ইন্দো–প্যাসিফিকের দিকে বিশ্বব্যাপী দৌড় এবং ‘বড় শক্তি’র দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার কারণে নীতি বিতর্ক ও সংশ্লিষ্ট চর্চা প্রায়শই অল্প কথায় সেরে নিয়ে সিওলের তাৎপর্যকে ছোট করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন ক্রমবর্ধমানভাবে ঘোলা জলে ঢুকে পড়ায় দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর–পূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক ভূগোলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাঁর প্রশাসন ক্ষমতায় আসার সঙ্গেসঙ্গেই প্রেসিডেন্ট ইউন সুক–ইওলের বৈদেশিক নীতির মূল দিশা হিসাবে এই কথা ঘোষণা করা হয়েছিল যে দক্ষিণ কোরিয়া একটি ‘বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র’ এবং একটি ‘নতুন সামুদ্রিক শক্তি’তে রূপান্তরিত হবে। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিকাঠামোগত ফ্রন্টে এই অভিপ্রায়টি কাজে পরিণত করার ইঙ্গিত দিয়েছেন, এবং দেশের সামুদ্রিক শিল্পকে উদ্দীপিত করা ও সামুদ্রিক কূটনীতির পরিধি প্রসারিত করার লক্ষ্যে কাঠামোগত ও কর্মক্ষমতাগত পরিবর্তনের সূচনা করেছেন।
সিওলের ইন্দো–প্যাসিফিক কৌশল কার্যকর করার কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই তার এই অঞ্চলে অর্থপূর্ণভাবে জড়িত হওয়া এবং অংশগ্রহণ করার অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়েছে। যে দেশটি ইতিমধ্যেই ইন্দো–প্যাসিফিকের একটি নির্ভরযোগ্য ও ইচ্ছুক অংশীদার হিসাবে বিবেচিত সেই ভারতের জন্য এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার দিগন্ত প্রসারিত করার একটি ভাল সুযোগ নিয়ে এসেছে। নয়াদিল্লি ও সিওল তাদের নিজ নিজ সামুদ্রিক ভূগোল, ভূ–রাজনৈতিক সক্ষমতা ও বৈদেশিক নীতির অভিযোজনের ক্ষেত্রে ইন্দো–প্যাসিফিকের দুই গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব।
সিওলের ইন্দো–প্যাসিফিক কৌশল কার্যকর করার কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই তার এই অঞ্চলে অর্থপূর্ণভাবে জড়িত হওয়া এবং অংশগ্রহণ করার অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়েছে।
পূর্ববর্তী সরকারের সময় উত্তর কোরিয়ার (ডিপিআরকে) সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক বেশি মাত্রায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছিল, এবং প্রতিবেশীদের বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈদেশিক নীতি সম্পৃক্ততায় সরকার অমনোযোগী ছিল। এরপর প্রেসিডেন্ট ইউনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি শুধু প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়ার (আরওকে) অভ্যন্তরীণ ও বিদেশনীতির সংশোধন করার জন্যই প্রয়োজনীয় ছিল না, একইসঙ্গে উত্তর–পূর্ব এশিয়ায় দেশটির কৌশলগত সুবিধাগুলির উপর জোর দেওয়ার জন্যও জরুরি ছিল। তা ছাড়াও এটি প্রয়োজনীয় ছিল ডিপিআরকে সম্পর্কিত লাইন সংশোধনের জন্যও। প্রেসিডেন্ট ইউন এমনকি জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক সংশোধন ও নিরাপত্তা অংশীদারি জোরদার করার ইচ্ছারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ইউনের নেতৃত্বের সময় সিওল এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা মিত্র হিসাবে নিজের স্থান আবার নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, এবং সেইসঙ্গেই চাইছে ইন্দো–প্যাসিফিকের গণতান্ত্রিক ও কৌশলগতভাবে সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে, আর আঞ্চলিক উদ্বেগ ও দাবিতে সর্বোত্তমভাবে সাড়া দেওয়ার শক্তি কাজে লাগাতে। যাই হোক,মনে রাখতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যত জোরে কথা বলার বা ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তার থেকেও আরওকে বা ইন্দো–প্যাসিফিকের অন্য দেশগুলির প্রায়শই ক্রমাগত কিন্তু পরিমাপ করা পদক্ষেপগুলি প্রকৃত অর্থে বেশি সোচ্চার উচ্চারণ। এই বিন্যাসটি একইসঙ্গে একটি সভ্যতাগত বৈশিষ্ট্য, আর তার পাশাপাশি আঞ্চলিক দেশগুলির জন্য একটি সমসাময়িক ভূ–রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা।
যাই হোক, সাধারণভাবে চাপা স্বভাবের হওয়া সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক দেশগুলি আরও শক্তিশালী এবং আরও স্পষ্ট মনোভাব গ্রহণ করেছে, বিশেষ করে বেজিংয়ের ক্ষেত্রে, এবং তা বৃহত্তর আন্তঃঅঞ্চল সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করেছে।
অভিসরণের অভিন্নতা
যদিও নতুন দিল্লির অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি (এইপি) ও সিওলের নিউ সাদার্ন পলিসি (এনএসপি) লক্ষ্যগতভাবে একই জায়গায় মিলিত হওয়ার কারণে দ্বিপাক্ষিকভাবে দুই দেশের মধ্যে ‘বিশেষ কৌশলগত অংশীদারি’ তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে, তবে এই সময়টিই কিন্তু ইন্দো–প্যাসিফিকের প্রেক্ষাপটে গভীর সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনের সময়। সিওলের ইন্দো–প্যাসিফিক কৌশল ভারতকে একটি মূল খেলোয়াড় হিসাবে তালিকাভুক্ত করে, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দিকে সিওলের প্রসারের জন্য নয়াদিল্লি হল সেরা পছন্দ৷ যদি এনএসপি এবং এইপি লঞ্চপ্যাড হয়, তবে উভয় দেশের ইন্দো–প্যাসিফিক নীতিগুলি বৃহত্তর ও আরও অর্থপূর্ণ সহযোগিতার জন্য নিখুঁত সংযোগ বিন্দু। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুন ২০১৮ সালে তাঁর সফরের সময় মন্তব্য করেছিলেন ভারত এবং আরওকে ‘৩পি+ পদ্ধতিতে ভবিষ্যৎভিত্তিক সহযোগিতার দিকে’ যেতে প্রস্তুত, যা ‘কোরিয়ার নিউ সাদার্ন পলিসির বাইরে প্রসারিত হয়ে জনগণ, সমৃদ্ধি ও শান্তির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে’। ২০২৩, ঘটনাচক্রে, দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর চিহ্নিত করবে।
সিওল ও নয়াদিল্লি উভয়েই আসিয়ান, ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন ও কোয়াডের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতার স্থাপত্যে ইস্যুভিত্তিক সম্পৃক্ততা তৈরি করতে খুবই আগ্রহী এবং সক্ষম। সেইসঙ্গেই, সম্ভবত, দুই দেশ অনানুষ্ঠানিক বা তার পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক সমন্বয় গঠন করে কর্মভিত্তিক ও ক্ষেত্রনির্দিষ্ট স্বল্পপাক্ষিক সহযোগিতাতেও আগ্রহী। আরওকে অতিমারি চলাকালীন কোয়াড–এর সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছিল, এবং কোয়াড প্লাস ব্যবস্থারও সক্রিয় অংশ হতে থাকবে, যা সম্ভবত পূর্ণ সদস্যতার দিকে চালিত করবে। যেখানে স্থিতিস্থাপক সরবরাহ শৃঙ্খল, জলবায়ু সক্রিয়তা, উদীয়মান ও অতি–গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, বিশ্ব স্বাস্থ্য, স্থিতিশীল পরিকাঠামো, এবং সংযোগগুলি হল সহযোগিতার মূল ক্ষেত্র, ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রেক্ষাপটে এই সবই সামুদ্রিক নিরাপত্তা সহযোগিতার বিকাশের সঙ্গে সংযুক্ত।
কর্মপদ্ধতিগত সহযোগিতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সামুদ্রিক সহযোগিতা বাড়ানোর অন্য সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলির মধ্যে আছে অনুসন্ধান ও উদ্ধার, সামুদ্রিক ক্ষেত্রে সচেতনতা, সামুদ্রিক দূষণ, মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ত্রাণ, সন্ত্রাসবাদ ও পাচার-বিরোধী তৎপরতা, সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধ এবং জলদস্যু–বিরোধী তৎপরতা।
আরওকে–র সামুদ্রিক সক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য ইউনের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে দেশের রপ্তানি ও আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল পরিকাঠামো, স্বয়ংক্রিয় বন্দর এবং পরিবেশবান্ধব স্বায়ত্তশাসিত জাহাজগুলির দ্বারা সমর্থিত একটি স্থিতিশীল সরবরাহ শৃঙ্খল প্রতিষ্ঠা করা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকাবাহী জাহাজগুলির পরিবহণ ক্ষমতা সম্প্রসারণ, এবং বন্দর ও বিতরণ কেন্দ্রগুলির মতো বিদেশি বিতরণ ঘাঁটিগুলি সুরক্ষিত করে একটি স্থিতিশীল বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করা। তার দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকর করার জন্য সরকার সামুদ্রিক অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে যথেষ্ট বিনিয়োগ করবে। আরওকে–র প্রযুক্তিগত দক্ষতার সুবাদে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণে সহযোগিতার জন্য চুক্তিগুলি ইতিমধ্যেই রয়েছে, যা প্রায়শই ভারতের সামুদ্রিক ক্ষেত্রে হারানো সুযোগ হিসাবে বিবেচিত হয়। কোরিয়া শিপইয়ার্ডের সহায়তায় হিন্দুস্তান শিপইয়ার্ড লিমিটেডের নৌ–জাহাজ নির্মাণ প্রকল্পের আধুনিকীকরণ, এবং কোরিয়ার এসটিএক্স অফশোর ও শিপবিল্ডিং কোম্পানির সঙ্গে গেল ইন্ডিয়া লিমিটেডের এলএনজি জাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তি ভাগ করে নেওয়ার কাজ ইতিমধ্যেই চলছে। কর্মপদ্ধতিগত সহযোগিতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সামুদ্রিক সহযোগিতা বাড়ানোর অন্য সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলির মধ্যে আছে অনুসন্ধান ও উদ্ধার, সামুদ্রিক ক্ষেত্রে সচেতনতা, সামুদ্রিক দূষণ, মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ত্রাণ, সন্ত্রাসবাদ ও পাচার-বিরোধী তৎপরতা, সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধ এবং জলদস্যু–বিরোধী তৎপরতা।
জি২০, নয়াদিল্লি এবং আরওকে
কেন ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সি এই উদ্দেশ্যে উপযুক্ত মুহূর্ত প্রদান করে? কারণ বিশ্ব যখন ইন্দো–প্যাসিফিকের দিকে ঝুঁকছে, সেই সময় ভারতের দিকেও ক্রমবর্ধমানভাবে ঝুঁকছে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অংশীদার পাওয়ার জন্য যে এখন আরও দৃঢ়ভাবে ইচ্ছুক, এবং অবশ্যই আগের চেয়ে আরও বেশি সক্ষম। সিওলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া ও চিনের তাৎক্ষণিক পরিধির বাইরে আঞ্চলিক অংশীদারদের সন্ধান করা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে, কারণ মার্কিন–চিন বৈরিতার কারণে উদ্ভূত অনিশ্চয়তা এবং সিওলের মার্কিন টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেশে মোতায়েন করার অনুমতি দেওয়ার পরে চিনের অর্থনৈতিক প্রতিশোধের প্রচারণার তিক্ত অভিজ্ঞতা। ডিজিটাল অর্থনীতি ও উন্নয়নে অগ্রগতির পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম ও রাজনৈতিকভাবে ইচ্ছুক দেশ হিসাবে ভারত আরওকে–র জন্য একটি স্বাভাবিক পছন্দ। জানুয়ারিতে, জি২০–র প্রথম আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থাপত্যের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিদল জোর দিয়ে বলেছিল যে ভারত শুধু অর্থনৈতিক আয়তন ও জনসংখ্যার কারণে প্রমাণিত হার্ড পাওয়ার নয়, সেইসঙ্গেই সফট পাওয়ার হিসাবেও প্রস্তুত।
১–২ মার্চ দিল্লিতে জি২০ বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ ব্যস্ত থাকার কারণে আরওকে বিদেশমন্ত্রীর অনুপস্থিতি ভাষ্যকারদের প্ররোচিত করেছিল ঘটনাটিকে ভরবেগে বিরতি হিসাবে সনাক্ত করতে, এবং জল্পনা উস্কে দিয়েছিল বৈঠকটির উপর আরোপিত গুরুত্বের মাত্রা এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে। কিন্তু এই ব্যাখ্যাগুলো ক্ষণস্থায়ী, কারণ বৈশ্বিক বাধ্যবাধকতার জটিলতাগুলো ব্যাপক হলেও এগুলির ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে আঞ্চলিক সহযোগিতার চাহিদা অবদমিত করার সম্ভাবনা কম। যদিও কূটনৈতিক বাগাড়ম্বরের পরিমাপ ও প্রাসঙ্গিকীকরণ প্রয়োজন, প্রকৃত ও দৃঢ় সহযোগিতাই কিন্তু বাস্তব ও অর্থপূর্ণ পার্থক্য আনবে। সেই ক্ষেত্রে যদি পূর্ববর্তী মুন প্রশাসনের সময়ে গভীর সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয়ে থাকে, যদি সিওল অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো–প্যাসিফিক নির্মাণকে গ্রহণ করে থাকে, তাহলে ইউনের অধীনে আরওকে–ভারত মধ্যম শক্তি কূটনীতি ত্বরান্বিত হয়েছে বলে মনে হয়।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.