নয়। কারণ টিকটিক অ্যাপটি ক্রমশ সাইবার অপরাধের আখড়া হয়ে উঠেছিল এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক আকারে ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল। টিকটক-এর কারণে অনৈতিক কার্যকলাপ এত দ্রুত বিকাশ লাভ করেছিল যে, সরকারের পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। তাই নিরাপত্তা বা অন্যান্য কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যে ভাবে অ্যাপটিকে নিষিদ্ধ করেছিল, নেপাল সেই একই পথে হেঁটে অ্যাপটিকে নিষিদ্ধ করেছে। যেহেতু নেপালে এখন টিকটক নিষিদ্ধ, তাই আশা করা যায় যে, দেশটিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং দেশে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
হরি বংশ ঝা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভিজিটিং ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.