Image Source: X.COM
মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় সফর ভারত-মলদ্বীপ সম্পর্ককে সঠিক দিশা দেখিয়েছে। মলদ্বীপ পারস্পরিক সুবিধার পথে চালিত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, দেশটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা পেয়েছে এবং ভারত দ্বীপদেশটিতে তার উপস্থিতি ও প্রভাব বাড়িয়েছে। এই ঘটনাপ্রবাহ ভারত ও মলদ্বীপের সামনে উপস্থিত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থাৎ বিদেশনীতিতে পক্ষপাতিত্ব কাটিয়ে ওঠার সুযোগ প্রদান করেছে।
২০০৮ সালে মলদ্বীপের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পর থেকে দ্বীপদেশটির প্রধান দলগুলি ভারতের সঙ্গে একটি পক্ষপাতমূলক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। মলডিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এমডিপি) ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ক্ষমতায় থাকাকালীন ইন্ডিয়া ফার্স্ট বা ভারত প্রথম নীতি গ্রহণ করে এবং ভারতের সঙ্গে একাধিক স্তরে ক্ষেত্রগত সহযোগিতা উন্নত করে। তবে আবদুল্লা ইয়ামিনের প্রোগ্রেসিভ পার্টি অফ মলদ্বীপ (পিপিএম) চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। চিনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ-এ (বিআরআই) ইয়ামিনের যোগদানের সিদ্ধান্ত, বেজিংয়ের কাছ থেকে ব্যাপক ভাবে ঋণ নেওয়া এবং চিনের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করার বিষয়টি নয়াদিল্লির জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ইয়ামিনের কার্যকাল জুড়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতের সমালোচনা এই দুই দেশের সম্পর্কে ভাঙন সৃষ্টি করে এবং প্রেসিডেন্ট তাঁর ক্ষমতায় থাকার শেষের কয়েক মাসে তাঁর ভারত বিরোধী নীতিগুলিকে আরও তীব্র করেন।
চিনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ-এ (বিআরআই) ইয়ামিনের যোগদানের সিদ্ধান্ত, বেজিংয়ের কাছ থেকে ব্যাপক ভাবে ঋণ নেওয়া এবং চিনের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করার বিষয়টি নয়াদিল্লির জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এই ভারত-বিরোধী বাগাড়ম্বর আরও তীব্র হয়, যখন ইয়ামিনকে গণতান্ত্রিক ভাবে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং তিনি বিরোধী দলের নেতা হয়ে ওঠেন। তাঁর দ্বিতীয় দল অর্থাৎ পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস (পিএনসি) ও পিপিএম-এর সঙ্গে মিলে তিনি ভারতের সঙ্গে ইব্রাহিম সোলি (এমডিপি) সরকারের ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা, উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার রাজনীতিকরণের উদ্দেশ্যে একটি ইন্ডিয়া আউট প্রচারাভিযান শুরু করেন। তাঁরা এমডিপি ও ভারতকে দ্বীপদেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করার অভিযোগ এনে জাতীয়তাবাদী আবেগকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এই প্রচারাভিযান এবং ভোটারদের সমর্থনের উপর ভিত্তি করে মোহাম্মদ মুইজ্জু (যিনি পিএনসি দলের সদস্য) ২০২৩ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং ভারত থেকে সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনার জন্য চিনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
যাই হোক, এই সময় নয়াদিল্লি এই অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির প্রেক্ষিতে মুইজ্জু সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার জন্য যথেষ্ট উদার মনোভাবই প্রদর্শন করেছিল। মুইজ্জুর বিজয়ের পরে চিনের সঙ্গে মলদ্বীপের সম্পর্ক মারাত্মক বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ভারত দ্বীপদেশটির নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার উপায় অন্বেষণ করেছিল। ভারত যথেষ্ট কূটনৈতিক ধৈর্য প্রদর্শন করেছে। নতুন সরকারের চাহিদা ও আগ্রহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারত সহায়তা, রফতানি কোটা বৃদ্ধি করেছে ও সামরিক কর্মীদের বদলে প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের প্রতিস্থাপন করেছে। এর পাশাপাশি ভারত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে এবং এক বছরের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের দু’টি ট্রেজারি বিল প্রদান করেছে। মুইজ্জুর সাম্প্রতিক সফরের সময় ভারত ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি মূল্যের একটি কারেন্সি সোয়াপ বা মুদ্রা বদল সুবিধার প্রস্তাব দিয়েছিল।
অর্থনৈতিক দুরবস্থা, ভারতের প্রভাব ও ইঙ্গিত এবং চিনের মতো অংশীদারদের কাছ থেকে দুর্বল সমর্থন মুইজ্জুকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ করতে বাধ্য করেছে। দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, মুইজ্জুর সাম্প্রতিক সফরের সময় উভয় দেশ একটি সর্বাত্মক অর্থনৈতিক ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব সংক্রান্ত বিষয়ে আরও সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছিল। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়ন, বাণিজ্য ও অর্থনীতি, ডিজিটাল ও আর্থিক সক্ষমতা, শক্তি, স্বাস্থ্য, জনগণের মধ্যে সম্পর্ক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। এই উদ্যোগগুলি শক্তিশালী সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করতে পারে এবং একটি নিরপেক্ষ সম্পর্ক লালন করতে পারে।
অর্থনৈতিক দুরবস্থা, ভারতের প্রভাব ও ইঙ্গিত এবং চিনের মতো অংশীদারদের কাছ থেকে দুর্বল সমর্থন মুইজ্জুকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ করতে বাধ্য করেছে।
রাজনৈতিক আস্থা ও প্রতিশ্রুতিও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আনুষ্ঠানিক সফর চলাকালীন বিরোধী এমডিপি-র সঙ্গে এস জয়শঙ্করের বৈঠকের রাজনীতিকরণের অভাব পিপিএম-পিএনসি-র ক্রমবর্ধমান পরিপক্বতা এবং বিশ্বাসের প্রতি ইঙ্গিত দেয়, যা ইয়ামিনের সময়ে অনুপস্থিত ছিল। সর্বোপরি তাঁর সাম্প্রতিক সফরের সময় মুইজ্জু বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং দুই দলের মধ্যে সম্পর্কের পাশাপাশি অংশীদারিত্ব ও পারস্পরিক বোঝাপড়াকে আরও গভীর করতে আলোচনা চালান। ভিশন ডকুমেন্টে বিভিন্ন স্তরে রাজনৈতিক ও নেতৃত্বের আদান-প্রদান জোরদার করা এবং দুই সংসদের মধ্যে সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরের উপরও জোর দেওয়া হয়েছে।
যাই হোক, মলদ্বীপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের ঘটনাটি এই চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জটিলতাগুলির উজ্জ্বল উদাহরণ। অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও ধরপাকড় নিয়ে অসন্তুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ভারত আন্তর্জাতিক চাপ ও সমালোচনা থেকে মলদ্বীপকে রক্ষা করেছে। এই কথা মাথায় রেখেই প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন ২০১৬ সালে ভারত সফরের সময়ে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার কথা বলেছিলেন। তিনি সমর্থনের জন্য ভারত ও তার নেতৃত্বকে ধন্যবাদ জানান এবং ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধি করে এমন একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি-সহ ছ’টি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যাই হোক, মাত্র দু’বছর পরে তিনি সেই অংশীদারকেই মলদ্বীপের সার্বভৌমত্বে নাক গলানোর দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সেই বিষয়গুলির সমালোচনা করেছিলেন, যেগুলির ওকালতি নিজেই প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন করেছিলেন।
বর্তমানে মুইজ্জুর পুনর্বিবেচনার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ হয়েছে, বিশেষ করে তাঁর দল এবং জোটের দীর্ঘ সাত বছরের ভারত বিরোধী প্রচারের পর।
মলদ্বীপের রাজনীতির চরিত্রই এ হেন। দেশীয় রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ এবং চিন ভারত-মলদ্বীপ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সম্ভাবনাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। বর্তমানে মুইজ্জুর পুনর্বিবেচনার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ হয়েছে, বিশেষ করে তাঁর দল এবং জোটের দীর্ঘ সাত বছরের ভারতবিরোধী প্রচারের পর। তা সত্ত্বেও, দেশের রাজনীতি গভীর ভাবে মেরুকৃত এবং বিভাজন ও দলাদলির সাক্ষী হয়ে চলেছে - যা ভারতকে রাজনীতিকরণ ও জাতীয়তাবাদের নিরিখে খানিক দুর্বল করে তুলেছে। সর্বোপরি, চিনের সঙ্গে পিপিএম-পিএনসি-র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, চিনা বিনিয়োগ এবং ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিও এই নিরপেক্ষ সম্পর্কের সম্ভাবনাকে সীমিত করতে পারে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.